রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট মানবসেবায় অনন্য

ডা. শেখ শফিউল আজম | রবিবার , ৮ মে, ২০২২ at ১০:৪৫ পূর্বাহ্ণ

যে সকল মানুষ তাদের ব্যক্তিত্ব, কৃতিত্ব ও কর্মপন্থা দিয়ে ইতিহাসের পাতায় নিজের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখে রেখে যেতে সক্ষম হয়েছেন জিন হেনরি ডুনান্ট তাদের মধ্যে অন্যতম। রেড ক্রস রেড ক্রিসেন্ট আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা জিন হেনরি ডুনান্ট এর জন্ম ১৮২৮ সালের ৮ই মে সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরের রু-ভারদেইনি নামক স্থানের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। পিতা জিন জ্যাকুয়াস ডুনান্ট ছিলেন স্বনামধন্য ব্যবসায়ী ও একজন সক্রিয় সমাজকর্মী। মা এন্টো ইনেট ডুনান্ট ছিলেন একজন উদারনৈতিক চরিত্রের ধার্মিক মহিলা। ডুনান্টের চরিত্র গঠনে তার মায়ের ছিল প্রভাব অপরিসীম।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কোনো প্রকার ভেদাভেদ ছাড়া যুদ্ধ ক্ষেত্রে আহতদের সাহায্য, যে কোন স্থানে মানুষের দুঃখ-দুর্দশা উপশম প্রতিকার করার উদ্দেশ্য থেকেই রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্টের সৃষ্টি। রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট আন্দোলন জাতি, উপজাতি, ধর্মীয় বিশ্বাস, শ্রেণি কিংবা রাজনৈতিক বিশ্বাসে কোন প্রকার বৈষম্যের সৃষ্টি করে না। একমাত্র প্রয়োজনের তাগিদে ব্যক্তির যন্ত্রণা দূর করা এবং জরুরি অবস্থায় বিশেষ দুর্দশাগ্রস্তের সেবায় অগ্রাধিকার দানের প্রচেষ্টা চালায়। বিশ্বব্যাপী এর রয়েছে সার্বজনীন স্বীকৃত নিরপেক্ষ গ্রহণযোগ্যতা। যা সংগঠনের কার্যক্রমকে আরো গতিশীল করে তুলেছে।

জিন হেনরি ডুনান্টের বাল্যশিক্ষা শুরু হয় অন্য শিশুদের তুলনায় বেশ আগে। মানবিক মূল্যবোধের দীক্ষাও নেন অতি অল্প বয়সে। একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান হিসেবে তিনি কৈশোরেই নিজের ভূমিকা সুস্পষ্ট করেন। বালক ডুনান্ট ফ্রান্সের সমুদ্র নগরী টুলন ভ্রমণে গিয়ে পরিদর্শন করেন সেখানকার জেলখানা। দেখতে পান বন্দিদের নানা দুর্দশা, অনুভব করেন বন্দিত্বের কষ্ট। সহানুভূতিশীল ডুনান্ট এরপর নিয়মিত জেলখানায় যেতেন এবং বন্দিদের চিঠি লেখা দেয়াসহ বিভিন্ন রকম সাহায্য সহযোগিতা করতেন।

১৮ বছর বয়সে জিন হেনরি ডুনান্ট Geneva Society for Alms Giving নামক একটি সেবা সংগঠনে যোগ দেন। একই বছর বন্ধুদের নিয়ে গঠন করেন Thursday Association নামে একটি সেবা সংস্থা। ব্যাংকিং ব্যবসা শেখার জন্য শিক্ষানবিশ হিসেবে মুদ্রা বিনিময়কারী প্রতিষ্ঠান Lullinet Sautter-এ যোগ দেন ১৮৪৯ সালে। এর সফল পরিসমাপ্তির পর তিনি একজন ব্যাংকার হিসেবে আত্নপ্রকাশ করেন। ১৮৫২ সালে ৩০শে নভেম্বর প্রতিষ্ঠা করেন Young Men’s Christian Association (YMCA) এর জেনেভা শাখা এবং তারই প্রচেষ্টায় প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয় এই সংগঠনের প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন।

জিন হেনরি ডুনান্ট ১৮৫৩ সালে Colonies Suiss de Setif নামক একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হয়ে আলজেরিয়া, তিউনিশিয়া এবং সিসিলি ভ্রমণ করেন। এই সফরের অভিজ্ঞতা ১৮৫৮ সালে তিনি প্রকাশ করেন তার প্রথম বই “An Account of the Regency in Tunis.” ১৮৫৬ সালে ডুনান্ট ফ্রান্সের উপনিবেশ আলজেরিয়ায় একটি ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু জমির দখল নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হওয়ায় ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতায় কিছুটা বাধাগ্রস্ত হন। তিনি সিদ্ধান্ত নেন ফ্রান্সের সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়নের সাথে দেখা করে তার সাহায্য কামনা করবেন। পরবর্তীকালে সম্রাটের সাথে দেখা করতে এসে তিনি সলফেরিনো যুদ্ধের বিভীষিকাময় করুণ পরিণতির সম্মুখীন হন। এই যুদ্ধের ভয়াবহ স্মৃতি তুলে ধরে ১৮৬২ সালে ডুনান্ট প্রকাশ করেন তার বিখ্যাত বই “A Memory of Solferino”. এই বইয়ে তিনি বিশ্বের সকল সচেতন নাগরিকের প্রতি আবেদন জানিয়ে বলেন “আমরা কি পারি না প্রতিটি দেশে এমন একটি সেবা সংগঠন গঠন করতে যা শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সকল যুদ্ধাহতের সেবা করবে?” ডুনান্টের আহ্বানে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসেন সমাজের নানা স্তরের মানুষ। গঠিত হয় আজকের রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট আন্দোলনের ভিত্তি। অনুষ্ঠিত হয় প্রথম জেনেভা কনভেনশন। সৃষ্টি হয় আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের।

১৮৬৭ সালে Credit Genevois নামে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান তার নামে দেউলিয়াত্বের অভিযোগ আনে। তখন তার বয়স মাত্র ৩৯ বছর। ১৮৮৭ সালে জুলাই মাসে ৫৯ বছর বয়সে জিন হেনরি ডুনান্ট ফিরে আসেন নিজ দেশের হেইডেন শহরে। ১৮৯২ সালের ৩০শে এপ্রিল ৬৪ বছর বয়সে দীর্ঘ পথপরিক্রমা ও বয়সের ভারে দূর্বল শরীর নিয়ে তিনি ভর্তি হন একটি নার্সিং হোমে এবং জীবনের শেষ ১৮ বছর এখানেই চিকিৎসাধীন ছিলেন। ১৮৯৫ সালে হেইডেন শহরে ভ্রমণে আসা এক সাংবাদিক ডুনান্টের সাক্ষাৎকার নেন এবং ফিরে গিয়ে Die Ostchweiz পত্রিকায় “Henri Dunant, the founder of the Red Cross” শিরোনামে একটি কলাম লেখেন। বিশ্ব শান্তি ও মানবিক আন্দোলন প্রতিষ্ঠায় অনন্য ভূমিকা রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে ১৯০১ সালে চবধপব খবধমঁব প্রতিষ্ঠাতা ফ্রেডারিক পেসির সাথে যৌথভাবে শান্তির জন্য প্রবর্তিত প্রথম নোবেল পুরস্কারে অলংকৃত করা হয়। এরপর ১৯০৩ সালে হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল ফ্যাকাল্টি তাকে সম্মানজনক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে। ১৯১০ সালের ৩০শে অক্টোবর ৮৩ বছর বয়সে লাখো মানুষের বেদনা আর ভালোবাসার মধ্যে দিয়ে জিন হেনরি ডুনান্ট চলে গেলেন অমৃতলোকে।

যেভাবে জন্ম হয় রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট : ১৮৫৯ সালের ২৪শে জুন উত্তর ইতালির সলফেরিনো নামক স্থানে ফ্রান্স ও অষ্ট্রিয়ার মধ্যে এক ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে প্রায় চল্লিশ হাজার সৈন্য হতাহত হয়। আহত সৈন্যরা বিনা চিকিৎসায় যুদ্ধক্ষেত্রেই মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছিল। সেই সময় সুইজারল্যান্ডের এক যুবক জিন হেনরি ডুনান্ট ব্যবসা সংক্রান্ত ব্যাপারে ফ্রান্সের সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়নের সাথে সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রের এই মর্মান্তিক দৃশ্য দেথে তিনি ব্যথিত হন এবং তিনি আশেপাশের গ্রামবাসীকে ডেকে এনে আহতদের তাৎক্ষণিক সেবা ও প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাদের জীবন রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এরাই রেড ক্রসের প্রথম স্বেচ্ছাসেবক, যাদের অধিকাংশ ছিলেন মহিলা। ডুনান্ট এই যুদ্ধের ভয়াবহ ও বিভীষিকাময় স্মৃতি ও তার প্রতিকারের জন্য ১৮৬২ সালে “এ মেমোরি অব সলফেরিনো” নামে একটি বই রচনা করেন। বইটির মূল কথা ছিল “আমরা কি পারি না প্রতিটি দেশে এমন একটি সেবা সংগঠন গঠন করতে যা শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সকল যুদ্ধাহতদের সেবা করবে?” ১৮৬৩ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি জিন হেনরি ডুনান্ট চারজন জেনেভাবাসীকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেন, যা “কমিটি অব ফাইভ” নামে পরিচিত। পরবর্তীতে এই কমিটির নাম পরিবর্তিত হয়ে আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটি নামে পরিচিত হয়। একই বছর এই কমিটি ১৬টি দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে জেনেভায় আন্তর্জাতিক সম্মেলন আহ্বান করে। সম্মেলনে ডুনান্টের মহতি প্রস্তাবগুলো গৃহীত হয় এবং তারই পরিপ্রেক্ষিতে রেড ক্রস জন্ম লাভ করে। ১৯৪৮ সালের ৮ই মে রেড ক্রসের প্রতিষ্ঠাতা জিন হেনরি ডুনান্টের জন্মবার্ষিকীতে সারা বিশ্বে প্রথমবারের মত রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট দিবস পালন করা হয়। ১৯৮৪ সাল থেকে দিনটি “বিশ্ব রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট দিবস” হিসেবে উদযাপন হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট আন্দোলনের মূলনীতি : আন্তর্জাতিক রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট আন্দোলনের মূলনীতি ৭টি। যথাঃ ১.মানবতা, ২.পক্ষপাতহীনতা, ৩.নিরপেক্ষতা, ৪.স্বাধীনতা, ৫. স্বেচ্ছামূলক সেবা, ৬.একতা, ৭.সার্বজনীনতা। ১৯৬৫ সালের অক্টোবরে ভিয়েনায় অনুষ্ঠিত ২০তম আন্তর্জাতিক রেড ক্রস সম্মেলনে রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট আন্দোলনের মূলনীতিসমূহ গৃহীত হয় এবং ১৯৮৬ সালে ২৫তম আন্তর্জাতিক রেড ক্রস সম্মেলনে মূলনীতিসমূহ সংগঠনের সংঘবিধিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট সেবা কার্যক্রমের অন্যান্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে কোভিড-১৯ কার্যক্রম। করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে মাঠে থেকে প্রতিরোধ করার জন্য কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে। কোভিডে জীবাণুনাশক স্প্রে করণ কার্যক্রম, হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি, রান্না করা খাবার বিতরণ, ফুড প্যাকেজ বিতরণ, সবজি বিতরণ, পানীয় বিতরণ ও শুধু তাই নয় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কোভিড- নন কোভিড রোগীদের অক্সিজেন সেবা প্রদান করা হয়েছে। ফ্লু কর্ণার ও ইনভেস্টিগেশন সেল কার্যক্রমে নন কোভিড রোগীদের বিনামূল্যে ঔষধ বিতরণের মাধ্যমে সেবা পরিচালনা করা হয়।

রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট কোন প্রকার পক্ষপাতিত্ব করে না। অথবা জাতিগত, আদর্শগত, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কোন প্রকার মতবিরোধে সামিল হয় না। এটি মানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করার জন্য অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে জন্ম লগ্ন থেকেই। এটি একটি মানবসেবী সংগঠন।

লেখক : চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত), বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, চট্টগ্রাম জেলা ইউনিট ও ব্যবস্থাপনা পর্ষদ সদস্যবাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধরবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিশীলতা