চট্টগ্রাম গণহত্যা ও প্রাসঙ্গিক কথা

কুমার প্রীতীশ বল | বুধবার , ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ১০:২৫ পূর্বাহ্ণ

সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার তেত্রিশতম বার্ষিকী উপলক্ষে ১৯৮১ সালে জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, ‘বিশ্বের ইতিহাসে যে সব গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে স্বল্পতম সময়ে সর্বাধিক সংখ্যক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের গণহত্যায়’। এর পরে বাংলাদেশে আরও একটি গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। যা ইতিহাসে চট্টগ্রাম গণহত্যা নামে লেখা থাকবে।

আমাদের স্মরণ হবে, ২৪ জানুয়ারি ১৯৮৮। তখন স্বৈরাচারী এরশাদের দুঃশাসনকাল। আওয়ামীলীগ সভানেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রাম আসবেন। এ উপলক্ষ্যে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ ব্যাপক আয়োজন করে। লালদিঘি ময়দানে জনসভা হবে। তা দলের পক্ষ থেকে নানাভাবে চট্টগ্রাম শহরে প্রচারও করা হয়। হঠাৎ করে আগের দিন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ ঘোষণা দেয়, লালদিঘির মাঠে কোনো জনসভা করতে দেওয়া হবে না। স্টেজ বানানোর সরঞ্জাম পুলিশ বাজেয়াপ্ত করে। বুঝাই যাচ্ছিল, সরকার ইচ্ছেকৃত একটা ঝামেলা পাকাচ্ছে। পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়ার মতো অনেকটা।

পুলিশের এমন আদেশ জারির কারণে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা পার্শ্ববর্তী জেলা পরিষদ মার্কেটের বারান্দা থেকে তাঁর বক্তব্য দেবেন। সকাল ১১টা নাগাদ তাঁকে বহনকারী বাংলাদেশ বিমানটি চট্টগ্রাম পৌঁছে। বিমান বন্দর থেকে চট্টগ্রামের নেতাকর্মীরা একটি খোলা ট্রাকে তোলেন নেত্রীকে। পথে পথে তিনি একাধিক পথসভায় বক্তৃতাও দেন। দুপুর দু’টা নাগাদ তিনি কোতোয়ালি থানার মোড়ে পৌঁছান। চারদিকে তখন নেতাকর্মীদের মুহুর্মুহু স্লোগান। হঠাৎ কোনো উস্কানি ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের মোড়ে দাঁড়ানো পুলিশ সদস্যরা শেখ হাসিনাকে বহনকারী ট্রাক লক্ষ্য করে প্রথমে টিয়ার শেল পরে গুলি ছুঁড়তে থাকেন। উদ্দেশ্য একটাই, শেখ হাসিনাকে হত্যা করা। উপস্থিত নেতাকর্মী, সাধারণ জনতা পুলিশের ছোড়া গুলি আর টিয়ার গ্যাসের ধোঁয়ার কারণে পিছু হটে দিক্বিদিক ছুটতে থাকে। প্রিয় নেত্রীকে রক্ষা করার জন্য নেতাকর্মীরা তাঁর চারপাশে মানব প্রাচীর তৈরি করেন। ট্রাকে অবস্থানরত আইনজীবীরা শেখ হাসিনাকে বহনকারী ট্রাকটি নিয়ে পাশের রাস্তা দিয়ে আদালত ভবনে ওঠে পড়েন। সেদিন চট্টগ্রামের আইনজীবীরা শেখ হাসিনাকে রক্ষার ক্ষেত্রে চরম সাহসিকতার পরিচয় প্রদান করেন।

তখন চারদিকে গুলিবিদ্ধ অসংখ্য মানুষ কাতরাচ্ছে। অনেক লাশ পাশের বড় ড্রেন ও রাস্তায় ছড়িয়েছিটিয়ে আছে। রাতের আধাঁরে পুলিশ ২৪টি লাশ নিয়ে যায় অভয় মিত্র শ্মশানে। সেখানে লাশগুলোকে পুড়িয়ে ফেলা হয়। অভয় মিত্র শ্মশানঘাটের ডোম কালুকে হিন্দু, মুসলিম, খৃস্টান নির্বিশেষে দাহ করতে বাধ্য করে। পুলিশের গুলিতে গণহত্যার শিকার যাঁদের পুড়িয়ে ফেলা হয়, তাঁরা হলেন: হাসান মুরাদ, মহিউদ্দিন শামীম, স্বপন কুমার বিশ্বাস, এথলেবার্ট গোমেজ কিশোর, স্বপন চৌধুরী, অজিত সরকার, রমেশ বৈদ্য, বদরুল আলম, ডিকে চৌধুরী, সাজ্জাদ হোসেন, আব্দুল মান্নান, সবুজ হোসেন, কামাল হোসেন, বিকে দাশ, পঙ্কজ বৈদ্য, বাহার উদ্দিন, চান্দ মিয়া, মসর দত্ত, হাশেম মিয়া, মো. কাশেম, পলাশ দত্ত, আব্দুল কুদ্দুস, গোবিন্দ দাশ, মো. শাহাদাত। সেদিন কয়েক শতাধিক মানুষ আহত হয়। বলুয়ারদিঘির শশ্মানের কালু ডোমের ভাষ্য মতে, একসঙ্গে এতো লাশ তার জীবনে সে দেখেনি। কালু ডোম নামে শিল্পী সাফায়েত খানের একটা মর্মস্পর্শী গল্প আছে। এখানেও উঠে এসেছে ঘটনার অনেক খণ্ডচিত্র। বিশ্বজিৎ চৌধুরী চট্টগ্রাম গণহত্যা নামে একটি সংকলন প্রকাশ করেন। পরবর্তীকালে তিনি একটি গল্পও লিখেছেন। কবিতা লিখেছেন কবি মিনার মনসুরসহ অনেক কবি। অনেক ছড়াও আছে শহীদদের স্মরণে।

২৪ জানুয়ারি ১৯৮৮ সালের গণহত্যায় শহীদ এথেলবার্ট গোমেজ গোমেজের নামে বাড়ি থেকে একটা চিঠি আসে। এ থেকে জানা যায়, গোমেজ কন্যা সন্তানের পিতা হয়েছে। খবরটা আর সবাই জানলেও গোমেজ জানতে পারেনি। কারণ তার আগেই ২৪ জানুয়ারি গোমেজ গণহত্যার শিকার হলে রাতের অন্ধকারে বলুয়ারদিঘির শশ্মানে পুড়িয়ে ফেলা হয় তাঁর লাশ।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে শহরে নেমে আসে এক ধরনের অদ্ভুত নিস্তব্ধতা, যেমনটি কারফিউর সময় দেখা যায়। শেখ হাসিনাকে প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর সার্সন রোডের বাসভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। কথা ছিল ওখানে তিনি পেশাজীবীদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন। কিন্তু অনুষ্ঠানটি বাতিল করতে হয়। কারণ শেখ হাসিনা যাওয়ার পর পুরো এলাকা পুলিশ ঘিরে ফেলেছিল।

১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা নগরীর লালদীঘি ময়দানে আয়োজিত এক জনসভায় যোগ দিতে গেলে সম্পূর্ণ বিনা উসকানিতে তৎকালীন স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের আজ্ঞাবহ পুলিশবাহিনীর নির্বিচারে গুলি চালানোর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনাকে খুন করে ১৯৭৫ সালের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করা। সেদিন শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে গুলি চালালেও তিনি নিতান্তই ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। শেখ হাসিনার ওপর গুলি করার সময় অসাবধানতাবশত এক পুলিশ সদস্যের রাইফেলের কানেকশন বেল্ট খুলে পড়ায় ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান শেখ হাসিনা। কিন্তু মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানেই গুলিবর্ষণ শুরু হয়। মানব ঢাল তৈরি করে শেখ হাসিনাকে সেদিন চট্টগ্রামবাসী বুকের রক্তের বিনিময়ে রক্ষা করে। এখন এই দিনটি চট্টগ্রাম গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

সেদিন চট্টগ্রামের গণহত্যার প্রতিবাদে চট্টগ্রামবাসী ক্ষোভে দুঃখে ফেটে পড়ে। রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মীরাও ক্ষোভে দুঃখে ফেটে পড়ে। পরদিন প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে। সেদিনও দানব বাহিনী অনুষ্ঠান করতে দেয়নি। শুরু হয় পুলিশের লাঠিচার্জ। পরদিনের পত্রিকায় সাংস্কৃতিক কর্মীদের প্রতিবাদী কালো ব্যানারটি আমাদের প্রতিবাদের প্রতীক হিসাবে ছাপা হয়। এর কিছুদিন পর মুসলিম হলে দুদিনব্যাপী প্রতিবাদী কবিতা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।

১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদের পতন হলে ১৯৯২ সালের ৫ মার্চ আইনজীবী মো. শহীদুল হুদা বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলার আসামিরা হলেনতৎকালীন সিএমপি কমিশনার মির্জা রকিবুল হুদা, কোতোয়ালী জোনের পেট্রোল ইন্সপেক্টর (পিআই) গোবিন্দ চন্দ্র মণ্ডল, কনস্টেবল আব্দুস সালাম, মোস্তাফিজুর রহমান, প্রদীপ বড়ুয়া, বশির উদ্দিন, শাহ মো. আবদুল্লাহ ও মমতাজ উদ্দিন। কিন্তু মামলাটি খুব বেশি এগুতে পারেনি।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর মামলাটি প্রাণ ফিরে পায়। আদালতের আদেশে মামলাটির তদন্তের ভার পড়ে সিআইডির ওপর। সিআইডি ১৯৯৭ সালের ১২ জানয়ারি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে আদালতে। আবারও আদালতের নির্দেশে অধিকতর তদন্ত শেষে ১৯৯৮ সালের ৩ নভেম্বর পুলিশের আট সদস্যকে আসামি করে দ্বিতীয় দফায় অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়।

প্রায় ৩২ বছর পর ২০২০ সালে ২০ জানুয়ারি চট্টগ্রামের বিশেষ জজ আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক বিচারপতি মো. ইসমাইল হোসেন চট্টগ্রাম গণহত্যার রায় প্রদান করেন। রায়ে আদালত পাঁচজন পুলিশ সদস্যকে ২৪ জন মানুষ হত্যার দায়ে ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন। মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামিরা হলেন: মমতাজ উদ্দিন, মোস্তাফিজুর রহমান, প্রদীপ বড়ুয়া, গোপাল চন্দ্র (জেসি) মণ্ডল ও আব্দুল্লাহ। তাদের মধ্যে একমাত্র জেসি মণ্ডল চন্দ্র পলাতক, বাকিরা কারাগারে আছে। মৃত্যুজনিত কারণে তৎকালীন চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার মির্জা রকিবুল হুদা, কনস্টেবল বশির উদ্দিন ও আব্দুস সালামকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। মামলার বাদী আইনজীবী মো. শহীদুল হুদাও কয়েক বছর আগে মারা গেছেন।

চট্টগ্রামবাসী এখনও ২৪ জানুয়ারি এলে চট্টগ্রাম গণহত্যাদিবসকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যজন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধবকবন্ধু – কাকবন্ধু