বাংলা হোক আমাদের হৃদয়ের সুর

সুপ্রতিম বড়ুয়া | বুধবার , ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ১০:২৩ পূর্বাহ্ণ

পৃথিবীতে ভাষার লড়াইয়ে এমন রক্ত ক্ষরণের ইতিহাস রচনাকারী মাতৃভাষার অধিকার লড়াইয়ের বিপ্লবী জাতি হলাম একমাত্র আমরা। যা ভাবতেই গর্বে বুক ফুলে ওঠে। তবে এতো কষ্টে অর্জিত এই রত্নসম মাতৃভাষার যথার্থ সম্মান দিতে আমরা বেশিরভাগ বাঙালিই অক্ষম। আজকাল আমাদের মধ্যে পাশ্চাত্য সংস্কৃতিপ্রেমের পাশাপাশি পাশ্চাত্য ভাষার প্রতিও মোহ প্রবলভাবে লক্ষণীয়। তরুণ প্রজন্ম ইংরেজিতে কথা বলাটাকেই একমাত্র তথাকথিত ‘স্মার্টনেস’ বলে জ্ঞান করছে আর বাংলায় কথা বললে ভাবছে সেটা তথাকথিত ‘ক্ষ্যাত’ মানসিকতার পরিচায়ক, যা বাংলা ভাষার পক্ষে যথেষ্ট অপমানজনক এবং দুঃখজনক বলে মনে করি। শুধুমাত্র আমাদের মূল্যবোধের অবক্ষয়ে বাংলা ভাষা তার স্বকীয়তানিজস্বতা হারাচ্ছে, তরুণ প্রজন্মের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ‘বাংলিশ’ নামক এক আশ্চর্য জগাখিচুরি ভাষা। অথচ আমরা এটা ভুলে যাচ্ছি যে নিজস্ব ভাষাকে সম্মান জানাতে না পারলে পৃথিবীর সব ভাষায় পারদর্শী হলেও দিনশেষে ভাষাজ্ঞানে ‘শূন্য’ ছাড়া আর কিছুই জোটার নয়। এ অবস্থা থেকে উদ্ধার হতে সবাইকে বিশেষ করে আমাদের তরুণ প্রজন্মকে নিজস্ব ইতিহাসসংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে হবে। স্বআদর্শ আগে ধারণ করতে হবে, বিদেশিসংস্কৃতির প্রতি অন্ধ মোহে আবদ্ধ হওয়া চলবে না। মায়ের ভাষা বাংলাই হোক সবার আগে আমাদের সুখদুঃখ আনন্দ অনুভূতির প্রকাশক, যেই ভাষাকে আনতে গিয়ে শহীদ হয়েছে লক্ষ লোক। নিরবচ্ছিন্ন সুন্দর বহমান নদীর মতো প্রাণোচ্ছল এই বাংলা ভাষাকে আমরা মিশ্রতায় কলুষিত করবো না, আমাদের মহান শহীদদের মহান ত্যাগকে অসম্মান করবো না। শুধুমাত্র ভাষার মাসেই ভাষাকে সম্মান জানিয়ে থেমে যাবো না। বাংলা হোক আমাদের হৃদয়ের সুর, আমাদের মুখে প্রাণ পাক চির অমলিন এই প্রাণের মাতৃভাষা। প্রতিটি মানুষ জন্মের পর তার ভাষা শেখে নিজের পরিবেশ থেকে। জন্মের পর থেকে একজন মানুষ তার পরিবেশ থেকে প্রথম যে ভাষাটি শেখে এবং যে ভাষায় সে সর্বাধিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, সেটিই ব্যক্তির মাতৃভাষা। প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত দুটি ভূখণ্ডে দুটি ভিন্ন ভাষার জাতিসত্তাকে মিলিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম থেকেই মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করে সূচনা হয়েছিল আন্দোলনের। আর এই ভাষা আন্দোলনকেই বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টির পথে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে মনে করা হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে বাঙালি একমাত্র জাতি যারা মাতৃভাষার জন্য জীবন দিয়েছে। একুশে ফেব্‌্রুয়ারি এ দেশের মানুষকে শিখিয়েছে আত্মত্যাগের মন্ত্র, বাঙালিকে করেছে মহীয়ান। জাতি হিসেবে আমরা আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদী ভাবধারার সমন্বয়ে অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধারণ করেছি। মহান ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই এসেছে মহত্ত্বর স্বাধীনতার চেতনা। একুশের কৃষ্ণচূড়ার চেতনার রঙে রঙিন হোক সব তরুণের হৃদয় বাঙালির জীবনে একুশ এসেছিল তরুণদের আত্মত্যাগের কারণেই। একসময় তরুণরাই এগিয়ে এসেছিল মা, মাটি ও মাতৃভাষা কে একদল হায়েনার উগ্রতা, ধর্মান্ধতা আর স্বৈরচারিতার কালো ছোবল থেকে বাঁচাতে। আর তাঁদের উত্তরসূরি বর্তমান প্রজন্ম আজ মেতে আছে বিদেশী অপসংস্কৃতি চর্চায়। বর্তমান প্রজন্মের কাছে একুশ শুধুই বইমেলা, প্রভাতফেরি, শ্রদ্ধাঞ্জলি আর আলোচনাসভার ভিতরেই সীমাবদ্ধ। একুশের আগুনরাঙা পলাশের মাঝে কবি শামসুর রাহমান যে চেতনার রঙের কথা বলেছিলেন সেগুলো তরুণদের চোখে আজ অধরা। কথাই আছে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটে না, ঠিক তেমনই নিজ মাতৃভাষাতে মনের ভাব প্রকাশ করার মতো সুখ কি আর অন্য ভাষাতে মেলে? কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম অতি আধুনিকতার ছোঁয়াই নিজ মাতৃভাষার মায়া ভুলতে বসেছে। আমাদের সকলের উচিত একুশকে শুধু একটা মাস অথবা একটা দিনের ভিতরে সীমাবদ্ধ নয় একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশ থেকে অপসংস্কৃতি চর্চা অপসারণ করা। একুশের কৃষ্ণচূড়ায় মেশানো আমাদের চেতনার রং রাঙিয়ে তুলুক সব তরুণের হৃদয়, এ একুশে এটাই কামনা করি। একুশ মানে চেতনার উজ্জীবন। একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির জাতীয় জীবনের অমর অধ্যায় এবং অন্যতম অর্জন। একুশের চেতনায় উদ্ভাসিত হয়ে বাংলার সূর্য সন্তানরা যে গৌরবময় ইতিহাসের জন্ম দিয়েছেন তা স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির মূল অনুপ্রেরণার উৎসস্থল। রাষ্ট্রভাষাআন্দোলন এ অঞ্চলের মানুষের চেতনায় উপ্ত করে ভাষাসংস্কৃতিভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবোধ আর মুক্তিযুদ্ধ তাদের পৌঁছে দেয় মুক্তির চূড়ান্ত মোহনায়। এ পথ মোটেই সহজ ছিল না; এতে বহু মানুষকে যেমন জীবন দিতে হয়েছে, তেমনি জাতিকে সাঁতরাতে হয়েছে বিশাল রক্তের সমুদ্র; সম্ভ্রমও হারিয়েছে অনেক জায়াজননী। ১৯৫২ থেকে ২০২৩ সাল, ভাষা আন্দোলন ৭১ বছরে পদার্পণ। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও আমাদের মাঝে বাংলা ভাষার সুপ্ত চর্চার অভাব এখনো বিদ্যমান। তাছাড়া ভাষা আন্দোলনের অন্যতম মূলনীতি ‘সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠা’ বাস্তবায়ন এখনও পুরোপুরি সম্ভব হয়ে উঠেনি। ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায়, বাংলা ভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। আধুনিকতার নামে যদি অবহেলিত হয় বাংলা ভাষার সম্মান তাহলে ব্যর্থ হবে শহীদদের আত্মত্যাগ। তাই, সরকারের অগ্রণী ভূমিকা এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিক সদিচ্ছা ও সাবলীল ব্যবহারের মাধ্যমে একুশের চেতনাকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম অক্ষত রাখা জরুরি। ভাষা একটা জাতিসত্তার বহিঃপ্রকাশ। বাংলা ভাষা শুধুমাত্র আমাদের মাতৃভাষায় নয় এটি আমাদের অস্তিত্বের মেরুদণ্ড। প্রতিটি ভাষাই চলমান স্রোতের মতোই খরস্রোতা হলেও ভাষার একটা নিজস্ব তাল, লয়, ছন্দ থাকে। যেগুলো সচেতনভাবে ব্যবহার না করলে এবং যত্ম করা না হলে ভাষার আসল সত্তার গন্ধ কালের মালা বদলে বিলিন হয়ে যাবে। এতো রক্ত, এতো সংগ্রাম, এতো ত্যাগের বিনিময়ে অর্জন করা আমাদের মাতৃভাষা আজ সীমান্তরেখা পেরিয়ে পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে যার সুবাস ছড়িয়ে পড়েছে, সে তো অমূল্য রতন! অহংকারের বসন। ভাষার মাসে আমার এতোটুকুই আহ্‌বান আসুন বাংলা ভাষার সঠিক চর্চা ও ব্যবহার করি।

লেখক: অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, রামু সরকারি কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচলুন ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ি
পরবর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে