কাল আজকাল

কামরুল হাসান বাদল | বৃহস্পতিবার , ২৫ নভেম্বর, ২০২১ at ১০:২১ পূর্বাহ্ণ

অপরিণামদর্শী মানুষ ও প্রকৃতির প্রতিশোধ

কিছুদিন ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে হাতির মৃত্যুর সংবাদ প্রকাশ পাচ্ছে। এরমধ্যে মঙ্গলবার একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশ পেয়েছে একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য। তা পাঠ করে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারা যাচ্ছে না।
চলতি মাসের প্রথম তিন সপ্তাহে দেশে সাতটি হাতিকে হত্যা করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি তিন দিনে একটি করে হাতি মারা পড়ছে। দেশে বছরজুড়েই কোনো না কোনো স্থানে হাতি হত্যা করা হয়। ২০০৩ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত দেশে বছরে হাতি হত্যার সংখ্যা ছিল তিন থেকে চারটি। এই সংখ্যা ইদানিং আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে।
জানা গেছে, কোনোমতে টিকে থাকা ২৬২টি হাতিকে রক্ষা করতে সরকার একটি মহাপরিকল্পনা তৈরি করেছিল। সেখানে ২০১৮ থেকে ‘২৭ সালের মধ্যে হাতির সংখ্যা দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। ২০১৯ সাল থেকে ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজও শুরু হয়েছে। কিন্তু অবাক কাণ্ড হচ্ছে এরমধ্যে দেশে হাতি হত্যা না কমে উল্টো বাড়তে থাকে। ২০২০ সালে দেশে ১২টি হাতি হত্যা করা হয়। আর চলতি বছর নভেম্বরের মধ্যে হাতি মারা পড়েছে ৩৩টি।
হাতি হত্যা বেড়েছে ২০১৭ সালে টেকনাফ, উখিয়ায়সহ আশেপাশে এলাকায় রোহিঙ্গা শরনার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার পর থেকে। কারণ যেসব এলাকা হাতির অভয়ারণ্য ও চলাচলের পথ ছিল সেসব এলাকায় বনাঞ্চল ধ্বংস করে জনবসতি গড়ে তোলা হয়েছে। আইইউসিএন বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর রাকিবুল আমীন গণমাধ্যমকে বলেন, রোহিঙ্গা শিবিরের ভেতর দিয়ে হাতির যাওয়ার একটি করিডোর তৈরির পাশাপাশি দেশে হাতির বিচরণের অন্য পথগুলো সুরক্ষিত করতে হবে। তিনি বলেন, আমরা রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দাদের সচেতন করে বেশ কটি হাতিকে প্রাণে রক্ষা করতে পেরেছি।
চলতি মাসে একাধিক হাতির মৃত্যুর এলাকা ঘুরে এসেছেন দুজন হাতি বিশেষজ্ঞ। তাঁরা সরেজমিনে গিয়ে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছেন। তারা জানান, হাতি হত্যায় দক্ষ একটি পেশাদার দল সামপ্রতিক সময়ে সক্রিয় হয়ে উঠছে। স্থানীয় বন দখলকারী একটি প্রভাবশালী চক্র ভাড়াটে এসব খুনিকে নিয়ে হাতি হত্যা করাচ্ছে। শেরপুর থেকে শুরু করে কঙবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রামে একই কায়দায় হাতি হত্যা চলছে বলে তাঁদের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে।
এশীয় হাতি রক্ষাবিষয়ক আন্তদেশীয় জোটের বিশেষজ্ঞ ও হাতি গবেষক মোস্তফা ফিরোজ সে দৈনিককে বলেন, এটা পরিষ্কার যে দেশের বিভিন্ন এলাকায় একটি সংঘবদ্ধ চক্র পেশাদার খুনি দিয়ে হাতি হত্যা করাচ্ছে। যেভাবে চলছে, তা এই মুহূর্তে থামানো না গেলে ২০২৭ সালের আগেই দেশ থেকে হাতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তিনি বলেন, হাতি রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা বন বিভাগ এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এ ক্ষেত্রে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। এই মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটিসহ সরকারের সর্বোচ্চ জায়গা থেকে হাতি রক্ষায় দ্রুত উদ্যোগ দরকার।
হাতি কীভাবে হত্যা করা হয় সে বিষয়ে বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, হাতি হত্যার পেছনে বন দখলকারী একটি চক্রকে তারাও পর্যবেক্ষণ করছে। ওই চক্র সংরক্ষিতসহ দেশের নানা ধরনের বনের ভেতরে দখল বজায় রাখার জন্য হাতি হত্যায় মেতে উঠেছে। কারণ, বনের ভেতরে গাছ কাটার পর সেখানে তারা ফসলের চাষ করছে। আর ওই ফসল পেকে ওঠার পর তা রক্ষায় তারা জমির চারপাশে বিদ্যুতের তার দিয়ে ঘেরাও দিয়ে দিচ্ছে। সরকারের পল্লী বিদ্যুৎ থেকে বিদ্যুৎুসংযোগ নেওয়ার পাশাপাশি জেনারেটরের মাধ্যমে তারা ওই তার বিদ্যুতায়িত করে রাখে। চলাচলের সময়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা পড়ছে হাতি।
বন বিভাগের বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত ২১ দিনে দেশে মারা যাওয়া সাতটি হাতির মধ্যে অন্তত চারটি বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যাওয়ার প্রমাণ তাঁরা পেয়েছেন। আর একটি হাতিকে সরাসরি গুলি করে মারা হয়েছে। সব কটি হাতি মারা গেছে বনের ভেতরে ও আশপাশের বসতি এলাকায়। গত এক বছরে মারা যাওয়া ৩৩টি হাতির মধ্যে অন্তত ২০টি মারা গেছে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি হাতির মৃত্যু হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে।
বেশ কয়েকবছর ধরে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান জেলার বিভিন্ন এলাকায় মাঝে মধ্যে হাতিরা তাণ্ডব চালায়, লোকালয়ে নেমে এসে সবকিছু তছনছ করে দেয়। এর আগে হাতির আক্রমণে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। ওইসব এলাকার মানুষ হাতি নিয়ে, তার তাণ্ডব নিয়ে শংকিত হচ্ছে বটে কিন্তু এর কারণ অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবছে না কেউ। পাহাড়ে হাতিদের আবাস ও খাদ্যের উৎসগুলো নির্মূল করা হয়েছে। গাছ ও পাহাড় কেটে কেটে বনাঞ্চল ধ্বংস করা হয়েছে। ফলে জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। বিপন্ন হতে চলেছে। সংরক্ষিত পাহাড়গুলো লিজ দেওয়া হয়েছে। ক্ষমতাবান মানুষরা সে পাহাড় লিজ নিয়ে সেখানে নিজের পছন্দানুযায়ী খামার গড়ে তুলেছে। প্রাকৃতিক নিয়ম ও পরিবেশ পরিবর্তন করে সেসব পাহাড় কেটেকুটে আম, আনারস, লেবুসহ নানা ফলের বাগান এবং নানা ধরনের খামার গড়ে তুলেছে। এভাবে দিনদিন পাহাড়গুলোর নিজস্বতা খর্ব করে বন্যপ্রাণিদের জীবন হুমকি ও বিপন্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। অন্য প্রাণিরা দুর্বল ও সংঘবদ্ধ নয় বলে তারা পারছে না। কিন্তু হাতি এই অনিয়মের, এই অনাচারের, এই প্রকৃতিবিরুদ্ধ কাজের প্রতিবাদ করে গেছে। তাদের সে প্রতিবাদ, ক্ষোভকে যদি এখনো ধর্তব্যে না আনি তাহলে ভবিষ্যতে আমাদের অনেক মূল্য পরিশোধ করতে হবে। অনেক প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।
প্রকৃতির নিজের একটা ভারসাম্য আছে, নিজের একটা শৃঙ্খলা আছে। যেমন, পার্বত্য চট্টগ্রামের বনাঞ্চলের প্রকৃতি, গঠন, প্রাণি ও উদ্ভিদবৈচিত্র ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইলের বনাঞ্চলের মতো নয়। আবার দেশের কোনো বনাঞ্চলের সঙ্গে সুন্দরবনের কোনো মিল নেই। এখন আমরা সবকিছুতে হস্তক্ষেপ করে তাদের নিজস্বতা যদি বিলীন করে দিই তাহলে তা হবে অদূরদর্শিতা এবং তাতে প্রকৃতি বিরূপ হয়ে যা ঘটাবে তাতে দিন শেষে মানবজাতিরই ক্ষতি হবে। কোন বনে বাঘ হবে কোন বনে হাতির বাস হবে সেটি নির্ভর করে বনের প্রকৃতি এবং সে প্রাণির খাদ্যের সহজলভ্যতার ওপর।
গত শতকের সত্তর দশকের দিকে দেশ থেকে ব্যাঙ রফতানির হিড়িক পড়েছিল। ব্যাঙ বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের বিরাট উৎস এমন প্রচারে দেশের মানুষ নেমে পড়ল ব্যাঙ শিকারে। আমাদের চারপাশে থাকা নিরীহ ব্যাঙ, যারা ক্ষেতের ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে ফসলকে সুরক্ষা দিতো সে উপকারী প্রাণি ব্যাঙ লোভী ও অপরিণামদর্শী মানুষের পাল্লায় পড়ে একেবারে নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে চলে গেল। এভাবে ব্যাঙের সংখ্যা কমে যাওয়ায় ফসলে পোকার আক্রমণ বেড়ে গেল। সে পোকামাকড় ধ্বংস করতে ক্ষেতে ছিটানো হচ্ছে কীটনাশক। যার প্রতিক্রিয়ায় মাছের প্রজনন ও বংশবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রাকৃতিকভাবে জমি উর্বরকারী প্রাণি কেঁচো বিলীন হওয়ার পথে চলে গেছে। এখন অনেকে কেঁচো উৎপাদন করে লাখ লাখ টাকা উপার্জন করছেন যা আগে সাধারণভাবে জমিতেই থাকতো।
এক্ষেত্রে চীনের একটি ঘটনার উদাহরণ দিচ্ছি।
মাও সে-তুং ১৯৫৮ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত চীনে ‘গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড’ নামে এক আন্দোলন শুরু করেছিলেন। তিনি দেশবাসীকে বলতেন, ইঁদুর, মশা, মাছি আর চড়ুই পাখি হলো মানুষের শত্রু। এসব মেরে ফেলতে হবে। মাওয়ের কথায় চীনের সবাই ইঁদুর, মশা, মাছি আর চড়ুই পাখি মেরে ফেলতে শুরু করল। সেনাসদস্য থেকে সাধারণ মানুষ, সবাই অংশ নিল এতে। ইঁদুর, মশা আর মাছি মারায় উপকারই হয়েছিল হয়তো। কিন্তু চড়ুই পাখি কেন মারতে হবে? মাও বললেন, চড়ুই পাখি খেতের শস্য খেয়ে ফেলে। তাই চড়ুই পাখিও মেরে ফেলতে হবে। নির্দেশ তামিল হলো; মারা হলো লাখ লাখ চড়ুই। তবে হিতে বিপরীত হলো। ফল পাওয়া গেল পরের বছরই। চড়ুই কমে যাওয়ায় বেড়ে গেল শস্য ধ্বংসকারী কীটের উপদ্রব। দেখা গেল, চড়ুই যতটা শস্য খেত, তার চেয়ে কীটের কারণে কয়েক গুণ বেশি ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চীন আবার পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে চড়ুই এনে বংশবৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছিল।
মানুষ মনে করে পৃথিবী নামক গ্রহটি শুধুই তাদের অর্থাৎ মানুষের। কাজেই মানুষের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করবে জগতের অন্য প্রাণিদের থাকা না থাকা। এটি করতে গিয়ে মানুষ প্রকৃতির ক্ষতিসাধন করেছে আর প্রকৃতি এখন রুষ্ট হয়ে প্রতিশোধ নিচ্ছে। মানুষকে ভালো থাকতে হলে জগতের সকল প্রাণিকে (উদ্ভিদেরও প্রাণ আছে) নিয়ে ভালো থাকতে হবে।
কভিড-১৯ মহামারী তো এই শিক্ষাটাই দিলো মানবজাতিকে।
লেখক : কবি-সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধদলীয়ভাবে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা
পরবর্তী নিবন্ধশিবির ক্যাডার বাঘা হামিদ অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার