নারী থাকুক নিরাপদে

সুবর্ণা দাশ মুনমুন | বৃহস্পতিবার , ২৫ নভেম্বর, ২০২১ at ৬:১০ পূর্বাহ্ণ

‘চৌকাঠ ডিঙোতে গিয়ে আলোকিত হয়েছি
কারা যেন উপুড় করে রেখে গেছে অমৃতের পেয়ালা
শুষে নিয়ে এক ফোঁটা তার
আমরা হয়েছি অমৃতের সন্তান’।

বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামাল, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম; আমাদের সেই আলোকবর্তী নারীরা বাঙালি নারীর ভাগ্যাকাশ আলোকিত করার মানসে রেখে গেছেন তাদের শ্রমসাধ্য অমৃতের পেয়ালা। কিন্তু কতটুকু পরিবর্তন এলো আমাদের গড়পড়তা সমাজব্যবস্থা আর ব্যক্তিক চেতনার জগতে?
শাব্দিক মূল্যায়নে আমাদের বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম বলে আমরা দাবী করি। কেননা এখন আর কোনো নারীকে আগুনে ঝলসে স্বামীর সাথে সহমরণে গিয়ে পৈশাচিক মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করতে হয় না। এখন কোনো বাঁধা নেই বিধবা হবার কারণে পুনরায় বৈবাহিক সম্পর্কে জড়াতে কিংবা সাদা থান জড়িয়ে নিরামিষাশী শুচিতার বিড়ম্বনাও এখন নেই বললেই চলে। কিছুটা হলেও কমেছে নিজের সম্বন্ধে কিছু বুঝে উঠার আগেই অন্যের দায়িত্ব নেওয়ার (বাল্যবিবাহের) অভিশপ্ত প্রথার।
স্বচ্ছ চোখে এই অগ্রগতিগুলোর কথা আমরা মোটাদাগে বলে বেড়ালেও কোনো এক অদৃশ্য কারণে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘটে গেছে নৈতিকতার চরম অবক্ষয়।
লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা বা নারী নির্যাতন পৃথিবী জুড়েই রয়েছে এবং বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। এ ধরণের সহিংসতা নারীর শারীরিক, মানসিক স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্থ করার পাশাপাশি পরিবার, অর্থনীতি তথা সমস্ত সমাজ ব্যবস্থার উপরেও এক নেতিবাচক প্রভাব রেখে যায়। করোনা মহামারীর এই দুঃসময়েও শিশু থেকে বৃদ্ধা প্রতিটি বয়সের নারীই সমান ঝুঁকিতে বসবাস করছে, কি ঘরে আর কি বাইরে।
মহিলা পরিষদ ১৩ টি জাতীয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে নারী নির্যাতনের যে তথ্য সংগ্রহ করেছে, তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এ জরিপ মোতাবেক নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের মোট ৩৮ টি ধরণ রয়েছে- ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা, শ্লীলতাহানি, যৌননিপীড়ন, এসিড নিক্ষেপ, অপহরণ, নারী পাচার, যৌতুকের কারণে নির্যাতন, উত্যক্তকরণ ইত্যাদি।
চলতিবছর জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত প্রথম ৬ মাসেই নারী নির্যাতনের ঘটনা পাওয়া গেছে ১৭৯৪টি। এর মধ্যে ধর্ষণ ৫৭২ টি, গণধর্ষণ ১০৫টি, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ১৬ জনকে। শ্লীলতাহহানি ও যৌন নির্যাতন হয়েছে ৫৯ টি। প্রথম ছয় মাসেই সারাদেশে হত্যা করা হয়েছে ২২১ জন নারীকে। অপহরণ করা হয় ৯৫ জনকে। নারী নির্যাতনের এ সংখ্যায় প্রমাণ করে আমাদের সমাজ এখনো কতখানি পিছিয়ে আছে?
সংবাদ পত্রে প্রকাশের ভিত্তিতে যে সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটাই সব নয়। প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি। কারণ সংবাদপত্রে সব খবর আসেনা। ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি, যৌননীপিড়নের মতো ঘটনাগুলোতে মানুষ পুলিশের কাছে যেতে চাইনা, সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হবার ভয়ে। নির্যাতনকারী অনেক সময় এত বেশি প্রভাবশালী হয় যে, মামলা তুলে নিতে বা ধামাচাপা দিতে নির্যাতিত এবং তার পরিবারের উপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় বহুগুণে। এই অব্যাহত নারী নির্যাতন সামাজিক অবক্ষয়ের প্রতিফলন। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম বলেন, ‘নারী নির্যাতন মানবাধিকার লঙ্ঘন, এটি সবাইকে বুঝতে হবে। এ মানবাধিকার রক্ষার দায়িত্ব সরকার ও সমাজ উভয়ের’। পরিস্থিতির কারণে নির্যাতিত নারীদের মাত্র ২০ শতাংশ আইনের আশ্রয় নেয়। বিচারপ্রার্থীদের মধ্যে বিচার পায় মাত্র ০৪ শতাংশের কম নারী। আর তাই নারী নির্যাতন প্রতিরোধ করতে অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।
আজ আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস। শুরু হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষেরও। ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস পর্যন্ত বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে পালিত হবে এ পক্ষ। নারীর প্রতি সব ধরণের সহিংসতা প্রতিরোধে ১৯৮১ সালে ২৫ নভেম্বর লাতিন আমেরিকায় নারীদের এক সম্মেলনে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস পালনের ঘোষণা দেয়া হয়। বাংলাদেশে ১৯৯৭ সাল থেকে এই দিবস এবং পক্ষ পালন করা হচ্ছে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে।
জাতীয় মহিলা সংস্থার অধীনে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেল নামে একটি লিগ্যাল এইড সেল রয়েছে। ০৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটির মাধ্যমে সপ্তাহে ০২ দিন নির্যাতিত দুস্থ অসহায় মহিলাদের বিনা খরচায় আইনগত সহায়তা প্রদান করা হয়। তাছাড়া জেলা/ উপজেলা পর্যায়েও দুস্থ মহিলাদের আইনগত সহায়তা প্রদানের জন্য জাতীয় মহিলা সংস্থা প্রদত্ত ০২ জন আইনজীবী তালিকাভুক্ত আছে।
যোগাযোগের জন্য জাতীয় মহিলা সংস্থার ওয়েবসাইটে ভিজিট করতে পারেন: http//jms.gov.bd/. মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের আওতায় ১৯৮৬ সালে নির্যাতিত নারীদের সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে ১ জন আইন কর্মকর্তার সমন্বয়ে ৪ টি পদ নিয়ে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেলের কার্যক্রম শুরু হয়। রাজস্বখাতভুক্ত প্রকল্পটি বর্তমানে ৬ টি বিভাগীয় শহরে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
প্রতিটি নির্যাতন, প্রতিটি যৌন হয়রানিমূলক ঘটনায় সমাজের মূল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে নারী। ইনিয়ে বিনিয়ে তাকে দোষী সাব্যস্ত করার চেষ্টা চলতে থাকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। এই নির্যাতন নারীর অগ্রগতির পথে সবচেয়ে বড় বাধা।
সমাজের অর্ধেক জনসংখ্যাই নারী আর তাদের উপর এই নির্যাতনের প্রভাব সমাজে পড়বে এটাই স্বাভাবিক। তাই নারীর প্রতি এই সহিংসতা বন্ধ করতে সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে হবে। এমন একটি সমাজ বিনির্মাণ এখন শুধু আমাদের দায়িত্ব নয় কর্তব্যও যেখানে আর নির্যাতিত হবে না একটি নারীও।
লেখক : প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ, পতাকা এবং আমাদের বোধ
পরবর্তী নিবন্ধদলীয়ভাবে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা