দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৫:২৪ পূর্বাহ্ণ

অতএব নাহ, সেই ঝুঁকি নেয়া যাবে না। লিখতে হবে ফের ওখানে, তবে পূর্ণ বাক্য না! লিখব টেলিগ্রাফিক কায়দায়। মানে ইয়েস, নো, ভেরি গুড মার্কা ইংরেজি। তাতে বরং ঝুঁকি কমবে। অতএব পরিষ্কার বাংলায় বললাম দেখি মিয়া লি খান, দাও তোমার ফোনখানা ফের। লিখব ফের যেতে চাই এ বেলা কোথায়। তার পরেরটা পরে হবে। ওটা লিখব পরে।
অবশ্যই এইমাত্র বাংলা বচন লি খানের কর্ণগোচর হলেও বোধগোচর হয়নি! তবে হাতের ইশারাটা যে সে বুঝেছে ভালই, প্রমাণ হল তা যখন সে বিনাবাক্যব্যয়ে এবং বিনাদ্বিধায় ফের তুলে দিল তার হাতফোন, ক্ষণকাল পূর্বে পরিচিত এই বংগসন্তানের হাতে, বসে আছে কি না যে এখনা তারই পাশের সিটে ।
ফোন টা হাতে আসতেই দ্রুত টেলিগ্রাফিক ইংরেজিতে লিখলাম নাউ, তিয়েন আন মেন লিখেই ফোনের পর্দাটা লি খানের চোখের সামনে ধরতেই, সে বোলাল তার যাদুই আঙ্গুল তাতে! সাথে সাথেই ফোন বাবাজী তা অনুবাদ করে ফেলতেই, লি খান তা দেখে একটা মুচকি হাসি দিয়ে এমন ভঙ্গি করল যার মানে দাঁড়ায়, ‘আমিও তো তাই ঠিক করেছিলাম ভায়া’! তবে মুখেও অস্ফুটভাবে বলল এক শব্দের একটা বাক্যঃ ‘ওকে’। আর তা বলেই ফোনটা ফিরে পাওয়ার জন্য হাত বাড়াতেই ফের খাস বাংলায় বললাম
রোসো মিয়া লি খান; ফোনের কাজ শেষ হয়নি এখনো। আরো কাজ আছে বাকী বলেই নিজের ফোনের নম্বরটা ওতে টাইপ করে সাথে ‘মাই নম্বর’ লিখে দেখাতেই বলল সে ‘ইয়েছ’
যার মানে, বুঝেছে সে যে এটা আমার নম্বর। কিন্তু তাতে তো আমার কাজ শেষ হয়নি। আমার তো দরকার তার নম্বর নিজের ফোনের মগজে ঢুকিয়ে রাখা, যাতে যে কোন প্রয়োজনে ডেকে আনতে পারি সহজে। যদিও জানি না, ফোনে কি বললে সে বুঝবে, যে আসতে হবে তার। তবে ধরে নিয়েছি, ফোনে তাকে ‘কাম’ বা খুব জোর ‘কাম কুইক’ এই জাতীয় কথাবার্তা ছাড়া অন্য কোন কথা বললে কাজের কাজ কিছুই তো হবে না, বরং বাড়তে পারে ঝঞ্ঝাট তাতে। অবশ্য এখানে তাকে দিয়ে তো আর, ঢাকার বাসার ড্রাইভারকে দিয়ে যেমন সময়ে অসময়ে ঠেকার কাজ চালানোর মতো বাজার সদাই করানো হয়, তেমন কোন কাজ করাব না; অতএব ‘কাম কুইক’ বললে তা সে বুঝলেই চলবে। আর কোথায় আসতে হবে তা, গাড়ি থেকে নেমেই তাকে বলে হউক আর লিখে হউক ভাল করে বুঝিয়ে দিতে হবে। তাহলেই কাজ চলে যাবে।
আপাতত তার নম্বরটা পাওয়ার জন্য, লি খানের ফোনে লিখলাম ‘কল মি নাউ’ বলেই ফিরিয়ে দিলাম তা যথাহস্তে!
আর তাতেই মনে হল কাজ হয়েছে। ফোন হস্তগত হতেই ফের একটা মুচকি হাসি দিয়ে, লি খান ফোনের পর্দায় দ্রুত হাত বোলাতেই, পকেট থেকে নিজের হাতফোন বের করে ওটার রিং টোন শোনার জন্য কর্ণ উৎকীর্ণ করে থাকার সাথে সাথে নিবিষ্ট চিত্তে তাকিয়েও থাকলাম পর্দায়, লি ফোনের নম্বর ভেসে উঠার আশায়।
অন্য কার কি রকম মনে হয় এমন অবস্থায় তা জানি না। মানে বলছিলাম আর কি সে কথাটা, দেশেও কারো সাথে ফোন নম্বর দেয়া নেয়া করার জন্য পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বা বসে একজন আরকেজনের নম্বরে ফোন করি বা কেউ করে আমাকে, অজান্তেই মনের ভেতরে একটা তীব্র আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয় যে, ফোন নম্বর টেপা মাত্রই অন্য ফোনটি বেজে উঠবে! কারণ আছি তো দাঁড়িয়ে বা বসে পাশাপাশি। তাতে দু, চার পাঁচ বা দশ সেকেন্ড সময় লাগবে কেন? এই তো পারছি ছুঁতে যখন একজন আরেকজন কে অনায়াসে, সেক্ষেত্রে ডিজিটাল সময়ের ফোন কেন এতো সময় নেবে? মনের এমন আকাঙ্ক্ষার মুখে ছাই দিয়ে, যখন অবশ্যই ঘটে না কখনোই, প্রচণ্ড বিরক্ত লাগে তাতে প্রতিবারই। ফলে ভেতরে ইতোমধ্যে তৈরি হওয়া সেই তীব্র অসহিষ্ণুতার ছাইচাপা আগুনে শুধু যে ঘৃতাহুতি পড়েছে তা নয় শুধু, সাথে তাতে যোগ হয়েছে পেট্রলাহুতি এমনকি অকটেনাহুতিও।
দেশের জানাশোনা নিশ্চিন্ত পরিবেশেই যখন এমন হয়, তখন সেই অসহিষ্ণুতাটি যে এই বেইজিঙের হিমসাগরে ফুলেফেঁপে বাড়বে শতগুণ, সেটাই তো অতিস্বাভাবিক। ফলে লি খান তার ফোন থেকে ফোন দেয়ার পর, পাঁচ, দশ, নাকি পনের সেকেন্ড পার হওয়ার পরও যখন ঘুম ভাঙ্গল না আমার ফোনের, তাতে মনে হলো পেরিয়ে গেছে বুঝি তীব্র অসহিষ্ণুতার বছর হাজার আমার! আর তাতে এমুহূর্তে মনের ভেতর যে তীব্র চাপটি তৈরি হয়েছে এক্ষণে, তাকে অসহিষ্ণুতা বলা চলে না। বলতে হয় তাকে প্রবল অনিশ্চয়তাসূচক তুমুল আশংকা! আর সেই আশংকার জ্বালামুখ ততোক্ষণে উদ্গীরণ করতে শুরু করেছে ভীষণরকম দুর্ভাবনা!

এদিকে সেই ভীষণ দুর্ভাবনা চকিতেই যা প্রসব করল মনে তা হল, আচ্ছা আমার রোমিং করা ফোনের রোমিং কি তবে কাজ করছে না নাকি? যদিও খুব একটা ফোন করিনি এখানে এসে, তাতেও কি আমার রোমিং বিল খুব বেশী হয়ে গেল নাকি যে, ফোন কোম্পানি ওটা বন্ধ করে দিয়েছে এই সাতসকালেই? কিন্তু তা তো কখনোই হওয়ার কথা নয়। কারণ ফোনটা তো আমার দাপ্তরিক ফোন। এ ফোন কখনোই কোন অবস্থাতেই বন্ধ রাখা যাবে না, এমনইতো চুক্তি করেছিল কোম্পানি, ফোন সেবাদানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সেই ফোন কোম্পানিটির সাথে।
অবশ্য এরকম চুক্তি থাকার পরও যে ঘটেনি তা আমার ক্ষেত্রে, তা তো নয়। অতএব হতেই পারে তা। ফোন কোম্পানির সেলসের লোক কর্পোরেট ডিল ধরার জন্য দেখা গেছে চুক্তি করার সময় নানান সব কমিটমেন্ট করে বসে, যা নাকি অনেক সময় দেখা যায় তার কোম্পানির ফিনান্স বা টেকনিক্যাল বা কাস্টমার সার্ভিস ডিপার্টমেন্টের পলিসির রীতিবিরুদ্ধ। ফলে হয় কি, তড়িঘড়ি চুক্তি করার চাপ দেয়ার সময় বিক্রয় প্রতিনিধিরা ঐ যে বাড়তি সুবিধা দেবার ফাঁকা বুলি গুলো আওড়েছিল মুখে, চুক্তিপত্র লেখার সময় সেগুলো তারা সযত্নে এড়িয়ে যায়। আর গ্রহিতা কোম্পানির চোখে তা পড়লে, নিতান্তই অনিচ্ছায় তা চুক্তিপত্রে দায়সারাভাবে ঢুকিয়ে দিলেও, নিজ অফিসে তা নিয়ে উচ্চাবাচ্য করা তো দূরের কথা, মুখই খোলে না মোটেই তা নিয়ে। আর বাকী ডিপার্টমেন্টগুলো যখন এই নতুন গ্রহিতা নিয়ে কাজ শুরু করে তাদের সিস্টেমে, তখন তো তারা প্রতিটি চুক্তি ধরে ধরে কাজ করে না; বরং কাজ করে তারা তাদের এস ও পি মানে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর ধরে। ফলে ঐ সব ফাঁকাবুলি গুলোর ফলাফল ফাকাই হয় অবশেষে। তাতে বাড়ে ভোগান্তি ভোক্তার! এখন কি আমার ক্ষেত্রেও তাই ঘটল নাকি?
আবার আমার ফোনের বাংলাদেশী অপারেটিং কোম্পানির সাথে এই চায়নার ফোন অপারেটিং কোম্পানির ফোনসেবা প্রদান বিষয়ক কী ধরনের দ্বিপাক্ষিক বা ত্রিপাক্ষিক চুক্তি আছে তার উপরও তো নির্ভর করবে কী রকম ফোনসেবা পাওয়া যাবে। এ মুহূর্তে এ হাতফোনটি এখানকার যে ফোন অপারেটরের সাথে স্বয়ংক্রিয়ভাবেযুক্ত হয়ে গেছে, তার সাথে যদি বাংলাদেশের ফোন কোম্পানিটির উপরোক্ত রকমের চুক্তি না থাকে, তাহলেও তো কাজ করবে না ফোন যতই হউক না কেন ফোন আমার ইন্টারন্যাশানাল রোমিং। সেক্ষেত্রে অবশ্য দেশ থেকে বের হওয়ার আগে দেশিয় সেই কোম্পানির সাথে কথা বলে জেনে আসা দরকার ছিল, এদেশে কোন কোম্পানির সাথে তাদের আছে ঐরকম চুক্তি। অবশ্য চায়না তথাকথিত খোলাবাজার অর্থনীতির পথে পা বাড়ালেও, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তো মনে হয় ঐ সব পুঁজি পেছন থেকে নিয়ন্ত্রণ করে সরকার। এখানে নানান গুরুত্বপূর্ণখাতে একাধিক কোম্পানির অস্তিত্ব আছে বলে তো মনে হয় না!
তার উপর বড় কথা হল আজকের ইনফরমেশন টেকনলজির ডিজিটাল সময়ে, যখন ইনফরমেশন, ডাটা হল সবচেয়ে বড় সম্পদ, সেই ইনফরমেশন টেকনলজির কোন কিছু সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরের কোন এক বা একাধিক কোম্পানির হাতে তারা ছেড়ে দেবে বলে, তো মনে হয় না। যার মানে দাঁড়ায় যে এখানে একটাই মোবাইল কোম্পানি আছে, যার পুরোটাই কঠোর হস্তে নিয়ন্ত্রণ করে সরকার। অতএব সেই একমাত্র সরকারি কোম্পানিটির সাথেই যদি আমার দেশের মোবাইল কোম্পানিটির চুক্তি না থাকে, তা হলে তো আর কথাই নেই। কিন্তু অমন কিছু হয়েছে বলে তো মনে হয় না। এর মধ্যে দু ‘য়েকবার তো কাজ করেছে আমার ফোন !
এসময়েই ফের মনে পড়লো প্রাচীন চায়নার তৈরি মহা প্রাচীরের মতো ডিজিটাল চায়নার তৈরি করা, সেই সাইবার ব্যারিকেডের কথা। যার কারণে কি না, যেতে পারিনি গত কয়েকদিন ইন্টারনেটের সুপার হাইওয়েতে। অতি স্বাভাবিক যুক্তির পথ ধরে এবার তাই মনে হল, আচ্ছা তা হলে কি ঐ সাইবার ব্যারিকেডের মতো এখানকার মোবাইল কোম্পানিও তাদের সিস্টেমে এমন কিছু করে রেখেছে যাতে বিদেশী কোন ফোন নম্বর নিয়ে তাদের দেশে কেউ ঢুকে পড়লে, আর সেই নম্বরকে তাদের সন্দেহ হলে, স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ব্লক করে দেয় তারা সে ফোন অবলীলায়। আমার ক্ষেত্রেও কি তবে তাই ঘটল? কিন্তু আমি তো গোয়েন্দা ফোয়েন্দা জাতীয় ভয়ংকর কিছু না। বা এখানে আসার পর তাদের সন্দেহ হতে পারে বা আপত্তি থাকতে পারে এমন কিছু করিনি তো! তাহলে এমন হবে কেন? অবশ্য এখানে যখন তারা তাদের নিজেদের সাধারণ তো দূরের কথা এমনকি ক্ষমতাধর নাগরিকদেরও, ডিজিটালি বা অডিজিটালি কোন ভাবেই মুখ খুলতে দেয় না, সেক্ষেত্রে আমি তো বিদেশী অচেনা মানুষ!
মোটের উপর কথা হলো উপরের যে ক’টা সম্ভাবনা এ মুহূর্তে বিদ্যুৎগতিতে খেলে গেল আমার মনে, তার যে কোন একটির কারণেও যদি এই হাতফোনটি এ মুহূর্ত থেকে নিতান্তই একটা ক্যামেরা আর খেলার যন্ত্রে পরিণত হয়ে থাকে, তবে তো সবাইকে নিয়ে পরলাম এই হিমসাগরের অগাধ সলিলে। কোন ঝামেলায় পড়লে, কী করে করবো তবে যোগাযোগ ড্রাইভারের সঙ্গে বা মিস ইনার সাথে! এরকম সব ভাবনায় যখন তুমুল অনিশ্চয়তাজনিত দুর্ভাবনায় মন ভচকে গিয়ে, কুঁচকে গেছে কপালও, ঠিক তখনই, পৃথিবীর মধুরতম সঙ্গীতের সুরের মতোই বেজে উঠলো ফোনের রিং টোন, সাথে পর্দায় ভেসে উঠলো লি খানের নম্বর, গোটা গোটা ইংরেজি অংকেই।
ফলে এতক্ষণে যে একটা তুমুল চাপ তৈরি হয়েছিল মনে নিমিষেই তা উবে গেল গাড়ির ভেতরের গরম বাতাসে। তাতে নিজের অজান্তেই মুখে ফুটে উঠলো নিশ্চিন্ত হাসি! অতএব দ্রুত লি খানের নাম লিখে সে নম্বর ফোনের মগজে জমা করার ব্যবস্থা করতে করতে মুখে বললাম,ওকে গো। এতে বিন্দুমাত্র দেরী না করে, সাথে সাথেই আড়মোড়া ভেঙে নড়েচড়ে উঠল চায়নার মাটিতে আমাদের ভাড়া করা জাপানি শকট।
এদিকে সিট বেল্ট বাঁধতে বাঁধতে ভাবলাম, আচ্ছা আমাদের মনের গতি, মানে মগজের চিন্তার গতি কী, পদার্থবিদদের পরীক্ষা নিরীক্ষায় প্রমাণিত সবচেয়ে দ্রুতগতির যে আলো, তার চেয়েও বেশী নাকি? কতোক্ষণ যে লেগেছিল পাশের সিটে বসে থাকা লি খানের ফোনের ডাক আমার ফোনে পৌঁছুতে তা সঠিক না জানলেও, আর সে অপেক্ষার সময়টাকে আমার অনাদিকাল মনে হলেও, আদতে তো খুব জোর সময় হয় তো লেগেছিল ১০/১৫ সেকেন্ড। আর তাতেই কী না করে ফেলতে পারলাম আমি এতো সব চিন্তা! এমন দ্রুততার সাথে এতসব নানান চিন্তা করতে পারার সক্ষমতার জন্য নিজমনে আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলতে যাচ্ছি যখন, তখনই মনে হল, আচ্ছা এতো দ্রুত যে চিন্তা করতে পারলাম, তাতে লাভটাই বা হল কী আমার?
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্মরণের আবরণে পণ্ডিত বিজন কুমার চৌধুরী
পরবর্তী নিবন্ধকীর্তিতে অম্লান ইনসানে কামিল ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আবদুল খালেক