শান্তি ভালোবাসা ও মানবিক ঐক্যের সুরধ্বনি

ডা. প্রণব কুমার চৌধুরী | বৃহস্পতিবার , ১৪ এপ্রিল, ২০২২ at ৭:২৩ পূর্বাহ্ণ

“ নববর্ষ দরোজায় ঝুলছে / হারগেঁজা ফুলের মালায়। ক্রমশঃ জাদুঘরে ফিরে যাচ্ছে সামাজিক ঢেঁকি / সেই পা তোলা পা ফেলা ছন্দময়তা / খইয়ের ছাতু পরিমাণে কমছে অথচ /একটি রিক্‌্‌শা ও এগারোজন পোষ্য নিয়ে / ‘মুখে বিউ’- জ্যোতিষ শাস্ত্র বটে। তবুয়ো গতরাতে পুড়েছে জাঁক; ভুল ও দুঃখ, / গায়ে হলুদ মেখে স্নান শেষে কেটেছে শত্তুর-খুলেছে হালখাতা।”- এদিগ্‌কার বাংলার গ্রাম জনপদে লোকজ বর্ষবরণের চিত্রকল্প এটা।
নববর্ষ এল বলে। পরিবার-প্রতিবেশি সবাই কর্মব্যস্ত। পাড়া-গ্রাম কর্মমুখর। সবখানে উৎসব আনন্দের উপচানো ঢেউ। চৈত্র মাস ঢোকার সাথে সাথে কর্মযজ্ঞের শুরু। গ্রামের প্রায় গেরস্থ পরিবারে পৈঠার একদিকে ঢেঁকি। পাড়া-প্রতিবেশিরা এক একদিন পালা করে এক এক বাড়িতে প্রায় সারা রাত জেগে ছাঁচে ফেলে ঢেঁকিতে ছাঁচা খইয়ের ছাতু, গুড়, চাউলের গুঁড়ো ইত্যাদি দিয়ে নাড়ু বানিয়ে দিয়ে আসতেন। আর এসব খৈ, নাড়ু, আট-করাই, পিঠা-পুলি টিনের বাক্সে করে পাঠানো হতো ঝি-জামাই,বেয়াই-বেয়াইন, আত্মীয়-পরিজনের বাড়িতে ।
চৈত্র সংক্রান্তি প্রবেশের আগ থেকে ঘরদোর বাড়ি-বারান্দা ছাদ সব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে তোলা হয়। বোয়ালখালি এবং পটিয়ার সীমানারেখা ধরে করলডেঙ্গা পাহাড় ছেড়ে এঁকে-বেঁকে নয়া হাটের ধার ঘেঁষে হারগেঁজি কালের প্রবাহ স্রোত। এই খালের বাঁকে বা কিনারে বছরের এই দিনগুলোর মাহাত্ন্য বাড়িয়ে কাঁটা-পাতার ঝোপ-গাছে অনিন্দ্য শোভায় মুগ্ধতার আবেশ ছড়িয়ে নীল বর্ণ হারগেঁজা ফুলের ফুটে থাকা।
সংগ্রহকৃত হারঁেগজা ফুল সুঁই-সুতোর মালায় গেঁথে টাঙানো হয় বাড়ির দরজা, জানালা, আলমারি, পড়ার টেবল-চেয়ার সব আসবাবপত্রে। যেন সবখানে মঙল-স্পর্শ লেগে থাকে। তবে প্রধান দরজার ফটকে ঝোলানো নববর্ষের মালা বিশেষ যত্ন নিয়ে দৃষ্টিনন্দনভাবে তৈরি করা হয়। বিউ ফুল, কাঠগোলাপ, হারগেঁজি ফুল ও দুই পাশে নিম পাতার ডাল দিয়ে সজ্জিত।
চৈত্র সংক্রান্তির দিন গরু, ছাগল এসব পোষা প্রাণীও ফুলমালা, তাদের মাথায় কলার খোসার ফুল-মুকুট পরিয়ে পাশের খালে স্নান করানো। এ যেন সবকিছুকে নতুনের ছোঁয়ায় বিভূষিত করা। পূণ্য-ধন্য করা। পরিবারের সদস্য-সদস্যারা হারগিলা-হলুদ বাটা তেল গায়ে মেখে স্নান করে রাস্তার মুখে শত্তুর বা রিপু কেটে আসে। প্রত্যেক বাড়ির উঠোনো বিষ-কাঁটালি, বেত লতা, খড়, আমিলাইশ ও নানা তৃণাদি দিয়ে স্তূপ বানিয়ে জাঁক তৈরি করে পোড়ায়। তার চারপাশে ঘুরে ঘুরে ঘরের আবাল-বৃদ্ধবণিতা আগুনের ধোঁয়া গায়ে লাগিয়ে সুর করে বলতে থাকে- ‘ উতর পাঁড়াইগাা পোয়ারে, দইন পাঁড়াইগা পোয়ারে / খঁচ-পাঁচুলি লয় যা রে / টেঁয়ার থইলা দি যা রে’। পুরাকালে নিশ্চয় এ সময়টাতে খোঁচ-পাঁচড়া রোগের প্রাবল্য থাকতো, আর্থিক সংগতিও ততো ভালো ছিল না- তা এই বয়ানের আর্তিতে স্পষ্ট। সে কারণে এসব রোগ-ব্যাধি যেন পাশের পাড়ায় কেউ এসে নিয়ে যায়, ঘরেও যাতে আর্থিক উন্নতি ঘটে- এ কামনা থেকে তখনকার গাথা, সামাজিক শ্লোক-বচন। জাঁক পোড়াবার সময়কাল হলো সন্ধ্যালগ্ন ও প্রত্যুষ-সূর্য ওঠার আগে। বিশ্বাস নিম ডাল জ্বালানো এ আগুনের পরশ রোগহর। বলা বাহুল্য বেশ আন্তরিকতার সাথে এ সুর-কথা উচ্চারিত হয়।
চৈত্রসংক্রান্তির দিনে বিশেষ ধরনের একটা নিরামিষ রান্নার নাম পাচন বা পাজন, স্থানীয় নাম আঢোড়া। এতে সজনে আঁঠি, কলার থোড়, কাঁঠালের মুচি, ডুমুরের ফল, নানা শাক্‌-সবজী সহ প্রায় ছাপ্পান্ন, কেউ কেউ বলেন একশ আট পদ মিলিয়ে এই নিরামিষ তরকারি তৈরি করা হয়। এক বাড়ির রান্না পড়শিদের বিিড়তেও পাঠানো হয়ে থাকে।
বস্তুত নতুন বছরের উৎসবের সঙ্গে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতির নিবিড় যোগাযোগ। বছরের নতুন দিন পুকুরে-দীঘিতে জাল পড়ে। ধরা হয় রুই-কাতলা-চিংড়ি-পুঁটি সহ হরেক রকমের মাছ। সকালে মা-বাবা, বড়জনদের পা ছুঁয়ে প্রণাম করে আশীর্বাদ চাওয়া, তাঁদের মান্যতা দিয়ে চলাফেরা বাঙালির শ্বাশত প্রচলিত রীতি। তাই নববর্ষ, ঈদ-পূজো এরকম পূণ্য দিনে মা-বাবার অনুপস্থিতির বেদনা বড় বাজে।
গ্রামে মানুষ ভোরে ঘুম থেকে ওঠে, নতুন জামাকাপড় পরে এবং আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে বেড়াতে যায়। আশ-পাশের পাড়া থেকে অনেকে আসেন। তাঁদের নাড়ু পায়েস-মিষ্টান্ন এসব দিয়ে সাদর আপ্যায়ন করা হয়। শৈশব চোখে দেখা-ঈদের দিনে তাঁরাও এসব পাড়া-পড়শি জনের বাড়িতে রং-বেরঙের সেমাই, ফিরনি এরকম নানা স্বাদের খাবার পাঠাতেন ।
আনন্দ-দিন এখানে থেমে থাকে না। কাছে-দূরে অনুষ্ঠিত হতো সূর্য খেলা, সন্ন্যাস খেলা এ রকম নানা বৈশাখি মেলা। যেখানে অনবরত বাঁশি বাজে, নানা রঙের বেলুন উড়তে থাকে। এ-দোকান ও-দোকান ঘুরে ঘুরে , হাঁটতে হাঁটতে কাওয়া-বগার ঠ্যাং, গরম গরম মালপোয়ার আস্বাদন। লাল-সবুজ-কমলা রঙের আইসক্রীম, মাঠাই, তরমুজের ফালি, খিরা এসব খেয়ে তপ্ত দিনের তৃষ্ণা নিবারণ। চোখ সেঁটে বায়োক্সোপ দেখার উত্তেজনা, কিংবা নাগরদোলা চড়ার অনন্য মজা। হৈহৈ রব। হাঁড়ি-পাতিল-মাটির কলসী, লক্ষ্মীর ভান্ড, ঝাঁটা-পিছা, ঘরের এসব নিত্য ব্যবহার্য জিনিস পত্রের ক্রয়-বিক্রয়। কখনোবা থাকে গ্রামীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন।
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে বছরের নতুন দিন ঘিরে পালিত হয় ত্রিপুরাদের বৈসুক, মারমাদের সাংগ্রাই ও চাকমাদের বিজু উৎসব। যৌথভাবে বর্তমানে যা ‘বৈসাবি উৎসবে’ পরিণত। কাছাকাছি সমতলভুমিতে উদ্‌যাপিত বর্ষবরণের মতো এখানের অনুষ্ঠানমালাও তিনদিনব্যাপী। তবে এক্ষেত্রে মারমাদের পানি উৎসবের স্বাতন্ত্র বেশ লক্ষণীয়।
পয়লা বৈশাখ ঐতিহ্যগতভাবে সূর্যোদয় থেকে শুরু। গ্রেগরিয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে বাংলাদেশে প্রতিবছর ১৪ এপ্রিল এই উৎসব উদ্‌্‌যাপন। ঢাকায় বৈশাখী উৎসবে মঙ্গল শোভাযাত্রা, রমনা অশত্থমূলে সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামে পয়লা বৈশাখ উৎসবের মূল কেন্দ্র ডি.সি হিল পার্কে সঙ্গীতানুষ্ঠানে নতুন বছরের সূর্যকে আহ্বান-এসব হলো বাঙালি বর্ষবরণসূচির আধুনিক রুপান্তর। পৃথিবীর নানান দেশে প্রবাসী বাঙালিদের পয়লা বৈশাখ উদ্‌্‌যাপন তারই ধারাবাহিকতা।
বর্ষশেষ, বর্ষবরণের একালের শহুরে রুপ কিছুটা ভিন্ন প্রকৃতির। এখানের জনস্রোত মূলতঃ তারুণ্যের উচ্ছাসে ভরপুর। পহেলা বৈশাখে ছেলেরা পাজামা-পাঞ্জাবি, মেয়েরা শাড়ি, হাতে চুড়ি, কপালে টিপ, মাথায় ফুল বেঁধে উৎসব রঙিন হাসে সাজে। কেউ কি তখন বনলতা স্মরণে বিমুগ্ধ চিত্ত বলে ওঠে-‘ হাজার বছর কেন হাঁটা, নাটোর বা সমুদ্র বিহারে / যদি তার মেলে দেখা প্রভাতির ডি.সি হিলে আহা রে ’! কয়েকটি স্থানে মিলিত এলাকায়, কোনো খোলা মাঠে আয়োজন করা হয় নানা রকম কুটির শিল্পজাত সামগ্রীর বিপণন সমৃদ্ধ বৈশাখি মেলার। থাকে নানা রকম পিঠা-পুলির আয়োজন, ও অনেক স্থানে ইলিশ মাছ দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা।
বাংলা নববর্ষ সকল বাঙালি জাতির ঐতিহ্যবাহী বর্ষবরণের দিন, বাঙালি জাতিসত্তার বিশ্ব পরিচয়ে যে মুকুট, তার শ্রেষ্ঠ হিরক খণ্ড। চোখের পাতার ওপর দিয়ে সময়ের স্রোত বয়ে চলে। তাতে কথা থাকে, ছবি থাকে। সেকালের প্রবাহ নতুন কালে নতুন গতিপথে অগ্রসরমান। দ্বিধা নেই-শৈশবের হারগেঁজি খালের মতো গ্রামের মেলা ও নববর্ষ আয়োজন অধুনা শীর্ণতর। ‘মানুষের ব্রত বড় কঠিন’- রবীন্দ্র আপ্ত-বাক্যের বিশ্বাসে যেন টান না পড়ে। মা-মাটি অন্তরের বস্তুকে বির্সজন দেওয়া মেকি উৎসবের ভুত-চোখ রাঙানিয়া নিশ্বাসে যেন ক্ষযে না যায় সবুজ ভবিষ্যৎ প্রজন্ম-‘ওই নূতনের কেতন ওড়া কাল্‌-বোশেখির ঝড়’।

বর্ষবরণ সেকালে যেমনটা আবহমান বাঙালি সংস্কৃতির প্রধান আনন্দোৎসবে সমুজ্জ্বল ছিল, বৈশ্বিক পরিচয়ে এই সময়েও যেন তা আরও সর্বজনীন মঙ্গল সমাচার নিয়ে উদ্‌যাপিত হয়- বঙ্গবন্ধুর জয় বাংলা বাংলাদেশে। স্বাগত ১ বৈশাখ ১৪২৯- সোনালি সূর্যোদয়। আমাদের প্রাণের প্রদীপ্ত শিখা। করোনা বিপন্ন পৃথিবী মুখরিত হোক শান্তি ভালোবাসা ও মানবিক ঐক্যের সুরধ্বনিতে। ‘শুভ নববর্ষ’।

লেখক : প্রফেসর ও সাবেক বিভাগীয় প্রধান, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনববর্ষ উৎসব : জাতীয় জীবনে নতুনকে আবাহন
পরবর্তী নিবন্ধবাংলা নববর্ষ : অসাম্প্রদায়িক ও বিশ্বজনীন মানবতাবোধকে এগিয়ে নেওয়ার প্রাণশক্তি