স্মরণের আবরণে পণ্ডিত বিজন কুমার চৌধুরী

দীপেন চৌধুরী | রবিবার , ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৫:২৪ পূর্বাহ্ণ

লয় সৃজনের কারিগর, দেশনন্দিত তবলাগুণী পণ্ডিত বিজন কুমার চৌধুরী। দেশের সঙ্গীত অঙ্গনের সবার প্রিয় বিজনদা ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে ১৯ সেপ্টেম্বর মৃত্যুকে অমৃত করে চলে গেছেন রাজকীয় প্রস্থানে। অমর্ত্যলোকে, মানবসমাজের অগম্য সুদূরে। যে সব মানুষ যুগপৎ কর্মী এবং ধ্যানী, তাদের কাছে ‘কর্মই ধ্যান, ধ্যানই কর্ম’। আমাদের বিজনদা এক্ষেত্রে সার্থক বিজ্ঞাপন। কারণ তিনি একজন কর্মযোগী মানুষ। যিনি শূন্য থেকে অনন্য কীর্তি সুনির্মাণে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন আমাদের জন্যে। তবলা ধ্যান, তবলা জ্ঞান করে লয়ের চর্চায় নিজেকে চূড়ান্তরূপে সমর্পিত করে তিনি তাঁর সময়ে হয়ে উঠেছিলেন তবলা শিল্পের সার্থক প্রাণপুরুষ। বিজনদার অনুভবে ‘শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পথ বড়ই কঠিন’। এখানে নিজেকে পুরোপুরি সমর্পিত না করলে, এর সাধনায় নিজেকে সম্পূর্ণ নিবেদিত না করলে সঙ্গীতের বিশাল মহাসাগর পাড়ি দেয়া অসম্ভব। তিনি সেটা বলতেন সবসময়। বিজনদা নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান। তবলার সাধনপথে তিনি পেয়েছিলেন সদগুরু। শিল্প পথযাত্রায় যেটা প্রবলভাবে উপযোগী। আর সঙ্গীত তো সর্বতোভাবেই গুরুমুখী বিদ্যা। বিজনদার জন্ম ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১৯ সেপ্টেম্বর অবিভক্ত বাংলার সঙ্গীত তীর্থ ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার আড়াইসিতা গ্রামে, এক বনেদি সঙ্গীত পরিবারে। তাঁর মাতামহ স্বর্গীয় বীরেন ব্যানার্জী ছিলেন এলাকার স্বনামধন্য তবলাবাদক। তাঁর পিতা স্বর্গীয় সমরেন্দ্র চৌধুরী একজন সঙ্গীত শিল্পী, অভিনয়েও ছিলেন পটু। আর মা পারুল বালা দেবী ছিলেন এস্রাজবাদক। তাঁর স্ত্রী ইলা চৌধুরী জননন্দিত নৃত্যশিল্পী ছিলেন। বিজনদার বোন মায়া চক্রবর্ত্তী কীর্তন গানে স্বনামধন্যা। যার রক্তে সঙ্গীত তিনিই তো হবেন সঙ্গীতের সার্থক উত্তরাধিকার।শৈশবের কথা। একদিন সন্ধ্যা আরত্রিক বিজনদার মন্দিরাবাদন শুনে সঙ্গীত রসিক যতীন সরকার তার বাবাকে বললেন, ‘ছেলের লয় জ্ঞান প্রখর, তাঁকে তবলা শেখানোর ব্যবস্থা কর’। বিজনদার বাবার একই কথা-‘ছেলে দুষ্টু, আগে স্থিতধী হোক’। তারপরও যতীন বাবুর পীড়াপীড়িতে তাঁকে পণ্ডিত শিবশংকর মিত্রের কাছে তবলায় ভর্তি করেছিলেন। বিজন চৌধুরীর লয়ের সাধনার সেই শুরু। এরপর শিবপুরের প্রখ্যাত উস্তাদ এরশাদ আলী খান হয়ে পরিণত বয়সে সঙ্গীতাচার্য জগদানন্দ বড়ুয়ার কাছে লয়কারী সাধন। তিনি ঠিকই স্থিতধী হয়েছিলেন লয়ে। তবলা সাধনে তাঁর নিষ্ঠা, শ্রম, অধ্যবসায় সর্বোপরি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রতি প্রবল আনুগত্যের কারণে তিনি হয়ে উঠেছিলেন ‘তবলা নেওয়াজ’। ভাবতে অবাক লাগে ষাটোর্ধ্ব বয়সে তিনি অন্যান্য শিক্ষার্থীদের সাথে পরীক্ষার হলে বসে ধ্রুব পরিষদের সপ্তম বর্ষে তবলার পরীক্ষায় অংশ নিয়ে প্রথম স্থান অধিকার করে ‘ছন্দ রত্নাকর’ উপাধি লাভ করেন। বিজনদা আজ আমাদের মধ্যে নেই। তাঁর মৃত্যুর শোক ও বেদনা আমাদের মন- মানসে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছে। তাঁর মৃত্যুতে তবলা শিক্ষণের ক্ষেত্রে বড় ধরনের শূন্যতার সৃষ্টি হলো যা অপূরণীয়। তথাপি তিনি রেখে গেছেন তার মেধা ও মননের গৌরবময় উত্তরাধিকার-অগণিত শিক্ষার্থী। পণ্ডিত বিজন চৌধুরী তারুণ্যের প্রকাশ ঘটিয়েছেন জীবন ও কর্মের সর্বত্রই। ছোট-বড় যেকোনো সঙ্গীতাসরেই তাঁর অংশগ্রহণ ছিল অপরিহার্য। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সম্মেলন (ঢাকা মিউজিক কলেজ) আয়োজিত এ উস্তাদ আকবর আলি খাঁ, উস্তাদ বাহাদুর খাঁ, উস্তাদ বিসমিল্লাহ খাঁ, বিদূষী স্মরণ মাথুর, পণ্ডিত কানাই দত্ত, পণ্ডিত মহাপুরুষ মিত্র, উস্তাদ আমির খাঁ, পণ্ডিত ভি. জি. যোগ প্রমুখের সাথে বাংলাদেশ থেকে সেতারে উস্তাদ মতিউল হক এবং তবলায় ছিলেন এই চট্টলার ছন্দভাস্কর বিজন কুমার চৌধুরী । ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের ১৯ সেপ্টেম্বর জীবনের শেষ সঙ্গীতাসরেও তেমনি স্বনামধন্য বাঁশীবাদক উস্তাদ আজিজুল ইসলাম’র সাথে যুগলবন্দিতে ছন্দের অনবদ্য ঝড় তুলে বাদনরত অবস্থায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন আমাদের বিজনদা। ক্লান্তি কখনো তাঁকে গ্রাস করেনি। লয়’র সৃজনানন্দে মত্ত থেকেই স্বর্গারোহণ করেছেন। বিজনদা ব্যক্তিগত জীবনে মৃদুভাষী, বিনয়ী, কিন্তু আচরণে স্পষ্টভাষী , কঠোর এবং ক্ষমাহীন। বেতারে শিল্পীরা রাশভারী বিজনদাকে দেখলেই ভয়ে তটস্থ থাকতেন, কিন্তু রেকর্ডিং স্টুডিওতে অন্য তিনি। একেবারে সু-সহযোগী । তাল ছন্দ হারালে বলে বসবেন ‘লয় আদর বোঝে না’। প্রায় প্রতিবছর ধু্রব পরিষদের সঙ্গীতে বিভিন্ন বিষয়ে পরীক্ষা গ্রহণ উপলক্ষে বিজনদার সাথে বিভিন্ন জেলায় যাবার সুবাদে বয়সের বড় ব্যবধান সত্ত্বেও তাঁর সাথে আমার সহজ অন্তরঙ্গতা গড়ে ওঠে। বিভিন্ন জেলা ভ্রমণকালে দর্শনীয় স্থানগুলো তাঁর দেখা চাই-ই- চাই। সেই সাথে ভোজনবিলাসী বিজনদার প্রিয় মাছের ঝোল আর নলের গুড়ের সন্দেশ। ট্রেনে যেতে যেতেই তিনি আমাদের লয়জ্ঞান আত্মস্থ করাতেন। প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন করতেন। না পারলে তাকে সিট বদল করতে হতো। পরীক্ষা গ্রহণ কালে কোনো পরীক্ষকের ভুল পরিলক্ষিত হলেই হোটেলে এসে শুধরিয়ে দিতেন। আমাদের বিজনদাকে ধ্রুব পরিষদ সম্মাননা প্রদান করে ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে। আমি যখন তাঁর সম্মতির জন্য বাসায় যাই, তখন তিনি আমাকে বলেছিলেন; আমি কিন্তু সম্মাননা নিতে যশোর যেতে পারবো না, শরীর খুব একটা ভালো না। আমরা সম্মাননা ঠিকই দিয়েছিলাম। কিন্তু সম্মাননা অনুষ্ঠানে স্মারক তাঁর হাতে তুলে দিতে পারিনি। এ দুঃখ বোধ দীর্ঘসময় পীড়া দেবে। পরিণত বয়সে সুবর্ণ ব্যক্তিত্ব বিজনদার এই বিদায় যেন ‘সূর্যাস্তের ছটায় মিশেছে রামধনু, সাত রঙে রঙিন হয়ে’। তাঁর কীর্তির গৌরব অমিলন থাকবে দীর্ঘদিন। কিন্তু সময়টা ক্রান্তির । ঐতিহ্য, ইতিহাস আর সংস্কৃতির প্রতি সামান্যতম দায়বদ্ধতা বা সবিশেষ প্রতিশ্রুতি নেই আমাদের। যা আছে তা শুধুই আমোদ গৌরব জীবনের যথেচ্ছ যাপন আর শুকনো তোষামোদ। তথাপি , এই অগ্রগন্য শিল্পীর প্রতি তাঁর যোগ্য সম্মান প্রদর্শনে কোনো শৈথিল্য যেন আমাদের বিন্দুমাত্র স্পর্শ না করে, অন্যথায় ভাবীকাল আমাদের ক্ষমা করবে না।
লেখক : সংগীতশিল্পী, সংস্কৃতি সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধহে আমার শৈশব!
পরবর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে