সার্বভৌম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের বঙ্গীয় সংস্কৃতির মধ্যমণি, বাঙালির চির আদরের ধন, বহির্বিশ্বের নিকট বাঙালির সবচেয়ে গর্ব ও গৌরবের। তাঁর অসামান্য সৃষ্টিশীলতার বিস্ময়কর প্রাচুর্য ও ঐশ্বর্যের কাছে আমাদের মাথা নত হয়ে আসে। মাঝে মাঝে থমকে গিয়ে ভাবি, একই মানুষের ভিতর সৃজনী প্রতিভার এমন তাক লাগানো বহুমুখীনতা ও কাল্পনিকতার ক্ষমতার এমন হাঁফ ধরানো উচ্চুঙ্গতা কেমন করে সম্ভব হয়েছিল। শুধু সৃষ্টির বৈচিত্র্যে বা কল্পনার সমৃদ্ধিতো নয়, ওই বিচিত্র পথগামী সৃষ্টির আকুতি ও কল্পনার অজস্রতাকে যথোচিত ভাষার পরিচ্ছেদে ভূষিত করবার উপযুক্ত নিখুঁত প্রকাশ শৈলী, আঙ্গিক পরিপাট্য, ছন্দ মিলের অপূর্ব কারুকার্যই বা আয়ত্ত করলেন তিনি কোন জাদু প্রভাবে? সত্যি কথা বলতে কি, রবীন্দ্রনাথের এই প্রায় অবিশ্বাস্য অসাধারণ সৃষ্টি কুশলতার রহস্যের আজও পর্যন্ত সম্ভবত আমরা সঠিক মীমাংসা করতে পারিনি।
রবীন্দ্রনাথ কবি- স্রষ্টা এবং দ্রষ্টা, সুতরাং ঋষি, কবি এবং ঋষিদের পরিচয় তাঁদের বাণীমুখেই এক যুগ হতে অন্য যুগে প্রচারিত হয়-এর জন্য তাঁদের কাব্য ও বাণী ছাড়া অন্য আয়োজনের আবশ্যক করে না।
বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে তাঁর প্রথম আবির্ভাব কবি হিসেবে ঘটলেও পৃথিবী তাঁকে পর্যবেক্ষণ ও অনুধাবন করেছে দার্শনিক, ভাবুক ও চিন্তক বলে। রবীন্দ্রনাথের কাব্যশিল্প আমাদের সামনে এক বিভান্বিত অলৌকিকের দরজা খুলে দেয়। আমরা তাঁর কবিতা ও গানের হাত ধরে এমন এক অন্দর মহলে প্রবেশ করি, সেখানে কি আছে এবং কি নেই তা নিজেকেই শনাক্ত করে নিতে হয় নিজের শিল্প রসবোধ ও অনুভব শক্তি দিয়ে। বাংলা ভাষার অনেক শাখায় তাঁর অনন্য দান অকৃপণ হাতে ঐশ্বর্য দান করেছেন এবং বিশ্বদরবারে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
রবীন্দ্রনাথ কি শুধুই রোমান্টিক কবি! এই রোমান্টিক অভিধাটি ততটা দায়ী নয়-যতটা তার ক্ষেত্রে ইউরোপীয় প্রয়োগ। রোমান্টিক কবি কল্পনার জগতে বিচরণ করেন- প্রেম ও সৌন্দর্যের চিন্ময় প্রকাশগুলো খোঁজেন জীবনে ও কবিতায়। রবীন্দ্রনাথ রোমান্টিক ছিলেন তাঁর কল্পনা শক্তির জন্য- কিন্তু বাস্তবের উপস্থিতি ছিল। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় ভাববাদ এবং মরমীবাদের একটা ঐতিহ্য ছিল সাথে অন্যান্য অনেক ঐতিহ্যের সাথে যেমন মৌলিকত্ব, কল্পনা প্রতিভা, আবেগানুভূতি। তাঁর কবিতার বৈচিত্র্য ও মানবিকতার মূলে রয়েছে বিচিত্র ধরনের কথকের উপস্থিতি-কখনো নির্ঝর, কখনো চাষি, অজস্রবার ব্যথিত নারী এবং আরও বেশি কিছু। যতোই বয়স বেড়েছে, ততই তিনি এর ওপর বিছিয়ে দিয়েছেন হৃদয়ের আবরণ। যেমন পাই গানে, যেখানে পুজো হয়ে ওঠে প্রেম, প্রেম হয়ে ওঠে পুজো-মনে হয় পুজোই তাঁর শ্রেষ্ঠ আবেগ। এই মহান কবি জাতির জন্য রেখে গেছেন অসীমাবদ্ধতার স্বাদ, স্বপ্ন-কল্পনা, প্রেম, সুর, মহত্ত্ব, অজানা ফুলের স্বাদ কি নয়-সৃষ্টি করে গেছেন এক অভিনব ভাষা, তার শব্দ ও বাক্যকে করেছেন জ্যোতির্ময়, নাচিয়েছেন ছন্দে সাজিয়েছেন অপূর্ব অলঙ্কারে-তাঁর কবিতা পড়তে পড়তে মনে হয় ধন্য হয়ে যায় ভোর, দুপুর, সন্ধ্যা রাত-মেঘ শিউলি, জোৎস্না-অন্ধকার প্রতিটি মুহূর্ত-প্রতিটি তুচ্ছ বস্তু নির্ঝরের স্বপ্ন ভঙ্গ, স্বপ্ন, পুরস্কার, বিদায়-অভিশাপ, মানস সুন্দরী, এবার ফিরাও মোরে, নিরুদ্দেশ মাত্রা, বিদায় অভিশাপ-যাত্রা-ভঙ্গ-সাধারণ মেয়ে, বাঁশীওয়ালা-ইত্যাদি।
তিনি কবিদের রাজা। আমাদের দুঃখের-সুখের আনন্দের-বেদনার আশ্রয়-মনে দাগ কেটে যায়-পৌরানিক এক পুরুষকে মনে রেখে তিনি একবার প্রশ্ন করেছিলেন, “কে পেয়েছে-সবচেয়ে কে দিয়েছে তাহার অধিক!”
রবীন্দ্রনাথের স্বর্ণখচিত দিক হলো রবীন্দ্র সঙ্গীত। এখানে তিনি এক বিশাল উচ্চতার অধিকারী-অনন্ত আকাশের মতো অসীমতার প্রতীক। গানের সংখ্যা ১৯শ ১৫টি হলেও এ সব গানের ভাব, ভাষা, কথা, সুর; বিষয়ের বিচিত্রতা সর্বহৃদয় স্পর্শী-কথাও সুর এবং বোধ বিন্যাসে তা অতলান্ত সমুদ্র গভীর-সুরকে সেধে তিনি গানকে বেঁধেছেন আপন ঘনিষ্ঠতায় গান গেয়েছেন, শুনিয়েছেন, কথা ও সুরের ইন্দ্রজালে মজেছেন ভেসেছেন ভাসিয়ে কাঁদিয়ে-এক অনন্য অসামান্য সৃষ্টি সুখের উল্লাসে ভেসে চলা স্বপ্ন সারথী থেকে বাস্তবের মহারাজা তিনি।
গীতাঞ্জলির কবি তিনি-যা, তার জন্য ১৯১৩ সনে এনেছিল নোবেল প্রাইজের স্বীকৃতি ও সম্মান। তাঁর গানের প্রথম পর্ব ১৮৮১ সাল পর্যন্ত এবং ১৮৮১-১৯০১ পর্যন্ত দ্বিতীয় পর্যায়ের বিশ বছরে বলা যায়-কম্পোজার। এক দশকের মতো সময় রবীন্দ্রনাথ পূর্ব ও উত্তর বঙ্গে লোকগানের আবহাওয়ায় অতিবাহিত করেছেন-তার পরিভাষায় বাউল গানের।
১৯০১ সাল থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত এ শতাব্দীর শুরু থেকেই রবীন্দ্রনাথের যুগপৎ কাব্য ধারার ও সংগীত ধারার সুপরিণত রূপটির প্রকাশ শুরু হয়ে যায়-একদিকে আশ্রমের জন্য গান-অন্যদিকে বহুমুখী সাহিত্য কর্মের প্রেরণা-এক দিকে নৈবদ্য, স্মরণ, শিশু, উৎসর্গ, খেয়া গীতাঞ্জলি ও গীতি মাল্য-বৈতালিক, গীতিনিকা ইত্যাদি স্বরলিপি গ্রন্থগুলো রবীন্দ্রসুরের কৃতি ও রীতি-১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন রবীন্দ্রনাথের কিছু গানে বোঝা যায় লোকসংগীতের ব্যবহার।
রবীন্দ্রনাথের গানের সম্পূর্ণরূপের পরিপূর্ণ পর্যায় ধরা হয় তাঁর কম্পোজর জীবনের শেষ পর্বটিকে। তাত্ত্বিক গানের মতে ভাবদ্যোতক । রাগরাগীনি ও কাব্যরসের আরেক ধরনের গঙ্গা-যমুনা সঙ্গম। সংগীত জহুরি ধূর্জটি প্রসাদ বলেন- এ পর্যায়ের গানগুলি সম্পূর্ণ ইস্থেটিক কিংবা রূপাকূল। রবীন্দ্রনাথের গানের নিজস্ব জগৎ যে হিন্দি-ইংরেজি ও লৌকিক সঙ্গীতের ত্রিবেণী সঙ্গমে গড়ে উঠেছিল- তা ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী প্রমুখের লেখনীর সূত্রে সর্বজন বিদিত এই তিন প্রভাব মিলিয়ে তিনি সৃষ্টি করলেন-অতিক্রিয় এক নতুন পরিচিতি-গানের সেই নতুন অস্তিত্বটির নামই রবীন্দ্রগান বা তাঁর নিজের সংগীতের ‘বন্দিশ’ যেটি তৈরি হয়ে আপন মনে নিজের স্রোতেই বয়ে চলেছিল কবির মনের ভেতর।
১৯২৬ সালে জোড়া সাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে রবীন্দ্র মানসে এক নতুন উৎসের জোয়ার নটীর পুজার নাটকে তাঁর অভিনয়। এরপরে রবীন্দ্র গানের শেষ পালাবদল-ঋতু নাট্য থেকে।
রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি শ্রাব্যকাব্য থেকে সরে দৃশ্য কাব্যে মানে নাট্যে-যে দৃশ্য কাব্যকে সুন্দর করে তোলে নৃত্য-চমৎকার তাল আর ছন্দ সহকারে। সময়ে কবির এক শ্রেণীর গান বিশেষভাবে নৃত্যাশ্রয়ী হয়ে ওঠে, গীত নাট্য রূপান্তরিত হয় নৃত্যনাট্যে- নৃত্যও হয়ে ওঠে সংগীতাপেক্ষী। রবীন্দ্রনাথ আধুনিক ছোটগল্পের প্রবক্তা-গল্পগুচ্ছের জীবন দর্শন শিল্পিত হয়ে ওঠে চরিত্র-চিত্রের গভীরতায় বিস্তৃতি ও সুর সমূহে পারস্পরিক সংযোগ প্রক্রিয়ায়, বিন্যাস প্রতি বিন্যাসের সূক্ষ্মতায় বিপ্রতীপ গতির সম্বন্ধ সূত্রে ছোট গল্পে রবীন্দ্র শিল্প দৃষ্টির অন্তরঙ্গ মোটিকে অর্থাৎ উপাদান ও প্রকরণগত তন্ময় নির্জন বৈশিষ্ট্য হল মানুষের কোন সমস্যা বিদীর্ণ মুহূর্ত, যন্ত্রণা জর্জর অনুভূতি, তীক্ষ্ণমুখ বেদনাবেগ ইত্যাদিকে গল্পের পটভূমির আবেগ ও চলমানতার বিপরীতে নিশ্চলভাবে সংশ্লিষ্ট করে তাকে একটি স্তব্ধ পরিমন্ডলে প্রগাঢ় করে তোলা।
উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ মধ্যবিত্তের নাগরিক জীবনকে প্রাধান্য দিয়েছেন-ঘটনা ভিত্তির পর চরিত্র ভিত্তি দান করাই তাঁর অবদান। মনো বিশ্লেষণ, উপন্যাসের বিবৃতি ও কথন ব্যক্তির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার, নারীর আত্মমর্যাদা, দেশ প্রেম যেমন এসেছে তেমনি ধাপে ধাপে তার উপন্যাসের পালাবদলও হয়েছে। ছিন্নপত্রে রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত সহজ সরল ভাষায় নদী ও মানুষের কথা বলেছেন- জীবনের পটভূমিতে নদীর গ্রহণযোগ্যতাকে দেখিয়েছেন মানুষের জীবনের সমান্তরাল হিসেবে। বাংলাদেশের শিলাইদহ- পতিসর শাহজাদপুর এলাকায় যখন তিনি কাটিয়েছেন অনেকগুলো বছর তখন পদ্মাকে ভেবেছেন এক স্বতন্ত্র মানুষের মতো। এ ভূখণ্ডের মানুষকে নিয়ে তার ভাবনার অন্ত ছিলনা। প্রজাদরদী কবি কৃষকদের নিয়ে সমবায় বা গ্রাম উন্নয়ন নিয়ে ভেবেছেন। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিশীলতার ছাপ কোথায় নেই! তাঁর মননশীল বিভিন্ন প্রবন্ধে বারে বারে সমাজের সংকট বা সভ্যতার অভিশাপ এবং মানুষের কল্যাণ নিয়ে ভেবেছেন-শিক্ষা চর্চার ইতিহাসেও তিনি চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। আনন্দলাভের শিক্ষার একটি আবশ্যকীয় শর্ত হিসেবে শান্তি নিকেতনে এক আনন্দ নিকেতন গড়ে তুলেছেন-শিক্ষা চর্চার ইতিহাসেও তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ বিশ্বমুখী অন্তর্দৃষ্টি থাকলেও তাঁর চিন্তা চেতনার উৎসে ছিল মানব ধর্ম ও মানব সভ্যতা। অশিক্ষা, ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার, জাতিভেদ এগুলোকে উচ্ছেদ করে মানব সভ্যতার কথা বলেছেন তিনি।
লেখক : সাহিত্যিক; সাবেক অধ্যক্ষ, আগ্রাবাদ মহিলা কলেজ