জুম্’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ২৮ মে, ২০২১ at ৭:০৩ পূর্বাহ্ণ

আমিরুল মুমেনীন ফিল হাদীস হযরত ইমাম বুখারী (র.)’র জীবন ও কর্ম
ইমাম বুখারী (র.)’র নাম ও বংশধারা: নাম: মুহাম্মদ, উপনাম: আবু আবদুল্লাহ, পিতা: ইসমাঈল, উপাধি: আমিরুল মুমেনীন ফিল হাদীস, ইমামুল মুহাদ্দিসীন। বংশ পরিচয়: মুহাম্মদ ইবন ইসমাঈল ইবন ইবরাহীম ইবন মুগীরা ইবন বারদিযবাহ আল জুফী আল বুখারী (র.) ইমাম বুখারী (র.)’র উর্ধ্বতন পুরুষ বারদিযবাহ ছিলেন অগ্নিপুজক, তার পুত্র মুগীরা বুখারার গভর্নর ইয়ামান আল জুফী’র হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন এ জন্য ইমাম বুখারীকে আল জুফী বলা হয়। (হালাতে ফুকাহা ওয়া মুহাদ্দিসীন কৃত: আল্লামা হানিফ খান রিজভি, পৃ: ১১১)
জন্ম: ইমাম বুখারী (র.) আব্বাসীয় খলিফা আল আমীনের শাসনামলে ১৯৪ হিজরির ১৩ শাওয়াল মুতাবিক ৮০৯ খ্রিষ্টাব্দে ১৯ জুলাই জুম্‌’আর নামাযের পর বুখারায় জন্মগ্রহণ করেন। বুখারা একটি শহর যা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে অবস্থিত, বর্তমানে এটি স্বাধীন রাষ্ট্র ইসলামী প্রজাতন্ত্র উজবেকিস্তানের অন্তর্গত। (মুজামুল বুলদান কৃত: ইয়াকুত আল হামাভী, খন্ড: ১, পৃ: ৪২০)
শিক্ষার্জন: ইমাম বুখারীর শৈশবেই পিতৃহারা হন। ইয়াতিম অবস্থায় তিনি লালিত পালিত হন। মায়ের কাছেই প্রাথমিক শিক্ষার সূচনা করেন। অতঃপর পাঁচ বছর বয়সে তাঁকে বুখারার একটি মাদরাসায় ভর্তি করা হয়। তিনি প্রখর স্মৃতি শক্তির অধিকারী ছিলেন। মাত্র ছয় বছর বয়সেই কুরআন মজীদ হিফজ সম্পন্ন করেন। (ইবনুল জাওযী আল মুনতাযাম, খন্ড:৭, পৃ: ৯৬) এবং দশ বছর বয়সে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। মক্তবে প্রাথমিক শিক্ষার সময় হাদীস মুখস্থ করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ সময় আমার অন্তরে ইলহাম হয়। এ সময় তাঁর বয়স সম্পর্কে তিনি বলেন দশ বছর অথবা তার চেয়ে কম। (শামসুদ্দীন আয যাহাবী, সিয়ারু আ’লামীন নুবালা, খন্ড: ১২, পৃ: ৩৯৩)
অসাধারণ মেধা ও স্মৃতি শক্তি: ইমাম বুখারীর অসাধারণ বিস্ময়কর স্মৃতি শক্তির খ্যাতি মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল তিনি নিজেই বর্ণনা করেন, “আমার একলক্ষ সহীহ হাদীস ও দু লক্ষ গায়রে সহীহ হাদীস মুখস্থ রয়েছে। (তারীখু মদীনাতু দামিশক, ৫২তম খন্ড, পৃ: ৬৪) তিনি যখন কোন গ্রন্থে দৃষ্টি দিতেন তা একবার দেখামাত্রই মুখস্থ করে নিতেন। (মুহাম্মদ আবু যাহুু আল হাদীস ওয়াল মুহাদ্দিসুন, পৃ: ৩৫৪)
ইমাম বুখারীর খোদাভীতি ও ইবাদত বন্দেগী: তাকওয়া, পরহেজগারী, ইবাদত বন্দেগীতে ইমাম বুখারী (র.) এক অনন্য আদর্শ চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন। প্রখ্যাত তাফসীরকার আল্লামা ইবনে কাসীর (র.) বলেন, “ইমাম বুখারী (র.) ছিলেন অধিক কল্যাণকামী, অতি অল্পভোজী, বড় দানবীর, অধিক পরিমাণ নামায ও ইবাদতকারী। একবার নামাযরত অবস্থায় একটি ভোমরা তাঁকে দংশন করে সতেরটি স্থানে, তাঁকে দংশন করার পরও তিনি নামায থেকে বিরত হননি। (জামিউল মাসানীদ ওয়াস সুনান, পৃ:৮১)
তিনি অধিকাংশ সময় রাত জেগে ইবাদত করতেন। রমজানে প্রতিদিন একবার কুরআন মাজীদ খতম করতেন, রমজান মাসে প্রত্যেক রাত্রি এক খতমম ত্রিশ রাত্রে ত্রিশ খতম আদায় করতেন। এ ছাড়াও তারাবীহ নামাযে প্রত্যেক রাকাতে বিশ আয়াত তিলাওয়াত করতেন। (তাবকাতুল কুবরা আশ শাফিয়া, খন্ড: ২, পৃ: ২২)
তিনি পৈত্রিক সূত্রে অনেক সম্পদের মালিক ছিলেন। ওয়াররাক বর্ণনা করেন, ইমাম বুখারীর মাসিক পাঁচশত দিরহাম আয় ছিল, তিনি সবই ইলমেদ্বীন অর্জনকারী তাঁর ছাত্রদের জন্য খরচ করে দিতেন। তিনি প্রায়শ দৈনিক তিনশত দিরহাম সাদকা করতেন। তিনি ছিলেন সহজ সরল জীবন যাপনে অভ্যস্ত। পার্থিব লোভ লালসা তাঁকে কোনভাবেই স্পর্শ করতে পারেনি। খাবারের প্রতি কোন আকর্ষণ তাঁর ছিলনা, কখনো কখনো দু’তিনটি বাদাম খেয়ে দিনাতিপাত করতেন। কখনো শুকনো রুটি খেতেন, ইমাম বুখারী (র.) বলেন, বিগত চল্লিশ বছর শুকনো রুটি ছাড়া অন্যকিছু আমি ভক্ষণ করিনি। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, গীবত করা, ব্যভিচারের চেয়েও মারাত্মক কবীরা গুনাহ, ইমাম বুখারী (র.) জীবনে কখনো কারো গীবত করেননি। ইমাম বুখারী (র.) বর্ণনা করেন, আশা রাখি আল্লাহ তা’আলা কিয়ামতের দিবসে আমার হিসাব নিবেন না। কেননা আমি কখনো কারো গীবত করিনি। (তাবকাতুল কুবরা আশ শাফিয়া, খন্ড:২, পৃ: ২২৪)
স্বপ্নে নবীজির দর্শন ও বুখারী শরীফ রচনা: মুহাম্মদ ইবন সুলাইমান ইবনে ফারেস বর্ণনা করেন, ইমাম বুখারী (র.) বলেন, আমি স্বপ্নে দেখলাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র পাশে দাঁড়িয়ে আছি, একটি পাখা নিয়ে নবীজির দেহ মোবারকের উপর বসতে চাওয়া মশা মাছিগুলো তাড়াচ্ছি। স্বপ্নের তাবীরে আমাকে বলা হলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র হাদীসের উপর বিভিন্ন প্রকারের মিথ্যারোপ করার বর্ণনা আপনি দূরীভূত করবেন, এ স্বপ্ন সহীহ বুখারী শরীফ রচনার কাজে আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছে। (তাদবীনুস সুন্নাহ, পৃ: ১১৩)
বুখারী শরীফ প্রণয়ণে সতর্কতা: তিনি বায়তুল্লাহ শরীফের মসজিদুল হারামে বসে এ বিশাল গ্রন্থ প্রণয়নের কাজ শুরু করেন এবং মদীনাতুল মুনাওয়ারার মসজিদে নবভী শরীফের অভ্যন্তরে মিম্বর ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রওজা শরীফের মধ্যবর্তী স্থানে বসে তিনি এ গ্রন্থের বিভিন্ন অধ্যায় ও শিরোনাম সংযোজনের কাজ সম্পন্ন করেন। ইমাম বুখারী (র.) বর্ণনা করেন, “আমি প্রতিটি হাদিস সহীহ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করার পূর্বে অজু ও গোসল করতাম এবং দু রাকাত নফল নামায আদায় করতাম। (তাবকাতুল হানাবিলাহ, ১ম খন্ড, পৃ: ২৫৬)
তিনি আরো বর্ণনা করেন, আমি ছয়লক্ষ হাদিস থেকে এ কিতাব প্রনয়নের কাজ সম্পন্ন করেছি, এতে ষোল বছর সময় লেগেছে, এ কিতাবকে আমার ও আল্লাহর মধ্যে দলীলরূপে প্রতিষ্ঠা করেছি। (তবকাতুশ শাফিয়া, ২য় খন্ড, পৃ: ২২১)
বুখারী শরীফে হাদীস সংখ্যা: বুখারী শরীফের প্রসিদ্ধ ব্যাখ্যাকার আল্লামা বদরুদ্দীন আয়নী’র বর্ণনা মতে পুনরুল্লেখসহ বুখারী শরীফে হাদিস সংখ্যা ৭২৭৫, পুনরুল্লেখ ছাড়া সংখ্যা ৪০০০, ইবনে হাজর আসকালানী (র.)’র বর্ণনা মতে পূনরুল্লেখসহ হাদীসের সংখ্যা ৯০৮২ তন্মধ্যে সর্বোচ্চ তিন সনদে বর্ণিত হাদিস সংখ্যা (সুলাসিয়াত) ২২টি। এতে অধ্যায় সংখ্যা ১৬০টি, অনুচ্ছেদ রয়েছে ৩৪৫০টি।
বুখারী শরীফ খতমের ফযীলত: আল্লামা সৈয়দ জামাল উদ্দিন স্বীয় ওস্তাদ সৈয়দ আসিল উদ্দিন থেকে বর্ণনা করেন, আমি বিভিন্ন ঘটনা বিপদাপদ, আমার নিজের জন্য অন্যান্য লোকদের জন্য ১২০বার সহীহ বুখারী শরীফ পাঠ করেছি প্রত্যেক বারেই আমার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। (তুহফাতুল আহওয়াজী মুকাদ্দামা, পৃ: ১১১)
বিভিন্ন রোগ ব্যাধি থেকে মুক্তি, সর্বপ্রকার দু:খ দুর্দশা, কঠিন বিপদাপদ ও বৈধ উদ্দেশ্য পূরণে বিশুদ্ধ আকিদা সম্পন্ন মুত্তাকী, পরহেজগার, অভিজ্ঞ আলিমেদ্বীনদের মাধ্যমে এ মহান কিতাব খতম করার প্রচলন বিগত ১২০০ বছরের অধিককাল ধরে প্রচলিত। এর সুফল ও উপকারিতা পরীক্ষিত। (আশইয়াতুল লুমাত, খন্ড:১ম, পৃ: ১০-১১)
বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় সহীহ বুখারী শরীফ গ্রন্থটি অনুদিত হয়েছে। পৃথিবীর বহু ভাষায় এর ব্যাখ্যাগ্রন্থ রচিত হয়েছে। আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ বিন জাফর সহীহ বুখারীর ব্যাখ্যা গ্রন্থ টিকা সবমিলে ২৫৫টি গ্রন্থের নাম উল্লেখ করেছেন। (আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবন জাফর আর-রিসালাহ আল মুসতাদ বিযাহ, খন্ড: ৩, পৃ: ১৩)
এ গ্রন্থের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে আল্লামা ইবন হাজর আসকালানী (র.) বলেন, “আল্লাহর কিতাবের পর সর্বাধিক বিশুদ্ধ গ্রন্থ হলো সহীহুল বুখারী। (ফাতহুল বারী মুকাদ্দামা, পৃ: ৫)
সহীহ বুখারী শরীফ ছাড়াও ইমাম বুখারী (র.)’র লিখিত আরো সাতাশ’র অধিক গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়।
ইন্তেকাল: হাদিস শাস্ত্রের এ মহান ইমাম ২৫৬ হিজরির ১ শাওয়াল শনিবার পবিত্র ঈদুল ফিতরের রাতে এশার নামাযের পর ইন্তিকাল করেন। পরবর্তী দিন যোহর নামাযের পর সমরকন্দ’র নিকটবর্তী খরতংক নামক স্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। ইন্তিকালের সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ১৩দিন কম ৬২ বছর। (তাহযীবুল আসমা, ১ম খন্ড, পৃ: ৬৮)
জানাযার পর দাফনের সাথে সাথে তাঁর কবর মুবারক থেকে মিশক আম্বরের সুগন্ধি বের হতে থাকে, ঈমানদার মুসলমানরা কবরের মাটি থেকে বরকতের উদ্দেশ্য সুগন্ধি গ্রহণ করতে থাকে। (হালাতে ফুকাহা ওয়া মুহাদ্দিসীন, পৃ: ১১৪)
হে আল্লাহ আপনার প্রিয় হাবীবের ওসীলায় হাদিসের এ মহান ইমামের ফয়জ, বরকত, আদর্শ ও শিক্ষা আমাদের নসীব করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনিরাপদ মাতৃত্ব ও নারী শ্রমিকের অধিকার
পরবর্তী নিবন্ধস্মরণের আবরণে এডভোকেট আজিজুল হক চৌধুরী