দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ১০:২৪ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

শুধু ফল খেয়ে রাত কাটাতে আমার কোন অসুবিধা হয়না। দেশেও এই কাজটি প্রায়শ আমি করি। শরীরের ওজন কমানোর জন্য নানা চেষ্টার অংশ হিসেবে রাতে ফ্রুটস খেয়ে শুয়ে পড়া অন্যতম। তবে এতে বিশেষ কোন সুবিধা কোনদিন পেয়েছি বলে মনে হয়নি। দুয়েক বেলা অনাহারে থাকলে আমার শরীরে তেমন কোন প্রভাবই পড়ে না। মোটা শরীরের আনাচে কানাচে জমে থাকা চর্বির পুঁজিতে আমি দিব্যি আরামে থাকি। তবে বেইজিংএর টাটকা ফলগুলো বেশ উচ্ছ্বাসের সাথে খেলাম। আপেল যে এমন রসালো হয় তা প্রথম দেখেছিলাম সৌদি আরবে। অবশ্য পরবর্তীতে ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও টাটকা আপেলের দেখা মিলেছিল। সেই একই ধরনের রসালো আপেল বেইজিং এর হোটেলে পেয়ে ভালো লাগলো। ইতোমধ্যে চীনা কমলা স্বাদ গন্ধে আমার মন ভরিয়েছে। গাছ থেকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে কমলা খাওয়ার যে তৃপ্তি তা অনেকদিন মনে থাকবে। হোটেল কক্ষের ফ্রুটস বুকেটের কমলাও বেশ টাটকা মনে হলো। কলাও একেবারে টাটকা, বেশ শানদার। আসলেই টাটকা ফলের স্বাদই আলাদা। এতে শুধু ফলের গুণগত মানই নয়, স্বাদেও আকাশ পাতাল পার্থক্য থাকে! পুরো বছর কোল্ডস্টোরেজে থাকা ফলের সাথে গাছ থেকে ছিঁড়ে আনা টাটকা ফলের পার্থক্য চিন্তাও করা যায় না। পুকুর থেকে জাল বা বড়শি দিয়ে ধরা মাছের সাথে ফিশিং ট্রলারের ডিপ ফ্রিজে রাখা মাছের পার্থক্যের মতো! ভাবতে গিয়ে বেশ কষ্ট লাগলো যে, আমার সোনার বাংলার লাখো কোটি মানুষই টাটকা আপেল এবং কমলার স্বাদ কেমন তা জানতে পারেন না। অবশ্য, বর্তমানে দেশে কিছু কমলা হচ্ছে। কিন্তু স্বাদ এবং গন্ধে তা চীনা কমলা থেকে বহু দূরে!

টেলিফোনে ‘ওয়েকআপ কল’ দিয়ে ঘুমিয়েছিলাম। নাহয় বডি ক্লকের কিছুটা হেরফেরের ঘাপলায় পড়ে সকালে ঘুম ভাঙ্গা কঠিন। সাতসকালে টেলিফোন বাজতে থাকায় ঘুম ভেঙে গেল। দ্রুত তৈরি হয়ে নিলাম। কারন রাতেই আমার ট্যুর অপারেটর জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, সকাল সাতটায় আমার জন্য বাস আসবে হোটেলের সামনে। আমি যেন সময়মতো নিচে থাকি। আমাকে না পেলে বাস চলে যাবে।

অনেক কষ্টে যোগাড় করা বেইজিং দর্শনের এমন সুযোগ শুধু ঘুমের কারনে হাতছাড়া হোক তা কোনভাবেই আমি চাইনি। এজন্য ভোর ৬টার ওয়েক আপ কল দিয়েছিলাম। যাতে তৈরি হওয়ার জন্য ঘন্টা খানেক সময় পাওয়া যায়। একই সাথে রিসিপশনে ফোন করে আমাকে আর্লি ব্রেকফাস্টের কোন ব্যবস্থা করে দেয়া যায় কিনা তার রিকুয়েস্টও করেছিলাম। আমার রুমভাড়ার সাথে হোটেলে ব্রেকফাস্টের টাকা আদায় করা হয়েছে। অর্থাৎ সকালে আমার হোটেলের ব্যুফে ব্রেকফাস্ট ফ্রি। তবে এই হোটেলে ব্রেকফাস্ট শুরু হবে সকাল সাতটায়। নিয়মানুযায়ী আমাকে ব্রেকফাস্ট খেতে হলে সকাল সাতটা থেকে বেলা ১০ টা পর্যন্ত সময়ে রেস্টুরেন্টে আসতে হবে। কিন্তু আমাকে সকাল সাতটায় ট্যুরিস্ট বাস ধরতে হবে। সুতরাং সাতটায় শুরু হওয়া ব্রেকফাস্ট খেয়ে বাস ধরা কোনমতেই সম্ভব নয়। তাই রিসিপশনে রিকুয়েস্ট করার পরপরই তারা খুবই রেসপন্স করলো। আমাকে বলা হলো যে, সকাল ঠিক ৬টার সময় আমি যেনো ইলেভেনথ ফ্লোরের রেস্টুরেন্টে চলে যাই। সেখানে পুরোপুরি না হলেও আমার জন্য কিছু নাস্তার ব্যবস্থা রাখা হবে। সাতসকালে নাস্তার নিশ্চয়তায় আমি বেশ খুশি হয়েছিলাম। কারণ এটি তারা না করলেও পারতো। অবশ্য নাস্তার এই আগাম আয়োজন যে আমাকে বিশেষ খাতির করা হচ্ছে তা নয়। দুনিয়ার সব তারকাখচিত হোটেলেই এমনতর আর্লি ব্রেকফাস্টের সিস্টেম রয়েছে। হোটেলের কোন গ্রাহকের যদি ভোরে চেকআউট করেন, ভোরে ফ্লাইট থাকে বা বাইরে কোথাও কোন কাজে চলে যায় তখন অনুরোধ করলে হোটেল কর্তৃপক্ষ যতটুকু সম্ভব নাস্তার ব্যবস্থা করে দেয়। অনেক সময় শুধু ব্রেডবাটার, ডিম, পরোটা, ভাজি, ফ্রেশ জুস এবং চা কফি দিয়ে নাস্তার টেবিল সাজিয়ে দেয়া হয়। যা যে কোন মানুষের জন্যই যথেষ্ট। আর্লি ব্রেকফাস্টে রকমারি খাবারের সম্ভার না থাকলেও পেট ভরে খাওয়ার পুরো আয়োজনই থাকে।

আমি দ্রুত তৈরি হয়ে রেস্টুরেন্টে গেলাম। দেখি সেখানে আমার জন্য এক তরুণী অপেক্ষা করছেন। চীনে নারীদের আধিক্য সর্বত্র। তাই এখানেও একজন চ্যাপ্টা নাকের নারী থাকা অস্বাভাবিক নয়। অস্বাভাবিক হচ্ছে আয়োজনের বিশালতা। শুধু ব্রেড বাটার হলে যেখানে আমি বর্তে যেতাম, সেখানে থরে থরে সাজানো হরেক রকমের নাস্তা আমার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হলো। সকাল ৭টার ব্রেকফাস্ট মনে হয় আমার জন্য আগাম করে দেয়া হয়েছে। রেস্টুরেন্টটি বিশাল। আর কোন কাস্টমারই নেই। শুধু কয়েকজন বয় বেয়ারা এবং বাবুর্চী মিলে নাস্তার ডিসগুলো সাজাচ্ছেন। এগ স্টেশনও (যেখানে ডিম ভাজি পোচ অমলেট মামলেটসহ খাওয়ার উপযোগী করে দেয়া হয়) চালু করে দেয়া হয়েছে। আমার হাতে আধাঘন্টা সময় রয়েছে। ওই নারীর ফোন না আসা পর্যন্ত নাস্তা করতে আমার কোন সমস্যা নেই। অতএব বেছে বেছে রকমারি খাবারগুলো আমি খেতে লাগলাম। কোন ধরণের সংশয় বা সন্দেহ আছে এমন অপরিচিত খাবার থেকে যথারীতি দূরে থাকলাম। অত্যন্ত ঝাল করে ডাবল ডিমের পোচ নিলাম। ঘন করে কফি নিলাম। প্রায় অনিশ্চিত নাস্তার পর্বটি এত সুন্দরভাবে সম্পন্ন হলো যে কারো প্রতি কোন অভিযোগ করার কিছু থাকলো না।

আমার ফোন বাজছে। সেই কাঙ্ক্ষিত নম্বর থেকে ফোন। ‘হ্যালো’ বলতে অপর প্রান্তের নারী কণ্ঠ থেকে ‘ভেরি গুড মর্নিং হাসান’ বলে উইশ করার পর জানালেন যে, বাস পাঁচ মিনিটের মধ্যে হোটেলে সামনে পৌঁছবে, আমি যেন নিচে হোটেলের সামনে রাস্তায় থাকি। ওখানে বাস পার্কিং করা যাবে না। পুলিশ ঝামেলা করবে। আমি তাকে আশ্বস্ত করলাম যে, পাঁচ মিনিট লাগবে না। আমি এখনই গিয়ে রাস্তায় দাঁড়াচ্ছি।

আমি খুব দ্রুত মোটা বোর্ডের তৈরি ওয়ান টাইম মগে কফি ভরে নিলাম। নিজে নিজে বানিয়ে নেয়া আর কি! দুধ এবং জিরো ক্যাল নিজ থেকে মেশালাম। ঢাকনা দেয়া ওই মগটি হাতে নিয়ে ছুটলাম লিফটের দিকে। বারো তলা থেকে নামতেও তো কিছুটা সময় লাগে! লিফট অলস ছিল। আমি উঠার সময় যে লিফট বারো তলায় এনেছিলাম, মনে হয় সেটি আর কোন কল ফেস করেনি। এতে করে অনেকটা রেডি লিফট পেয়ে গেলাম। নামতে যা সময় লাগলো! ফলে এক দুই মিনিটের মধ্যেই আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাসের অপেক্ষা করতে লাগলাম।

চীনের রাজধানী বেইজিংএর ভোরের রাস্তা। অসংখ্য গাড়ি ছুটছে রাজপথ এবং অলিগলির পথ ধরে। বাস এবং প্রাইভেট কারের পাশাপাশি নানা ধরনের বাহন। বাচ্চা নিয়ে স্কুটি দাবড়িয়ে চলে যাচ্ছেন বহু মা। সম্ভবত স্কুলে যাচ্ছেন। পিকআপ ভ্যানের পেছনে বস্তা বোঝাই করে ছুটছেন কেউ কেউ। সাইকেল নিয়েও ছুটছেন মানুষ। তবে তারা কি কাজে ছুটছেন নাকি শরীর চর্চা করছেন তা বুঝা গেল না। অবশ্য রাস্তার পাশ দিয়ে প্রচুর পথচারীও চলাচল করছেন। মানুষের ব্যস্ততার যেন কমতি নেই। রেল স্টেশনের এলাকায় হওয়ায় লোক চলাচল মনে হয় স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বেশি। আমি কফির মগে আলতো চুমুক দিয়ে আমার বহুল প্রত্যাশার বাসটির অপেক্ষা করতে লাগলাম।

বাহ্‌! অসাধারণ সুন্দর একটি বাস ইন্ডিকেটর দিয়েছে, ট্যুরিস্ট বাস। আমার বুঝতে অসুবিধা হলো না যে, এই বাসটিতেই চড়েই আমি আজ বেইজিং ঘুরতে যাবো। হাত তুলে ইশারা দিলাম। বাসটি এক ধরনের ‘টিং টিং’ শব্দ করতে করতে আমার সামনেই থেমে গেল। স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে গেল দরোজা। এক তরুণী দরোজা থেকে মুখ বাড়িয়ে ‘ওয়েলকাম মি.হাসান’ বলে আমাকে বাসে আহ্বান করলেন। আমি বুঝতে পারলাম যে, এই চীনা তরুণীই আমাকে ফোন করেছিলেন। লাফিয়ে বাসে চড়লাম।

প্রায় পুরো বাসই খালি। আমি একেবারে সামনের দিকে একটি সিটে গিয়ে বসলাম। যাতে সামনের উইন্ডশীটের পাশাপাশি দু’পাশের জানালা দিয়েও আশপাশ দেখা যায়।

তরুণী আমার পাশের সিটে এসে বসলেন এবং আমার হাতে একটি কাগজ দিয়ে বললেন, এটিই সিডিউল। আজ সারাদিন এই সিডিউল ধরেই আমরা বেইজিং ঘুরবো। ডে ট্যুর। আপনাকে আবারো হোটেলে নামিয়ে দিয়ে যাবো। কোন স্পটে হারিয়ে গেলে আমাকে ফোন করবেন। তবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই দেখা শেষ করে বাসে উঠে যাবেন। যাতে অন্যদের কোন অসুবিধা না হয়। আমি তাকে আশ্বস্ত করলাম যে, গ্রুপ ট্যুরের কিছুটা ধারণা আমার আছে। আমার জন্য আপনাকে বিব্রত হতে হবে না। তিনি হেসে আমাকে ধন্যবাদ দিলেন। বললেন, আগামীকালের প্ল্যান আপনাকে এখানে ড্রপ করে যাওয়ার সময় দিয়ে দেয়া হবে। অল্পক্ষণ পর তরুণী আবার বললেন যে, তিনটি পৃথক হোটেল থেকে ট্যুরিস্ট উঠানোর পরই শুরু হবে আজকের মূল ট্যুর। আমি যেনো বিরক্ত না হই। আমি হেসে প্রতিউত্তর দিলাম। (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাংলা হোক আমাদের হৃদয়ের সুর
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম গণহত্যা ও প্রাসঙ্গিক কথা