বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ছয়দফা : বাঙালির রাজনৈতিক ইতিহাসের মুক্তির সনদ

ড. মো. সেকান্দর চৌধুরী | বুধবার , ৭ জুন, ২০২৩ at ৫:৪১ পূর্বাহ্ণ

ঐতিহাসিক ‘ছয়দফা’ ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন “ছয়দফা স্বাধিকারের সাঁকো দিলাম। এই সাঁকো বেয়ে একদিন বাঙালি স্বাধীনতা অর্জন করবে।” ‘ছয়দফা’ ঘোষণার মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালি কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা অর্জন করে। পৃথিবীর বুকে স্থান করে নেয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। এতে ত্রিশ লক্ষ শহিদ ও লক্ষ লক্ষ মাবোনের সম্ভ্রম হারানোর ক্ষতও আছে। বাঙালির শত সংগ্রামের শত আকাঙ্ক্ষার মহামুক্তি বাংলাদেশের স্বাধীনতা (২৬ মার্চ) ও মুক্তিযুদ্ধের বিজয় (১৬ ডিসেম্বর) এসেছে একটি প্রকৃতিগত আন্দোলনের মাধ্যমে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা শুধু একটি ঘোষণায় আসেনি। এজন্য প্রয়োজন ছিল সুদীর্ঘ সংগ্রাম ও রাজনৈতিক প্রস্তুতি, যেটি বঙ্গবন্ধুর অনিবার্য নেতৃত্বে সম্ভব হয়েছিল।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ওপনিবেশিক শাসনবলয় থেকে মুক্ত হয়ে পূর্ববাংলা হয়ে উঠলো পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন শোষণ বলয়ের নব উপনিবেশ। পাকিস্তান রাষ্ট্রের শুরু থেকে বাংলার জনগণের উপর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নিপীড়ন চলে। পাকিস্তান সৃষ্টি থেকে নানা বৈষম্য বাঙালি নেতৃত্ব সহজভাবে কখনো মেনে নেয়নি।

আওয়ামী লীগ গঠনের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান অর্জনের রাজনৈতিক সংগঠনকে বাংলার জনগণ প্রত্যাখ্যান করে। মাতৃভাষার অধিকার আন্দোলনে বাঙালি ছাত্রজনতা রাজপথে প্রাণ বিসর্জন দেন। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে বাংলার মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রত্যাখ্যান করে। কিন্তু নির্বাচনে জয়ী হয়েও পশ্চিমা স্বার্থান্বেষী মহলের চক্রান্তে যুক্তফ্রন্ট সরকার সফল হতে পারেনি। ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারি করে জেনারেল আইয়ূব খানকে প্রধান করে সামরিক আইন প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। ১৯৫৯ সালে ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ নামক অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু করে বাংলার মানুষের ভোটাধিকার হরণ করা হয়। ১৯৬০১৯৬৫ পাকিস্তানে নির্বাচনের নামে প্রহসন অনুষ্ঠিত হয়। এভাবে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সূচনার পর থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত এদেশে কোনো জনপ্রতিনিধিশীল সরকার প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। অন্যদিকে ১৯৬৫ সালে ভারতপাকিস্তান যুদ্ধে পূর্বপাকিস্তানকে অরক্ষিত রাখা হয়। পূর্বপাকিস্তানের উপর সকল পরিকল্পনা মূলত কেন্দ্র থেকে চাপিয়ে দেওয়া হতো। জরুরি অবস্থায়ও কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা পূর্বপাকিস্তান কর্তৃপক্ষের ছিল না।

এরূপ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ সভাপতি ‘বঙ্গবন্ধু’ শেখ মুজিবুর রহমান পূর্বপাকিস্তানের স্বাধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের দাবি সম্বলিত ‘ছয়দফা’(৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬) প্রণয়ন করেন। ৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকার সংবাদপত্রে এ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত বিবরণ ছাপা হয়। আওয়ামী লীগের তরুণ কর্মীরা বাঙালির দাবিছয় দফা, বাঁচার দাবি ছয় দফা, ছয় দফার ভিতরেই পূর্বপাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন নিহিত ইত্যাদি প্রচার করত। তারপর ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে ‘আমাদের বাঁচার দাবি ছয়দফা কর্মসূচী’ শীর্ষক একটি পুস্তিকা বিলি করা হয়। ছয়দফার মূল বক্তব্য . লাহোর প্রস্তাব ১৯৪০ ভিত্তিতে সংবিধান, . ফেডারেল সরকারের হাতে প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র, . দুই অঞ্চলের জন্য পৃথক ও সহজ বিনিময়যোগ্য মুদ্রা ব্যবস্থা, দু’অঞ্চলের জন্য আলাদা ফেডারেল রিজার্ভ ব্যবস্থা, . দু’অঞ্চলের জন্য আলাদা শুল্ক ও কর অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, . দু’অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পৃথক হিসাব রাখা এবং অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা রাজ্যের হাতে রাখা এবং ৬. প্রতিরক্ষায় পূর্বপাকিস্তানকে স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে আধাসামরিক বাহিনী গঠন, পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্রাগার স্থাপন এবং কেন্দ্রীয় বাহিনীর সদর দপ্তর পূর্বপাকিস্তানে স্থাপন।

ছয়দফাকে’ বঙ্গবন্ধু গোটা পাকিস্তানের বাঁচার দাবি বললেও পাকিস্তানের একটি শ্রেণি এটিকে পাকিস্তান ভাঙার অস্ত্র হিসেবে দেখে। ফেব্রুয়ারি থেকে সে বছরের জুন পর্যন্ত ছয়দফার পক্ষে পূর্বপাকিস্তান জুড়ে প্রচারণা ও আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে। ‘ছয়দফা’ আন্দোলন অচিরেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এতে আইয়ূবমোনেম চক্র অবাঞ্চিত হয়ে পড়ে। শুরু হয় জেলজুলুম। বঙ্গবন্ধু যেখানে জনসভা করতে যান সেখানেই গ্রেফতার হন। প্রেফতার থেকে জামিন মধ্যখানে ২০ মার্চ ৮ মে পর্যন্ত বত্রিশটি জনসভা করেন। এতে ‘ছয়দফার’ পক্ষে পুর্বপাকিস্তানে ব্যাপক জনমত গড়ে ওঠে। সহসা বঙ্গবন্ধু জনপ্রিয় নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। ১০ মে’র মধ্যে বঙ্গবন্ধুসহ প্রায় ৩৫,০০০ নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে ১৯৬৬ সালের ৭ জুন সারা দেশে হরতালের ডাক দেয়। ঐ হরতালে সর্বপ্রথম শ্রমিকশ্রেণি আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের শ্রমিকরাও আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। একইদিনের হরতালে তেঁজগাও শ্রমিক এলাকায় ব্যাপক বিক্ষোভ সংঘটিত হয় এবং বেঙ্গল বেভারেজের শ্রমিক মনুমিয়া মারা যান। নারায়ণগঞ্জের রেলওয়ে স্টেশনে পুলিশের গুলিতে ৬জন শ্রমিক প্রাণ হারান। সরকারি হিসেব মতে ৭ জুনের শুলিবর্ষণে নিহতের সংখ্যা ১১ জন।

১৯৬৬ সালের ৭ জুন থেকে আজ পর্যন্ত ৭ জুন ‘ছয়দফা দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে, বঙ্গবন্ধুর ক্যারিশমেটিক লিডারের খ্যাতি ও ছয়দফা দাবির জন্য ৭ই জুন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণভাবে এ আলোচনা এখানেই শেষ করা যেত। কিন্তু বঙ্গববন্ধুর ‘ছয়দফা’ আন্দোলন এবার আমরা অন্যরকম বিশ্লেষণে আনতে চাই। আমাদের জানামতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্রান্তিকালে এক শান্তিময় ইউরোপ ও বিশ্বসভা গড়ার আহবান জানিয়েছিলেন তৎকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন তাঁর বিখ্যাত ‘১৪ দফা’ ঘোষণার মধ্য দিয়ে। The Fourteen Points was a statement of principles for peace that was to be used for peace negotiations in order to end World War I. নীতিগুলো ৪ জানুয়ারি ১৯১৮ সালের যুদ্ধের লক্ষ্য এবং রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসে শান্তি শর্তাবলীর একটি রূপরেখা বক্তৃতায় দেওয়া হয়েছিল। এটিই হলো কোনো রাষ্ট্রনায়কের দফাভিত্তিক প্রথম বক্তৃতা। নেহেরু রিপোর্ট (মতিলাল নেহেরু) ১৯২৮ ছিল একটি স্মারকলিপি যা ভারতের নতুন শাসনতন্ত্র সংস্কারে স্বায়ত্তশাসনের একটি রূপরেখা। The Nehru Report of 1928 was a memorandum of All Parties Conference in British India to appeal for a new dominion status and a federal set-up of government for the constitution of India. ১৯২৮ সালের ১০ আগস্ট নেহরু রিপোর্ট প্রকাশিত হলে মুসলিম লীগ সভাপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ নেহেরু রিপোর্টের বিপরীতে ভারতের মুসলমানদের দাবিদাওয়া সম্বলিত ‘১৪ দফা’ পেশ করেন। তার চৌদ্দ দফার মূল বক্তব্য হলো– All legislatures in the country and other elected bodies shall be constituted on the definite principle of adequate and effective representation of minorities in every province without reducing the majority in any province to minority or even equality.

প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের ‘চৌদ্দ দফায়’ (১৯১৮) প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর শান্তিপূর্ণ ইউরোপ ও সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ গঠনের আহবান সফলতা পেয়েছিল। কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট মতিলাল নেহেরুর রিপোর্টও ডোমিনিয়ম স্ট্যাটাসের অধিকার প্রদানের সুপারিশ করলেও দু’দশকের মধ্যে ভারত স্বাধীন হয়েছিল। অন্যদিকে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ভারতের মুসলমান ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকারকে শাসনতন্ত্রে অন্তর্ভূক্ত করার সুপারিশ হতে তার ‘চৌদ্দ দফায়’ ১৯৩২ সালের সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ ও ১৯৩৫ সালের ভারত শাসনের ধর্মভিত্তিতে পৃথক নির্বাচন পদ্ধতির ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ১৯৪০ সালের মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে লাহোর প্রস্তাব পাশ করে। ধর্মের ভিত্তিতে মুসলমানদের জন্য আলাদা আলাদা রাষ্ট্রের প্রস্তাব পাশ করে।

১৯৪৭ সালে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ নিয়ে ভারতবিভক্তির মধ্যে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়। বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে ১৯৬৬ সালে পূর্বপাকিস্তানের জন্য স্বায়ত্তশাসনস্বাধিকার অর্জনের রূপরেখা প্রণয়ন করেন। সহসা তিনি পাকিস্তানি সামরিক জান্তার রোষাণলে পড়েন এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেফতার হন। ছাত্রজনতার দুর্বার আন্দোলন তথা অসহযোগ আন্দোলনের চূড়ান্ত বিজয়ে জেল থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত হন। অচিরেই তাঁরই নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীনসার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। অতএব, উড্রো উইলসন ১৯১৮ সালে ১৪ দফা, জিন্নাহ’র চৌদ্দ দফা নেহেরু রিপোর্ট ও বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। পৃথিবীর শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে দুই শতকের রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ‘ছয়দফা’ পলিটিক্যাল টেস্টামেন্ট’ হিসেবে বিস্ময় স্মারক হয়ে থাকবে।

লেখক : প্রফেসর, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ;

সাবেক ডিন, কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রবাহ
পরবর্তী নিবন্ধচকরিয়ায় বনে দুইদিন ধরে পড়েছিল বৃদ্ধের লাশ