প্রবাহ

তুরস্কে এরদোয়ানের বিজয়ে ভাবনা

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ৭ জুন, ২০২৩ at ৫:৪০ পূর্বাহ্ণ

তুরস্কে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তৃতীয়বারের মত এরদোয়ান জয় লাভ করেন। ফলে আগামী ৫ বছরের জন্য তুরস্কের নেতৃত্ব দিবেন তিনি। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে বিশ্বে কৌতুহলের শেষ নেই। তেমনিভাবে আমরা বাংলাদেশীদের মাঝেও আগ্রহের শেষ নেই। তবে এ কথা সত্য যে বিশ্বে প্রায় ২ শত কোটি মুসলমানের মধ্যে শতকরা ৭০/৮০ জন অন্তরের গভীর থেকে এরদোয়ানের বিজয় কামনা করেন। বিশ্ব মুসলিম আজ অসহায় যোগ্য, সাহসী ও ইসলামকে এগিয়ে নেয়ার মত নেতার বড়ই অভাব। সেই কারণে এরদোয়ানের জয় হলে মুসলিম বিশ্ব হয়ত একজন নেতা পাবে। যেহেতু তিনি সাহসী ব্যক্তিত্ব।

রিজেপ তাইয়েপ এরদোয়ান রক্তে মাংসে গড়া একজন মানুষ। গত ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ বিধ্বংসী ভূমিকম্পে পরবর্তী উদ্ধার কাজে ব্যর্থতা, দুর্নীতি, স্বৈরাচারী, দমন নিপীড়নসহ তাঁর বিরুদ্ধে রয়েছে নানান দুর্নাম। দোষেগুণে মানুষ। কাজেই তুরস্কের জনগণ বুঝে নিয়েছে এরদোয়ানকে বাদ দিলে হয়ত আরও বেশি চরম মূল্য দিতে হবে।

আজ বিশ্বের বহু দেশে মুসলমানরা অসহায়। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো মুসলমানে মুসলমানে ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ লাগিয়ে দিয়ে তামাশা দেখছে। অনেক দেশে মুসলমানগণ অভিভাবকহীন হয়ে মার খাচ্ছে। যেমনআমাদের পার্শ্ববর্তী মায়ানমারের রোহিঙ্গারা আজ বড় অসহায়। ৮/১০ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে অসহায়ভাবে অস্থায়ীভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছে। আসামেকাশ্মীরে মুসলমানগণ প্রতিকূল অবস্থায় রয়েছে। ইরাকে, ইয়েমেনে, সোমালিয়ায় মুসলমানে মুসলমানে যুদ্ধ করছে। এতে উন্নত বিশ্বের নামে মুসলিম বিদ্ধেষীরা এসব কিছুতে কল কাঠি নাড়ছে। ইসরাইল ফিলিস্তিনিদেরকে পাখির মত মারছে। সোমালিয়া বাদেও আফ্রিকার অনেক দেশে লাখ লাখ মুসলমান অভ্যন্তরীণ কোন্দলে যুদ্ধাবস্থায় রত। ছোট দেশ কসোভোর ৯০ ভাগ মুসলমান হয়েও হুমকির সম্মুখীন।

মুসলিম বিশ্বে একজন নেতা খুবই আবশ্যক। তুরস্কের রিজেপ তাইয়েব এরদোয়ান বাদে বিশ্ব মুসলিমদের স্বার্থে সোচ্চার এমন আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না।

পেছনে ফিরে দেখলে ১৯৬৭ সালে মাত্র ৬ দিনের যুদ্ধে ইসরাইলের কাছে জর্ডান, সিরিয়া, মিশরের শোচনীয় পরাজয় হয়। ইহা মুসলিম বিশ্বের ইতিহাসে চরম ব্যর্থতার পরাজয়ের স্মরণীয় ইতিহাসের মধ্যে অন্যতম।

এতে মনে করি অনেক দেশের নেতাগণ ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত পায়। তন্মধ্যে সৌদি আরবের বাদশাহ ফয়সল অন্যতম। অবশ্য এ সময় বাঘাবাঘা নেতার উত্থান ঘটে। তন্মধ্যে সৌদি আরব বাদে মিশরের আনোয়ার সাদাত, সিরিয়ার হাফেজ আল আসাদ, জর্ডানের বাদশাহ হোসেন, ইরাকের সাদ্দাম হোসেন, লিবিয়ার কর্ণেল গাদ্দাফি, আলজেরিয়ার বুমেদিন, মালয়েশিয়ার মাহাথির মুহাম্মদ অন্যতম।

১৯৬৭ সালের মাত্র ৬ দিনের এ যুদ্ধে মিশর প্রায় ৬০ হাজার বর্গকিলোমিটার সিনাই উপদ্বীপ হারিয়ে ফেলে চরম পরাজয়ের গ্লানি মাথায় নিয়ে। এতে মাত্র ৬ বছরের ব্যবধানে মিশর ১৯৭৩ সালে ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে। এই যুদ্ধে বাদশাহ ফয়সলের সমর্থন রয়েছে বলে প্রচার আছে। আমেরিকা সরাসরি হস্তক্ষেপ না করলে ইসরাইলের অস্তিত্ব টিকে থাকত কিনা বলা কঠিন। আমেরিকার হস্তক্ষেপে যুদ্ধ বিরতি হয়। ক্যাম ডেভিট চুক্তির মাধ্যমে আমেরিকা ইসরাইলকে বাধ্য করে বিশাল সিনাই উপদ্বীপ মিশরকে ছেড়ে দিতে। সুয়েজ খাল খুলে দেয়া হয়।

১৯৭৩ সালের এ যুদ্ধ থেকে বিশ্ব মুসলিম পর্যায়ক্রমে নেতৃত্ব শূন্য হতে থাকে। ১৯৭৫ সালে বাদশাহ ফয়সল ভ্রাতুষ্পুত্রের হাতে নিহত হন। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য নেতারাও হয়ত মৃত্যুবরণ বা সরে যেতে হয়।

বিশ্বে মুসলমানগণদের নানান প্রতিকূল অবস্থা চলমান। এমনি অবস্থায় তুরস্কের লৌহমানব এরদোয়ানের আবির্ভাবকে মুসলিম বিশ্ব খুবই আগ্রহ নিয়ে দূর থেকে ভালোবাসতে শুরু করে।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে মনে হয় আমরা বাংলাদেশীদের মাঝে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়। দেশের অনেক বেসরকারি টেলিভিশনের বাঘাবাঘা রিপোর্টাররা তুরস্কের নির্বাচন নিয়ে রিপোর্ট করেন। তৎমধ্যে একাধিক রিপোর্টার আমাদের দেশের তরুণদের মাঝে তুরস্কের নির্বাচন নিয়ে অত্যন্ত আগ্রহশীল বলে উল্লেখ করেন। আমি তাতে দ্বিমত। সব বয়সের মানুষের মাঝে তুরস্কের নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ। তিনি মুসলিম বিশ্বে অত্যধিক জনপ্রিয়। এরদোয়ানের জয় মানে ইসলামের জয়। তুরস্কের সুলতানগণ ৪/৫ শত বছর বিশ্ব শাসন করে বিদায় নিয়ে গেছেন। এরদোয়ান হারিয়ে যাওয়া সুলতানগণের প্রতিনিধি, বিশ্ব মুসলিমের নেতা। তার নেতৃত্বে বিশ্ব মুসলিম এগিয়ে আসবে। পশ্চিমা বিশ্বের বড় বড় সংবাদমাধ্যম তাঁর ব্যর্থতা, দুর্নীতি, স্বৈরাচারসহ অনেক কথা বলেছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

আমরা বাংলাদেশীরা এরদোয়ানকে ভালোবাসি। এরদোয়ান বিশ্ব মুসলিমের পাশাপাশি আমরা বাংলাদেশীদেরও ভালোবাসেন। ঢাকা গুলশানে তুরস্ক সরকার স্থায়ীভাবে দূতাবাস প্রতিষ্ঠা করে। রোহিঙ্গাদের প্রতি সহমর্মিতা দেখাতে এরদোয়ানের স্ত্রী এমিনি এরদোয়ান বাংলাদেশ সফর করেন। ঢাকাইস্তাম্বুল তার্কিস এয়ার দৈনিক ফ্লাইট চালু করে।

তুরস্কের সুলতানগণ ৪/৫ শত বছর পবিত্র মক্কা ও পবিত্র মদিনা শাসন করে গেছেন। সেই থেকে তুরস্কের সাথে এ দেশের ভ্রাতৃপ্রতিম সম্পর্ক। এদেশের অনেকে হজ্ব ও যেয়ারতের পর জেরুজালেম, ইরাক, কুফা, নজফ, কারবালা সফর করেন। লিখে যান গ্রন্থ। এসব গ্রন্থ এখনও অনেকের ঘরে সংরক্ষিত আছে। তুর্কি সুলতান আবদুল হামিদ দামেস্ক থেকে পবিত্র মদিনা ১৪৬৪ শত কি.মি রেল লাইন নির্মাণ করতে আর্থিক প্রতিকূলতায় এ দেশের ধনীরা অর্থ সম্পদ পাঠায়।

সেই সুলতানী আমল থেকে বাংলাদেশ ত বটেই চট্টগ্রামের সাথে তুরস্কের আলাদা যোগসূত্র ছিল। তার মূলে চট্টগ্রাম বন্দর। বিশাল তুর্কি সালতানাতের মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায় তাদের নিজস্ব শীপ ইয়ার্ড ছিল (মিশর তখন তুরস্কের নিয়ন্ত্রণে)। তুরস্কের সুলতানগণ চট্টগ্রাম শীপ ইয়ার্ড থেকে জাহাজ ক্রয় করে নিয়ে যেতেন। যেহেতু মোহরা কালুরঘাটের ঐ দিকে চট্টগ্রাম শীপ ইয়ার্ডে নির্মিত জাহাজের কাঠ, নির্মাণ প্রযুক্তি তথাকার থেকে মজবুত টেকসই মনে করতেন তুর্কি সুলতানগণ। এতে তুরস্কের জনগণ চট্টগ্রামে আসা, চট্টগ্রামের জনগণ তুরস্কে যাওয়াআসা করা অনেকটা স্বাভাবিক বলা যাবে। ১৪৫৩ সালে সুলতান ২য় মুহাম্মদ ইস্তাম্বুল জয় করেন। এতে পেছনের দিক দিয়ে আক্রমণের সুযোগ লাভের জন্য পাহাড়ের উপর দিয়ে ২ শতের কম বেশি নৌযান নেওয়া হয়েছিল। এ কথা চট্টগ্রামে ব্যাপক প্রচার লাভ করে। শুধু তাই নয়, চট্টগ্রামের বয়স্কজনের কাছে এ কথা হারিয়ে যায়নি। চট্টগ্রামের ভাষায় ‘চল্লুকর নৌকা পারদি চলে’ অর্থাৎ সেলজুকীয় তুর্কি সুলতানগণের নৌযান পাহাড়ের উপর দিয়ে চলতে পারে। চট্টগ্রামের কৃতি পুরুষ সালাহউদ্দিন কাশেম খান বিগত ৪০ বছর যাবৎ তুরস্কের অনারারী কনসাল জেনারেল। তুরস্ক বাংলাদেশকে মূল্যায়ন করে। বাংলাদেশের মধ্যে চট্টগ্রামকে আলাদা মূল্যায়ন করতে ইতস্তত করে না। তুরস্কের রাষ্ট্রদূত ঢাকায় দায়িত্ব নিয়ে চট্টগ্রাম সফরে আসলে তাঁর হাতে তুরস্কের উপর আমার রচিত গ্রন্থ দেয়া এবং চট্টগ্রামের সাথে তুরস্কের আলাদা ভ্রাতৃপ্রতীম সম্পর্ক আমার মুখ থেকে খুবই আগ্রহ নিয়ে মাননীয় রাষ্ট্রদূত জানতে বা শুনতে অনুভব করি।

এরদোয়ানের জয়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে খুশি। বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগণ খুশি। বাংলাদেশ ও তুরস্কের মাঝে ভ্রাতৃপ্রতীম সম্পর্ক আরও দৃঢ় হোক এ প্রত্যাশা রাখি। প্রায় ৮ লাখ বর্গকিলোমিটার এর দেশ বর্তমান তুরস্ক। জনসংখ্যা প্রায় ৮ কোটি। বর্তমান তুর্কিদের জীবনযাত্রা সুন্দর মসৃণ খুবই উন্নত। জীবনযাত্রা ব্যয়বহুল। আমারও পরপর ২ বার তুরস্ক গমনের সুযোগ হয়। ২০০৮ সালে তেহরান থেকে ইস্তাম্বুল গমন করা হয়। আংকারা হয়ে কোনিয়া, মার্সিন, আদানা, আসহাবে কাহাফ, তারসুস, গাজী এনটেব, উর্ফাসহ তুরস্কের অনেক স্থানে গমন করা হয়। ২য় বারও ২০১১ সালে তুরস্কে গমন করা হয়। নিজ বিবেচনায় হজ্ব ওমরাহ এর পর মুসলমানদের জীবনযাত্রা নিয়ে ধারণা লাভ করতে কয়েকটি দেশ সফর করা জরুরি মনে করি, তৎমধ্যে তুরস্ক অন্যতম।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ছয়দফা : বাঙালির রাজনৈতিক ইতিহাসের মুক্তির সনদ