দলীয়ভাবে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা

কুমার প্রীতীশ বল | বৃহস্পতিবার , ২৫ নভেম্বর, ২০২১ at ৬:১০ পূর্বাহ্ণ

সদ্য স্বাধীন দেশ, আমি চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি। পাশের বাড়ির এক কাকা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন করছেন। সর্বত্র উৎসবমুখর পরিবেশ। প্রতিদিন সবাই চোঙা হাতে নির্বাচনী প্রচারে বের হতো। সবাই বের হলে আমি বাড়ির এমাথা, ওমাথা ঘুরে ঘুরে তাদের অনুকরণ করে স্লোগান দিতাম। আমার এমন উৎসাহে একদিন বড়রা আমাকে কাকার নির্বাচনী প্রচারে নিয়ে যায়। আমার অবস্থান কাকার সঙ্গে প্রথম সারিতে হলো। আমার একহাতে ছোট্ট এক টিনের চোঙা। আরেক হাত কাকার হাতে ধরা, যাতে হারিয়ে না যাই। আমিও সবার সঙ্গে চোঙা মুখে স্লোগান ধরি, ‘আমার ভাই, তোমার ভাই প্রভাস ভাই, প্রভাস ভাই।’ ‘প্রভাস ভাইয়ের মার্কা কি, মই ছাড়া আর কি।’ সবাই অধীক উৎসাহে আমার সঙ্গে স্লোগান ধরে। কাকা মেম্বার পদে নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন। আজকের মতো কাকার কোনো পোস্টার ছিল না। সেবার চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী হয়েছিলেন পাড়ার হরিমোহন মাস্টার। অংকশাস্রে তাঁর ব্যুৎপত্তি খুবই সমাদৃত ছিল। গেঞ্জি গায়ে, কাঁধে শার্ট ধুতি পরা হরিমোহন মাস্টারকে দূর থেকে চেনা যেত। খুব সাধারণ জীবনযাপন করতেন। সচ্ছল ছিলেন না, কিন্তুছাত্র পড়াতেন বিনা পয়সায়। ঋণ করে দরিদ্র ছাত্রের স্কুলের বেতন, পরীক্ষার ফি দিতেন। সেবার কারো প্ররোচনায় তিনি চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী হয়েছিলেন। অর্থাভাবে নির্বাচনী প্রচারও করতে পারেননি। আমার এক পিসতুতো দাদা হরিমোহন মাস্টারের স্নেহধন্য ছাত্র ছিলেন। তিনি চাকরিসূত্রে থাকতেন রামগড়। সেখান থেকে তিনি মাস্টারমশায়ের শুভ কামনা করে একখানা পত্র লিখলেন। ব্যস, ওটাই হয়ে গেল হরিমোহন মাস্টারের প্রচারপত্র। তিনি বাড়ি-বাড়ি, হাটে-বাজারে ঐ চিঠি পাঠ করে বাজিমাত করে দিলেন। চিঠিতে কি লেখা ছিল এখন মনে নেই। খুব উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। ফলে টেলিগ্রাম মারফত দাদাকে কিছুদিন বাড়ি না আসতে নিষেধ করা হয়েছিল। দাদা অনেকদিন বাড়িমুখী হননি। হরিমোহন মাস্টার সবাইকে অবাক করে দিয়ে উৎসবমুখর সেই নির্বাচনে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। নানামুখী চাপ কিংবা অন্য যেকোনো কারণে হোক হরিমোহন মাস্টার আত্মহত্যা করেন। কেউ বলল, আত্মহত্যা আবার কেউ বলল হত্যা। ময়না তদন্ত না হওয়ায় তাঁর মৃত্যু রহস্য উন্মোচিত হয়নি। তারপর আরও অনেক চন্দ্রভুক অমাবস্যা কেটে গেল। আমরা বঙ্গবন্ধুকে হারালাম।
বাংলাদেশে তিন স্তর বিশিষ্ট স্থানীয় সরকার বিদ্যমান। প্রথম স্তরের প্রশাসনিক একক বিভাগীয় পর্যায়ে কোনো স্থানীয় সরকার নেই। দ্বিতীয় স্তরের প্রশাসনিক একক জেলা পর্যায়ে জেলা পরিষদ, উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা পরিষদ এবং গ্রাম পর্যায়ে ইউনিয়ন পরিষদ, ছোট শহরে পৌরসভা আর বড় শহরে সিটি কর্পোরেশন হলো স্থানীয় সরকারের একটি অংশ।
‘স্থানীয় সরকার’ শব্দদ্বয় উচ্চারিত হলে মনে পড়ে জেনারেল জিয়ার গ্রাম সরকারের কথা। কৈশোরে গ্রাম সরকারের মাধ্যমেই আমাদের কাছে ‘স্থানীয় সরকার’ শব্দদ্বয় পরিচিতি লাভ করে। ১৯৮০ সালে জেনারেল জিয়া ‘স্থানীয় সরকার অধ্যাদেশ ১৯৭৬’ সংশোধনের মাধ্যমে গ্রাম সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। তখন দুষ্টলোকেরা জেনারেল জিয়ার গ্রাম সরকারকে গোপনে ‘গরম সরকার’ বলে ডাকত। গ্রামীণ যত টাউট-বাটপার-মাস্তান-গুন্ডা ছিল, সবার মিলন ক্ষেত্রে পরিণত হয় গ্রাম সরকার। ইউনিয়ন পরিষদেও তাদের দৌরাত্ম্য ছিল সীমাহীন। জেনারেল জিয়া গত হলে গ্রাম সরকারও বিদায় নেয়।
আমি সাবালক হলাম। সময়টা এরশাদের স্বৈরশাসনের শুরুর দিক। কলেজ পড়ুয়া তরুণ। সদ্য ভোটার হয়েছি। অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকি ভোট দেব। বছর ঘুরে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন আসে। ১৯৮৩ অথবা ৮৪ সালে প্রথম ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ভোট দিলাম। একবারই ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ভোট দিয়েছি। তখন দেখলাম, উৎসবমুখর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন সহিংস, রক্তাক্ত নির্বাচনে রূপ নিতে। তিনজন মিলে ব্যালট বাক্স পূর্ণ করে। একজন সিল মারে, একজন ছিঁড়ে, অন্যজন ব্যালট পেপার ভাঁজ করে বাক্স ভর্তি করে। বাকীরা কেন্দ্র পাহারা দেয়। বুথ দখল, কেন্দ্র দখল, অস্ত্রের মহড়া সবই প্রথম দেখলাম। ছাত্র নামধারী মাস্তানরা এক ইউনিয়ন থেকে অন্য ইউনিয়নে ভাড়া খাটছে। বেশিরভাগই ছিল এরশাদের অনুসারী। মাস্তান-গুন্ডা-পান্ডাদের সুবিধার্থে নাকি তখন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল কয়েক ধাপে। আমার চেনা-জানা অনেককে সেই নির্বাচনী সহিংসতায় যুক্ত হতে দেখে বিস্মিত হয়েছি। আমার এক সহপাঠিনীর ছোট ভাই আমাদের ইউনিয়নের নির্বাচনী সহিংসতায় নিহত হলে শোকসভায় দাঁড়িয়ে শপথ নিয়েছিলাম আর কখনও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সম্পৃক্ত হবো না।
১৯৮২ সালে এরশাদ স্থানীয় সরকার অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে উপজেলা পরিষদ গঠন করেন। একইভাবে রক্তস্নাত সহিংসতার পথ অনুসরণ করে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন হয়। নির্বাচনী সহিংসতা তখন নানা মাত্রা লাভ করে। এসব সহিংসতায় অংশগ্রহণকারীদের অনেকের সঙ্গে ছাত্র রাজনীতির কারণে পাশে বসতে হলেও ‘স্থানীয় সরকার’ নির্বাচনে আমি আর সম্পৃক্ত হইনি।
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনেকাংশে সহিংসতা মুক্ত হয় নব্বইতে এসে এরশাদের পতনের পর। সারাদেশে আবার উৎসবমুখর পরিবেশে একযোগে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। অনেকাংশে রক্তপাতহীন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে গুন্ডা-পান্ডাদের দৌরাত্ম্যের অবসান ঘটে। সে সময় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নিয়ে নানান ধরনের হাস্যরসাত্মক খবরাখবর আবারও শুনতে পায়। আবারও চায়ের দোকানে ঝড় তুলতে শুরু করে পত্রিকায় প্রকাশিত-‘দেবর-ভাবীর নির্বাচন’, ‘স্বামী-স্ত্রীর নির্বাচন’, ‘শাশুড়ি-বউয়ের নির্বাচন’ ইত্যাদি নানান সব মুখরোচক সংবাদ।
খালেদা জিয়ার শাসনামলে শুনলাম, ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং-এর কথা। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মহিউদ্দিন চৌধুরীর বিজয়কে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মাধ্যমে পাল্টানোর ষড়যন্ত্রের কথা ভুলবার নয়। সেদিন রাত জেগে জামালখান এলাকায় নির্বাচন কমিশন অফিস ঘিরে রেখে পাহাড়া দিয়েছিলাম। সে রাতে শহর চট্টগ্রামের কোনো মানুষই ঘুমায়নি। সবাই ঘরের বাইরে চলে এসেছিল। আন্দরকিল্লা, প্রেস ক্লাব এলাকা, জামালখান, কুসুমকুমারী স্কুল ছিল লোকে লোকারণ্য।
স্থানীয় সরকার নির্বাচন উন্মুক্তভাবে হওয়ার ধারা ভেঙে আওয়ামী লীগ সরকার দলীয় প্রতীকে সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত নেয়। এলক্ষ্যে ২০১৫ সালে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন-সংক্রান্ত পাঁচটি আইন সংশোধন করে।
২০১৫ সালের আগে পর্যন্ত ‘স্থানীয় সরকার’ নির্বাচন দলীয় প্রতীকবিহীন হলেও রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা তখনও ছিল। রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা ছিল নেপথ্যে। দলীয় ছায়া ছিল। নির্দলীয় নামে দলীয় নির্বাচন। রাজনৈতিক নেতারা নির্বাচন করতেন নিজস্ব ইচ্ছেয়। দলের অনুমতির প্রয়োজন হতো না। কেন্দ্রিয়ভাবে দল নিরপেক্ষ থাকলেও স্থানীয়ভাবে দলীয় নেতারা বিভিন্ন প্রার্থীর জন্য নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিতেন। তখন ছিল ব্যক্তির প্রাধান্য। ভোটার ভোট দিয়েছে প্রার্থী দেখে, প্রতীক দেখে নয়। রাজনৈতিক দলসমূহের এধরনের লুকোচুরি খেলা অগ্রহণযোগ্য।
দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুফল বহুবিধ। এর ফলে, তৃণমূল পর্যন্ত নেতৃত্বের বিকাশ ঘটবে। তৃণমূলের নেতারাও দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করবে। এর ফলে আগের চেয়ে বাধ্যবাধকতা বাড়বে। দলগুলো কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারবে না। এতে গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে। জাতীয় নির্বাচনের মতো এসব ক্ষেত্রেও পূর্ণাঙ্গ নির্বাচনী আমেজ আসবে।
আজ দেখছি, একটি ভালো উদ্যোগ নিয়ন্ত্রহীণতার কারণে বুমেরাং হয়ে গেল। দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন ব্যবস্থার কারণে তৃণমূল পর্যন্ত মনোনয়ন বাণিজ্য আর সহিংসতা পৌঁছে গেছে। পুরো প্রক্রিয়াটি কলুষিত হয়ে গেছে। এবারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সহিংসতা, দুর্বৃত্তায়ন অতীতের সব দৃষ্টান্তকে ছাড়িয়ে গেছে। কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ নেই। কেউ দলীয় কোনো নির্দেশনা মানছে না। আজ বাংলাদেশের রাজনীতি দুর্বৃত্তদের লুটপাটের সিন্ডিকেটে যে পরিণত হয়েছে, তার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে। দল হিসাবে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। এসব কারণে সরকারের সমর্থক একটি অংশের ভেতরেও সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা তৈরি হচ্ছে। মহাশ্বেতা দেবী লিখেছিলেন, ‘তুই যদি এত ভালো গভার্নমেন্ট হবি, তবে আমার এতো দুঃখ কেন?’ এ প্রসঙ্গে প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকার কথা উল্লেখ না করায় উত্তম।
আজকের রাজনীতিতে মেধার চর্চা নেই, ত্যাগীদের মূল্যায়ন নেই। দুর্বৃত্তায়নের মহোৎসব চলছে। নৈতিকতা ও মূল্যবোধের সংকট চলছে তীব্রভাবে। দল হিসেবে এবং সরকার হিসাবে আওয়ামী লীগ তা ঠেকাতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে আস্থার সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। এই আস্থাহীনতার কারণে কোনো উন্নয়নের সুফল ঘরে তুলতে পারছে না। সব ম্যাগা উন্নয়ন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে। সব উন্নয়ন কাগুজে উন্নয়নে পরিণত হচ্ছে। জনমনে প্রশ্ন সৃষ্টি হচ্ছে, যে উন্নয়ন নাগরিকের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়, সেই উন্নয়নকে উন্নয়ন বলা যায় কিনা? এখন ধরেই নেওয়া হচ্ছে, সরকারি দলের টিকিটে যিনি নির্বাচনে অংশ নেবেন, তিনিই জিতবেন। ফলে ভোটার ও সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে ভোট প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণে অনাগ্রহ তৈরি হয়েছে।এটা গণতন্ত্রের জন্য অশনি সংকেত। মানুষ নির্বাচন বিমুখ হয়ে পড়ছে। বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ীর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। ফলে নির্বাচনী সংস্কৃতি ধ্বংস হতে চলেছে। এতে অনেক ক্ষতি হচ্ছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সমাজে। এটা মেনে নেওয়ার মতো না। এজন্য দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনকেও দায়ী করা যায় না।
অনেক দেশে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয়ভাবে হয়। তাই ভাববার দরকার আছে। যেসব দেশে হয়, তাদের অভিজ্ঞতা জানতে হবে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন আবার নির্দলীয় করার কথা ভাবলে ভুল হবে। দলীয় বাধ্যবাধকতা না থাকলে সহিংসতা, দুর্বৃত্তায়নের মাত্রা আরও বাড়বে। শুধু ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নয়, আওয়ামীলীগকে গণতান্ত্রিক দল হিসাবে ভাবতে হবে সামষ্টিক দায়বদ্ধতা থেকে সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে। গণতন্ত্রের ভিত্তিকে সুসংহত করতে, তৃণমূল পর্যন্ত গণতন্ত্রের চর্চাকে নিরঙ্কুশ করতে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশকে তরান্বিত করতে হবে। দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন এই বিকাশের অংশ মাত্র। মাথা ব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলার প্রাচীন নীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। গণতান্ত্রিক সরকার হিসাবে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির পক্ষে সরকারের অবস্থানকে আরও স্পষ্ট করতে হবে। গণজাগরণ তৈরি করতে হবে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার

পূর্ববর্তী নিবন্ধনারী থাকুক নিরাপদে
পরবর্তী নিবন্ধকাল আজকাল