স্মরণের আবরণে এডভোকেট আজিজুল হক চৌধুরী

মমতাজ আলী খান | শুক্রবার , ২৮ মে, ২০২১ at ৭:০৩ পূর্বাহ্ণ

বর্তমান প্রজন্মের এই সময়ে হাজার ব্যস্ততম কাজের মাঝে কিছু কিছু প্রিয় মানুষের কথা স্মৃতির অতলে হারিয়ে গেলেও আবার তা ভেসে উঠে। কারণ এইসব ব্যক্তি তাদের ব্যক্তিগত জীবনের পেশা ও সুখ স্বাচ্ছন্দের চেয়ে সমাজের সাধারণ মানুষের উপকারার্থে অনেক ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকার করতে ভালোবাসেন। জনাব আজিজুল হক চৌধুরী এমনি এক ব্যক্তিত্ব যিনি আইন পেশায় নিয়োজিত থাকলেও সমাজের সাধারণ মানুষের কল্যাণে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন।
সরকারি চাকরির কারণে লালখানবাজার ম্যাজিস্ট্রেট কলোনীতে সরকারি বাসভবনে বসবাস করতাম এবং জামিয়তুল ফালাহ্‌ মসজিদে নামাজ আদায় করতাম। ১৯৯৭ সালে মে মাসের প্রথম দিকে জুমা’র নামাজ শেষে মসজিদ থেকে ফেরার পথে দেখলাম জমিয়তুল ফালাহ্‌ মসজিদের গেটের আগেই গাছতলায় জনাব আজিজুল হক চৌধুরী দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে দেখে ইশারায় কাছে ডাকলেন। উনি বিবর্ণ মুখে আমাকে বললেন ‘আমি কালকেই আমেরিকা চলে যাচ্ছি, আমার হার্টের অসুখ চিকিৎসা করাতে হবে’। ভাবলাম আর দেখা হবে কিনা সে কারণেই আপনার সঙ্গে কথা বলার জন্য দাঁড়িয়ে আছি। আমাকে বুকে টেনে জড়িয়ে ধরে বললেন, আমার জন্য দোয়া করবেন।
পরে তার গাড়িতে করেই ম্যাজিস্ট্রেট কলোনীর বাসায় আমাকে নামিয়ে দিলেন। সে’ই আমার শেষ দেখা, শেষ কথা। এরপর একদিন খবর পেলাম এডভোকেট আজিজুল হক চৌধুরী আর নেই। চোখের কোণ বেয়ে পানি নেমে এলো।
এডভোকেট আজিজুল হক চৌধুরী এমন একজন ব্যক্তিত্ব যার প্রশংসা বরাবরই করতে হয়। ১৯২৭ সালে ১৫ই ফেব্রুয়ারি সীতাকুন্ডের বাঁশবাড়িয়ার এক সম্রান্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। ১৯৫৩ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে আইন বিষয়ে স্নাতক পাস করে চট্টগ্রাম আইজীবী সমিতিতে যোগদান করেন। সেই সময়ে ১৯৬২ সালে প্রখ্যাত আইনজীবী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মরহুম এস আর কায়ানির মত ব্যক্তির সঙ্গে তার ছিল আন্তরিক সম্পর্ক। আজিজুল হক চৌধুরী আইনজীবী হিসেবে নিয়োজিত থাকলেও বরাবর তার লক্ষ্য ছিল বিভিন্ন সেবার্ধমী কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত থাকা। চট্টগ্রামে স্থায়ীভাবে আইনজীবী হিসেবে নিয়োজিত থাকাকালীন তিনি ঞযব ইধংরপ চযরষড়ংড়ঢ়যু ড়ভ ষরভব রং ংবৎারপব ঃড় যঁসধহরঃু এই আদর্শে বিশ্বাস করতেন এবং মেহনতি মানুষের সেবায় তিনি আত্মনিয়োগ করেন। আইনজীবী পেশার শুরুতেই সমুদ্রগামী জাহাজী শ্রমিকদের সংগঠনে বিশেষভাবে জড়িত হন। জাহাজী শ্রমিকদের সংগঠন না থাকায় তাদের অধিকার আদায়ে তারা বরাবর ছিল অবহেলিত। এডভোকেট আজিজুল হক চৌধুরী এসব জাহাজি শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।
১৯৬৫ সালে টৌকিও জাপানের আই.এম.ও মেরিটাইমস কনফারেন্সে সমুদ্রগামী শ্রমিকদের সাংগঠনিকভাবে প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৬৮ সনে ডেনমার্কে আই.এম.ও’র মেরিটাইমস সেমিনারে যোগদান করেন। এডভোকেট আজিজুল হক চৌধুরী উত্তর জেলা আওয়ামীলীগ আইন বিষয়ক পদে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং ত্রিপুরাস্থ হরিণা যুব ক্যাম্পে প্রধান রাজনৈতিক উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন এবং অক্টোবর মাসে প্রত্যক্ষ মু্‌ক্িতযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭৪ সালে ডিউফ অব এডিনভরা কর্তৃক ‘ইন্ডাস্ট্রি ইন সোসাইটি’ সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়ে রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ কর্তৃক রাজপ্রসাদে গার্ডেন পার্টিতে বিশেষ অতিথি হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন। ১৯৭৬, ১৯৭৭,১৯৭৮ সনে এথেন্স, অস্ট্রেলিয়া, মিশর ও যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। ১৯৮৩, ১৯৮৪ সনে তদানীন্তন রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি পরিচালনা পর্যায়ে সদস্য হিসেবে জেনেভা ও অসলোতে রেড ক্রিসেন্ট সোসাটির প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৮৫ সনে ইউ.এস.এইড এর পরিকল্পিত পারিবারিক কর্মসূচিতে ফিলিপাইন, কোরিয়া, হংকং এবং ব্যাংককে পরিবার পরিকল্পনা সমিতি’র প্রতিনিধিত্ব করেন।
এছাড়াও জাতীয় যক্ষা নিরোধ সমিতির (নাটাব), বাংলাদেশ অন্ধ কল্যাণ সমিতি, বাংলাদেশ ডায়াবেটিস সমিতি, বাংলাদেশ কিডনি ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল চট্টগ্রামের কার্যক্রমে অন্যতম সদস্য হিসেবে ভূমিকা রাখেন।
১৯৮৫ সালের ২৯ এপ্রিলের মহাপ্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের পরেই এডভোকেট আজিজুল হক চৌধুরী ঘরে বসে থাকেননি। দুর্যোগ এর পরে তিনি রেডক্রিসেন্টের ত্রাণ সহায়তা প্রদানের কাজে সন্দ্বীপ পৌঁছে যান এবং আবহাওয়া অফিসের বিল্ডিং এ অবস্থান নেন। সেই সময় তার সঙ্গে ছিলেন সন্দ্বীপের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব রফিক উল্লাহ চৌধুরী। বেতার প্রচার কার্যক্রমে এই সময় আমিও সন্দ্বীপে অবস্থান করি এবং উড়িরচরে ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত এলাকায় কিভাবে যাব সেই প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আমার সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র জগতের চিত্রগ্রাহক জনাব উত্তম গুহ। আমাকে দেখে এডভোকেট আজিজুল হক চৌধুরী বললেন এই দুর্যোগ মুহূর্তে আপনি কিভাবে উড়িরচর যাবেন, আমি বুঝতে পারছিনা। আমার মন তো সায় দিচ্ছে না। তারপরও যদি যান প্লিজ টেক কেয়ার অব ইউ। আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম এই মহাদুর্যোগের সময় এডভোকেট আজিজুল হক চৌধুরী কিভাবে সন্দ্বীপে পৌঁছলেন।
পরে আমি নৌবাহিনীর গান বোট এর মাধ্যমে উড়িরচর পৌঁছি। উড়িরচরের ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র গ্রহণ ও সাক্ষাতকার গ্রহণ করি। সেই সময় উড়িরচরের ঘূর্ণি বিধ্বস্ত জনপদে আসেন শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট মি. জয়বর্ধন (প্রায়াত) আরো আসেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক।
তৎকালীন চট্টগ্রামের জি.ও.সি মেজর জেনালের নুরুদ্দীন খান সাহেবের আন্তরিক সহযোগিতায় হেলিকপ্টারে করে চট্টগ্রামে ফিরে আসি। ঘূর্ণিঝড়ের যাবতীয় কার্যক্রম সরেজমিনে বাংলাদেশ বেতার ও বহিঃবিশ্বের বেতারে প্রচার করি। পরদিন এডভোকেট আজিজুল হক চৌধুরী আমার ফিরে আসার সংবাদ জানালে তিনি অত্যন্ত উদ্বেগ এর সঙ্গে বলেন “আলহামদুল্লিলাহ আপনি ফিরে এসেছেন। আমি খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম”।
১৯৮৭ সালে খুব সম্ভব কঙবাজার টাউন হলে জেলা পর্যায়ে পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক একটি সেমিনার ছিল। সেই অনুষ্ঠানেও এডভোকেট আজিজুল হক চৌধুরী ও আমি উপস্থিত ছিলাম। অনুষ্ঠান শুরুর আগেই কঙবাজারের প্রখ্যাত আইনজীবী জনাব ফিরোজ মিয়া (প্রয়াত) অনুষ্ঠানে এসে বললেন, আমি অসুস্থ, তারপরও আমি এসেছি শুধুমাত্র জনাব আজিজুল হক চৌধুরীর বক্তব্য শোনার জন্য। এডভোকেট আজিজুল হক চৌধুরী কত বড় বক্তা ছিলেন সেকথা এখন বলে শেষ করা যাবে না।
এমনি একটি ঘটনা তিনি আমাকে বলেছেন যে, তিনি চট্টগ্রামে বাস করলেও বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতির কেন্দ্রীয় কার্যক্রমের সঙ্গে ছিলেন ওতোপ্রতভাবে জড়িত। একবার তিনি ভারতের কয়েকটি রাজ্যে পরিবার পরিকল্পনা সমিতির উপর তার একটি গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন এবং বেশ কয়েকদিন ভারত ভ্রমণ শেষ ঢাকায় ফিরে আসেন। ঢাকায় এলে জনাব আলমগীর কবির চৌধুরী বলেন, চৌধুরী সাহেব ভারত তো ঘুরে এলেন এবার একটু পাকিস্তান যেতে হবে। ওখানে একটি বড় সেমিনার রয়েছে। এডভোকেট আজিজুল হক চৌধুরী বিনয়ের সঙ্গে বলেন ‘আমি বেশ দুর্বলবোধ করছি আমার পক্ষে পাকিস্তান যাওয়া সম্ভব হবে না, দয়া করে অন্য কাউকে নির্বাচন করুন’। তখন আলমগীর কবির সাহেব ব্যক্তিগতভাবে চৌধুরী সাহেবকে পুনরায় অনুরোধ করেন। শেষে আজিজুল হক চৌধুরী চট্টগ্রামে ফিরে এসে একদিন পর আবার পাকিস্তানের রাওয়াল পিন্ডিতে অনুষ্ঠিত পরিবার পরিকল্পনা সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন এবং বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতির কার্যক্রম তুলে ধরেন। জনাব চৌধুরী’র বক্তব্য যারা শুনেছেন, তারাই জানেন তিনি এত সুন্দর সাবলীল চমৎকারভাবে কি বাংলা, কি ইংরেজি তথ্য উপাত্ত দিয়ে তিনি বক্তব্য রাখতেন।
দুনিয়ায় চিরকাল কেউ থাকে না। এডভোকেট আজিজুল হক চৌধুরীও দুনিয়া থেকে চলে গেছেন। বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতির সকল কার্যক্রমে দেশে এবং বিদেশে তিনি ছুটে বেরিয়েছেন। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের উন্নয়নে তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন। নিজ গ্রাম বাঁশবাড়িয়ায় পরিকল্পিত পরিবার গঠন ও দারিদ্র বিমোচনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন এবং সেই সাথে তার গ্রামে একটি আদর্শ পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন।
এডভোকেট আজিজুল হক চৌধুরী তার জীবদ্দশায় ছিলেন একজন উন্নয়ন কর্মী। দরিদ্র মানুষের সেবাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। রেডক্রিসেন্ট থেকে শুরু করে বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়নমূলক সংগঠনে জড়িত ছিলেন। পরবর্তী পর্যায়ে বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতির চট্টগ্রাম জেলা শাখার সভাপতি হিসাবে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও পরিকল্পিত পরিবার গঠনে তার ছিল অনবদ্য অবদান। একজন সু-বক্তা, নির্লোভ মানুষ হিসাবে শুধু মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন।
এমন একজন মানুষকে কখনো কি ভোলা যায়? না যায় না। বর্তমান সমাজ ও রাষ্ট্র কর্তৃক এডভোকেট আজিজুল হক চৌধুরীকে সমাজ সেবা ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে তার অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করা কি যায়না? সেই প্রতাশ্যার লক্ষ্যে মরণোক্তর সম্মান ও স্বাীকৃতি দিলে ক্ষতি কী। সংস্কৃতি ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের নির্বাচক কমিটির সম্মানিত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যেতে পারে। নিজের ব্যক্তিগত আরাম আয়েশ কিংবা আইন পেশার চেয়ে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে তিনি শুধুই কাজ করে গেছেন।
১৯৯৭ সালের এমন দিনে এডভোকেট আজিজুল হক চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রের লস এঞ্জেলস এর একটি হাসপাতালে হৃদরোগে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যুর ২৪ তম বার্ষিকীতে মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, আল্লাহ যেন তাঁকে বেহেস্তবাসী করেন। আমীন।
লেখক : বেতারের অবসরপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, সাহিত্যিক, গীতিকার

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধগান নিয়ে এগিয়ে যেতে চান শিল্পী কাকলী