কীর্তিতে অম্লান ইনসানে কামিল ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আবদুল খালেক

মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | রবিবার , ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৫:২৫ পূর্বাহ্ণ

স্বাধীন বাংলার জনগণ যে সব কীর্তিমান মনীষীদের জীবন-কর্ম চর্চা ও গবেষণা করে ধন্য হবেন যুগ যুগান্তরে, জ্ঞান তাপস সাধক পুরুষ ইনসানে কামিল ইঞ্জিনিয়ার আলহাজ্ব মোহাম্মদ আবদুল খালেক (র.) তাঁদের অন্যতম। শিক্ষা দীক্ষা, জনসেবা, সমাজ সেবা, দেশ ও জাতির উন্নয়ন, অগ্রগতি ও একটি আদর্শ সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে বহুমুখী কল্যাণধর্মী পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন সর্বোপরি ইসলামী আদর্শবাদ সূফীতত্ত্ব ও আধ্যাত্ম চেতনায় উজ্জীবিত অনুকরণীয় এক ব্যাক্তিত্বের নাম ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক (র.)। তাঁর বহুমাত্রিক গুণাবলী অনন্য অসাধারণ জীবনাদর্শের কারণে তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন ও থাকবেন। বার আউলিয়ার স্মৃতি বিজড়িত চট্টগ্রাম জেলার রাউজান উপজেলার সুলতানপুর গ্রামে মরহুম বেলায়েত আলী ও মহিয়সী রমণী বেগম ফজিলাতুন নেছার ঔরসে ২০ জুলাই ১৮৯৬ খ্রি. এ সৌভাগ্যবান শিশুর ধরাধামে আগমন। ১৯৬২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর তিনি ইহকাল ত্যাগ করেন। ৬৬ বৎসরের তাঁর কর্মময় জীবন ছিল দেশ ও জাতির কল্যাণে এবং ইসলামের অকৃত্রিম খিদমতে উৎসর্গীত। বিজ্ঞান মনস্ক আধুনিক শিক্ষায় উচ্চ শিক্ষিত এ মানুষটি চিন্তা চেতনায়, মননে মেধায় একজন প্রকৃত ঈমানদার ধার্মিক ব্যক্তিত্ব। কলকাতা যাদব পুর, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থকে ১৯১৯ সালে কৃতিত্বের সাথে পাশ করা তিনি ছিলেন পূর্ব বাংলার প্রথম মুসলিম ইঞ্জিনিয়ার। ১৯২০ সনে প্রকৌশলী হিসেবে কর্ম জীবন শুরু করে স্বল্প সময়ে মেধা ও যোগ্যতায় চাকুরী জীবনে তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে উচ্চ পদমর্যাদায় উন্নীত হন। সরকারী চাকুরীর সকল প্রকার সুযোগ সুবিধার প্রলোভন ত্যাগ করে ১৯৩২ সালে চাকুরী ইস্তেফা দেন। শিক্ষা, সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চা ও বিকাশের দৃঢ় প্রত্যয়ে তাঁর সুচিন্তিত ও পরিকল্পিত স্বপ্ন বাস্তবায়নে সৃজনশীল কার্যক্রম শুরু করেন। ১৯২৯ সালে কোহিনূর লাইব্রেরী ও পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৩০ সালে নগরীর ঐতিহ্যবাহী আন্দরকিল্লাহ মোড়ে কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস স্থাপন করেন। উপমহাদেশের প্রখ্যাত অলীয়ে কামিল আওলাদে রাসূল আল্লামা হাফেজ ক্বারী সৈয়্যদ আহমদ শাহ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন তাঁর পীর ও মুর্শিদ। সৃষ্টি সেবায় নিবেদিত মানবতাবাদী এ মহৎপ্রাণ ব্যক্তিত্ব, খোদাভীতি নবীপ্রেম ও মুর্শীদের প্রতি আনুগত্য ছিল তাঁর চারিত্রিক ভূষণ। সুন্নীয়তের খিদমত, কাদেরিয়া তরীকার প্রচার-প্রসারে নিষ্ঠাপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ আপন পীর মুর্শীদ তাঁকে অন্যতম খলিফা হিসেবে খিলাফতের শিরোবরণে ভূষিত করেন। চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশে ইসলামী শিক্ষার সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ জামেয়া আহমদিয়া সুন্নীয় আলীয়ার মতো ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা হযরত সিরিকোট (র.)’র এর শিষ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠালগ্নে যাঁদের ত্যাগ ও অবদান অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন ইঞ্জিনিয়ার সাহেব (র.) তাঁদের অন্যতম। তিনি ছিলেন বৃহত্তর চট্টগ্রামে মুসলিম সাংবাদিকতার পথিকৃৎ। ১৯৫০ সালে “কোহিনূর” নামে সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৯৬০ সালে ৫ সেপ্টেম্বর দৈনিক আজাদী পত্রিকা প্রকাশ করেন। এ দিনে আজাদী পত্রিকা প্রকাশের কারনটি ছিল বিশেষভাবে তাৎপর্য মন্ডিত। এ দিনিটি ছিল রাহমাতুল্লীল আলামীন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পৃথীবিতে শুভাগমনে স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহাসিক দিন পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র দিন। পত্রিকা প্রতিষ্ঠার তারিখ নির্বাচনে এ দিনকে নির্দ্দিষ্ট করণ নি:সন্দেহে তাঁর অন্তরে নবী প্রেমের এক উজ্জ্বল নিদর্শনের বহি:প্রকাশ। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব ছিলেন এ বহুল প্রচারিত জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক (১৯৬০-১৯৬২) এ দেশে অসংখ্য লেখক সৃষ্টিতে আজাদীর ভূমিকা ও অবদান অনস্বীকার্য। দেশের খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ প্রথিতযশা সাংবাদিক, লেখক গবেষক প্রাবন্ধিক ও সাহিত্যিকদের লেখামালায় আজাদী আজ সমৃদ্ধ। রাজনীতি, অর্থনীতি, ইতিহাস, শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ধর্ম, দর্শন প্রভৃতি বিষয়ে মাটি ও মানুষের মনের কথা তুলে ধরার বলিষ্ট মুখপত্র দৈনিক আজাদী। সত্য প্রচারে আজাদীর কণ্ঠ সদা উচ্চকিত ‘আজাদী’ মানে স্বাধীনতা, আজাদী সাহসীকতা ও স্বাধীনতার প্রতীক। ১৯৬২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা প্রাণ পুরুষ পত্রিকা প্রতিষ্ঠার দু বৎসরের ব্যবধানে তাঁর মহান প্রভূর সান্নিধ্যে গমন করেন। আদর্শ পিতার সুযোগ্য উত্তরসূরী আজাদীর বর্তমান সম্পাদক মহোদয় আলহাজ্ব এম এ মালেক’র সঠিক নির্দেশনা আজাদী পরিবারের সংশ্লিষ্ট সকলের ত্যাগ ও শ্রমের বিনিময়ে এ পত্রিকা আজ গণ মানুষের ভালবাসায় সিক্ত। দৈনিক আজাদী ও ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক (র.) ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের জীবনের অন্যান্য সব কীর্তিবাদ দিলেও হযরত সিরিকোটি (র.), আনজুমান-এ-রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট ও জামেয়াসহ আধ্যাত্মিক মিশনের সম্পৃক্ততা তাঁর আদর্শ জীবনের শ্রেষ্ঠকীর্তি হিসেবে বললে অত্যুক্তি হবে না।
ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের লিখিত রচনাবলী: গ্রন্থ রচনা ও বই প্রকাশনা জ্ঞানের আলো বিতরণের উৎকৃষ্ট মাধ্যম। আদর্শ প্রচারের অন্যতম হাতিয়ার। লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা, পত্রিকা, প্রকাশনা, মাদরাসা ও খানকাহ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি তিনি লিখনী জগতে অসামান্য অবদান রাখেন, একজন সুলেখক হিসেবে তাঁর পরিচিতি ছিল সমধিক। তাঁর লিখিত ১৭টি বইয়ের নাম পাওয়া যায়।
১. মুসলিম বাল্য শিক্ষা, ২. তাওয়াফ (হজ্ব গাইড), ৩. রচনার প্রথম ছড়া, ৪. সহজ পাঠ (শিশু পাঠ), ৫.প্রাথমিক ভূগোল বিজ্ঞান ও গ্রাম্য জীবন, ৬. ফাস্ট বুক অব টান্সলেশন, ৭. চাইল্ড পিকচার ওয়ার্ড বুক, ৮.ব্যাকরণ মঞ্জুষা, ৯. উর্দূ প্রাইমারি, ১০. দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, ১১. দেশ প্রিয়, ১২. বয়েস ইংলিশ গ্রামার, ১৩.ঝলমল (শিশু পাঠ্য), ১৪. বার আউলিয়া ও নেপোলিয়ান, ১৫. শেখ ই-চাটগাম কাজেম আলী, ১৬.চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, ১৭. যতীন্দ্র নাথ উল্লেখযোগ্য,
ইঞ্জিনিয়ার সাহেব ছিলেন পরশ পাথর: আল্লাহ ও তদীয় রাসূলের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য পীরে কামিলের সান্নিধ্যে এসে তিনি নিজ সত্তাকে উৎসর্গ করেন। কর্ম ও সাধনার বদৌলতে বান্দা যখন নিজ অস্তিত্ব বিসর্জন করেন, মহান আল্লাহ তখন তাঁকে মকবুল বান্দা হিসেবে কবুল করেন। ইসলামী জাগরণের কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় ইসলাম সে তো পরশ মানিক তারে কে পেয়েছে খুজি, পরশে তাহার সোনা হল যারা তাদেরই মোরা বুঝি। আল্লামা রুমি (র.) বলেছেন, “গারতো সাংগে খারা ও মারমার শাভী, চুঁ-ব ছা’হেব দিল রসী গরহর শাভী” (মসনভি), অর্থ: তুমি যদি কঠিন শিলা বা মরমর পাথরও হও অলীয়ে কামেলে সংস্পর্শে গেলে তুমি মূল্যবান অলংকারে পরিণত হবে। একজন অলীয়ে কামিলের সাথে প্রেমের সম্পর্ক ও ভালবাসার বন্ধনের কারণে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব আজ ইনসানে কামিলে পরিণত হয়ে পবিত্র জীবন লাভে ধন্য হয়েছেন। সর্বস্তরের মানুষের কাছে তিনি আজ স্মরণীয়। তাঁর ৫৯তম ওফাত বার্ষিকী উপলক্ষে প্রভূর দরবারে প্রার্থনা, মহান আল্লাহ তা’আলা ইঞ্জিনিয়ার আলহাজ্ব আবদুল খালেক (র.) কে জান্নাতুল ফেরদৌসের সুউচ্চ মকাম নসীব করুন।
লেখক: অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), মধ্য-হালিশহর, বন্দর, চট্টগ্রাম; খতিব,
কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধআরও অ্যান্ড্রয়েডে আসছে ছবি গোপনের ‘লকড ফোল্ডার’ ফিচার