নববর্ষ উৎসব : জাতীয় জীবনে নতুনকে আবাহন

ববি বড়ুয়া | বৃহস্পতিবার , ১৪ এপ্রিল, ২০২২ at ৭:২৩ পূর্বাহ্ণ

সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বয়স বাড়লেও শৈশবের ভালো লাগার মুহূর্তগুলো এখনো দগদগে তাজা হয়ে আছে স্মৃতির ক্যান্‌ভাসে। এখনো অনায়াসে মনে পড়ে সেই ফেলে আসা ছেলেবেলার মধুর শৈশব।এখনো মনে পড়ে ঠাম্মার তোড়জোড়ে গ্রামে যাওয়ার সময়গুলোর কথা।
মনে পড়ে চৈত্র সংক্রান্তির সময়ে পুরুষেরা কী ভীষণ সুন্দরভাবে রমণীর সাজে নেচে গেয়ে মানুষের মন মাতাতো পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে! সঙ সেজে পরিবেশন করতো বারো রকমের হাস্যরসাত্মক খবর। ছোট ছোট নাটিকার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতো সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়। তা কখনো ঘরে ঘরে ঘটে যাওয়া বৌ শাশুড়ির খুনসুটি মাখা ঝগড়া, কখনো হিজড়ার গানে তাদের কষ্টগাথা, কখনো বণিতা রমনীর চাপা যন্ত্রণা, কখনোও বা সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর বিষয়ে সচেতনতা মূলক নানা বিষয়। আর এই গান, নাচ কিংবা নাটিকার মাধ্যমে নেহায়েতই হাসি আনন্দের ছলে দিয়ে যেত গ্রাম কিংবা শহরের মানুষের সুখ দুঃখের কাহিনী, মানুষের মনুষ্যত্ব বিকাশে নানা রকম উপাদান। আর ঢোলের বাজনার সঙ্গে সঙ্গে জমায়েত হওয়া পাড়ার ছোট, বড়, আবাল, বৃদ্ধ।
আবার একই সাথে প্রতিটি ঘরের উঠোনে উঠোনে ছোটদের কুড়িয়ে আনা খড়খড়ি বা শুকনো ছোট ডালপালা একত্রিত করা জাক দেয়ার আয়োজন। সেই কুড়ানো খড়খুটোর গাদায় আগুন ধরিয়ে তার চারপাশ ঘুরে ঘুরে ছোট বড় সকলের গাওয়া আঞ্চলিক গান।
চৈত্র সংক্রান্তির এই আয়োজন শুধু যে নির্দিষ্ট শ্রেণি, পেশা বা ধর্ম, বর্ণের লোকেরা করতো তা কিন্তু নয়। বরং সকল সমপ্রদায়ের লোকেরাই একে অপরের পাড়ায় গিয়ে পালন করতো বেশ আনন্দঘন পরিবেশে। তখন হয়তো বুঝিনি কিন্তু এখন বুঝি। এটি ধর্মীয় কোন বিষয় নয় বরং একটি লোকাচার বা সংস্কৃতি ছিল যার মাধ্যমে মানুষের মনে শুভবুদ্ধির আনয়ন করা আর একই সাথে সকলের সাথে সকলের সমপ্রীতি স্থাপন করার চমৎকার কৌশল। আর তাই হয়তো সেময়ে ছিল মানুষে মানুষে, আত্মার সাথে আত্মার ঘনিষ্ঠতা ।
বাঙালির ফাগুন, চৈত্র প্রেম, বিরহ, মন ভাঙা, বিচ্ছেদ, অসুখবিসুখ – যাই বলিনা কেন, সবকিছুর জন্য সহজ সমাধানের আশা নিয়ে হিসেবে হাজির হতো চৈত্র সংক্রান্তি। আজ আর সেই সঙ নেই, সঙযাত্রাও নেই আছে শুধু সংক্রান্তির কিছু চিহ্ন মাত্র। ক্রান্তিকাল কাটিয়ে বাঙালির নতুন জীবনে প্রবেশের জায়গা করে নিয়েছে বৈশাখ।
বৈশাখের কথা মনে এলেই মনে পড়ে বৈশাখের আনন্দ উৎসবের আমেজে সাজানো ডিসি পাহাড়ের কথা। চট্টগ্রামের মানুষ বৈশাখে ডিসি পাহাড়ের সাংস্কৃতিক আয়োজনে অংশ নেবেনা তা হতে পারে না। বিয়ের আগে দূর থেকে গাড়ি নিয়ে আসতে হলেও বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়ি এই পাহাড়ের নিচে হওয়ায় সকালে ঘুমই ভাঙতো ডিসি পাহাড় থেকে একঝাঁক তরুণ- তরুণীর কন্ঠে ভেসে আসা রবি ঠাকুরের গানের সুর, ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো।’ এমন মিষ্টি গানে ঘুম ভাঙা সকাল কতোই না মধুর ছিল! বারান্দায় দাঁড়ালেই দেখা যেতো বর্ণিল সাজে তরুণ, তরুণী, ছোট ছোট শিশু তাদের পিতা মাতার হাত ধরে ধীর গতিতে পাহাড়ের দিকে এগিয়ে চলা। তখন আমাদেরও বেশ শুরু হয়ে যেত নতুন শাড়ি, চুড়ি গায়ে জড়িয়ে তাদের সাথে যোগ দেয়ার তাড়া। যারাই আগে পৌঁছাতো তারাই আসন পেতো খুব সহজে পাহাড়ের গায়ে ইট পাথরে বাধানো বসার জায়গায়। এতে খুব কাছে থেকে পাওয়া যেতো বৈশাখকে ঘিরে গান, নাচ উপভোগের সুযোগ। কী অদ্ভুত সুন্দর আবহ ছিল! সাদা, লাল বিভিন্ন রঙে শাড়িতে মিলিয়ে পরা কাঁচের চুড়ি সাথে খোঁপায় গোজা কাঁচা ফুল, কপালে টিপ, নানা রঙের গয়না। পুরুষের সাজে পাঞ্জাবী। কতো নারী পুরুষের এমন উৎসবের বর্ণিল আয়োজনে ঘটেছে তাদের মনের যোগ, আঁকা হয়েছে নতুন স্বর্ণালী দিনের স্বপ্ন! ছোট, বড় নানা বয়সী মানুষের আগমনে মুখর হয়েছে ডিসি পাহাড়। আবার একটু পর পর দোকান বসেছে বৈশাখী সাজে নানা বাহারি মুখোশ, শোলার পাখি, টেপা পুতুল হাতে হাতে নিয়ে ঢাক-ঢোল-বাঁশির দোকান। একই সাথে বসেছে গ্রীষ্মের দাবদাহ হতে মুক্তির মহৌষধ পান্তা- ইলিশ। বাঙালি পান্তা ইলিশ ছাড়া বৈশাখ উদযাপন চিন্তারও বাইরে।
আর চট্টগ্রামবাসীর বৈশাখ মানে লালদিঘির ময়দানে জাব্বার মিয়ার বলী খেলার কথা বাদ দিলে চলে না। আর একে ঘিরে জমে ওঠা মেলা, যাতে পসরা সাজিয়ে বসে বিভিন্ন জেলায় বাঙালির ঘরে ঘরে তৈরিকৃত মাটি, কাঠ, বেতের নানা ধরনের গয়না, বাসনকোসন, পুতুল, মটকাসহ নানা বাহারি জিনিসপত্র ।আর এর মাধ্যমেই অর্থনীতির সচল চাকায় ভর করে তৈরি হয় প্রতি জেলার সাথে সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও কৃষ্টির আদানপ্রদানের সেতুবন্ধন ।
বৈশাখের সঙ্গে বাংলাদেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক সম্পর্ক যেমন নিবিড়, তেমনি অর্থনৈতিক সম্পর্কও তাৎপর্যপূর্ণ। পহেলা বৈশাখ ও নববর্ষ বাঙালির বিজয় পতাকা আকাশে তুলে ধরে। বাঙালির এই বিজয় হচ্ছে সংস্কৃতির বিজয়। এই সাংস্কৃতিক বিজয়ের ফল ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে বাঙালির এই সর্বজনীন উৎসব। ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের উদ্যোগে পহেলা বৈশাখে এ মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন শুরু হয়। ১৯৯১ সালে চারুকলার শোভাযাত্রা জনপ্রিয়তায় নতুন মাত্রা লাভ করে। বাঙালি জাতির জীবনে বাংলা নববর্ষ অন্যতম অসামপ্রদায়িক সর্বজনীন উৎসব।
কিন্তু বর্তমান অবস্থা বিবেচনা করলে বাঙালি আর বাঙালি থাকতে পারছে কোথায়? শাড়ি, চুড়ি, টিপ বাঙালি নারীর অহংকার, তার স্বাধীন মনের অলংকার। ধর্মের নামে ভুল ব্যাখ্যার ভ্রান্তিতে আটকা পড়া সহজ -সরল বাঙালি আঘাত হানছে নিজেদের কৃষ্টি, নিজেদের সংস্কৃতিতে। হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে পদে পদে। মাত্র কদিন আগেই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক লতা সমাদ্দার কেন টিপ পরেছেন, এই নিয়ে এক পুলিশ সদস্যের অবমাননাকর আচরণ যা জাতির বিবেককে নাড়া দিয়েছে। আবার মুন্সীগঞ্জের বিজ্ঞানের শিক্ষক হৃদয় মণ্ডল, যিনি ধর্ম ও বিজ্ঞান বিষয় দুটোর উপজীব্য কী, তা বোঝাতে গিয়ে পূর্ব পরিকল্পিত যোগসাজশে কারাগারে যেতে হয়েছে। শিক্ষার্থী ও স্কুল কর্তৃপক্ষের করা মামলায় এই শিক্ষককে কারাগারের পাঠিয়ে দেশকে, দেশের আইন কিংবা আমাদের সংবিধানের চার মূলনীতির জাতীয়তাবাদকে করেছে প্রশ্নবিদ্ধ।
আমরা জানি, পাকিস্তান গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার দাবি উত্থাপন করেন। ভাষা আন্দোলনে বাঙালি হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সবাই অংশ নিয়েছিল, যেমন মুক্তিসংগ্রাম ও যুদ্ধে বাঙালি – অবাঙালি – নানা জাতিগোষ্ঠীর নারী-পুরুষ হিন্দু মুসলিম অংশ নিয়েছিল। এমনকি ‘বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী’সহ ইতিহাসের যেসব ১৯৪৭-৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের সূচনার বিবরণ পাই, তা থেকেও জানতে পারি, শেখ মুজিব ঢাকায় এসে প্রথমে অসামপ্রদায়িকবাদী আন্দোলন শুরুর পক্ষে কাজ করতে শুরু করেন। যা ৭ মার্চের ভাষণে স্পষ্ট। তিনি বলেছিলেন, ‘শত্রুবাহিনী ঘরে ঢুকে পড়েছে। নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটপাট করবে। এই বাংলায় হিন্দু -মুসলিম, বাঙালি -অবাঙালি ভাই ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আমাদের।’
তবে এখন কেন এমন পরিস্থিতি এই বাংলার? কেন মানুষ নিজের দেশেই স্বাধীনভাবে শান্তিতে বসবাস করতে পারছে না? তবে কি এই বাংলার সমপ্রীতি নষ্ট করতে, দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে পুরাতন শত্রু নতুন মোড়কে আবার ঘরে ঢুকেছে? নিরাপত্তার দোহাই কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কথা বলে যতদূর সম্ভব সীমিত করে ধীরে ধীরে নিষ্ক্রিয় করে দেয়া হচ্ছে এই সমস্ত বাঙালির কৃষ্টি, সংস্কৃতির ধারক বাহক নানা উৎসব। পরোক্ষভাবে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে বাঙালির প্রাণের উৎসবে মেতে ওঠার দিনগুলোকে।
১৯৭১-এ বাঙালি স্বপ্ন দেখেছিল স্বজাতির শাসনে সুখী ও সমৃদ্ধিশালী জীবন গড়ে তোলার। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতির এই নৈরাশ্য কাটাতে জাতীয় জীবনে নতুনকে আবাহন এবং নতুন চেতনাকে প্রতিষ্ঠিত করতে সংস্কৃতি চর্চার কোনো বিকল্প নেই। আর বাঙালিকে তার সাংস্কৃতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে, ঐক্যবদ্ধ করতে, সম্মিলিত প্রাণের আবেগ সৃষ্টি করতে আসে বৈশাখ, নববর্ষ। পুরাতন সকল গ্লানিকে দূর করে নবজীবনের আলোয় উদ্ভাসিত করার উৎসব এই বর্ষবরণ। বাংলা নববর্ষ আমাদের সংস্কৃতির আশানুরূপ বিস্তার ও বিকাশে সহায়ক হোক, প্রেরণার উৎস হোক, গৌরবময় ইতিহাসের চালিকাশক্তি হোক, ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হোক–এই প্রত্যাশা রেখে আবারো আমরা সেই আগের উৎসাহ আর উদ্দীপনায় সমস্বরে গাইতে চাই, এসো হে বৈশাখ, এসো এসো…। লেখক : প্রাবন্ধিক; অধ্যাপক, ওমরগণি এমইএস কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাঙালির স্বতন্ত্র সংস্কৃতির পরিচয় ঘটে এই বর্ষবরণ উৎসবের মাধ্যমে
পরবর্তী নিবন্ধশান্তি ভালোবাসা ও মানবিক ঐক্যের সুরধ্বনি