বাঙালির নিখাদ সংস্কৃতির শনাক্ত-প্রতীক নববর্ষ

ড. মো. সেকান্দর চৌধুরী | শুক্রবার , ১৪ এপ্রিল, ২০২৩ at ৫:২৫ পূর্বাহ্ণ

বাংলা নববর্ষ এমন এক উৎসব যা বাঙালির একান্ত নিজস্ব। পহেলা বৈশাখবর্ষবরণ নিখাদ বাঙালির। ধর্মগোত্রবর্ণশ্রেণি নিরপেক্ষ এই পার্বণ এমন এক সাংস্কৃতিক উৎসব, যার মধ্যে বিদ্যমান আবহমান বাংলা ও বাঙালির ঐতিহ্যিক মহিমা এবং সম্প্রীতির মেলোৎসব। নববর্ষ বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেও পর্যায়ক্রমে তা বৃহত্তর নাগরিক পরিমণ্ডলে পরিব্যাপ্ত হয়েছে। পাশ্চাত্যে যেমন ‘নিউ ইয়ারস ডে’, মধ্যপ্রাচ্যে নওরোজ, তেমনি বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতির শনাক্তপ্রতীক নববর্ষ। নববর্ষের এই উৎসব বর্ণাঢ্য ও ব্যাপকভাবে একাত্ম হয়েছে বাঙালির ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক, আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও সামষ্টিক জীবন প্রবাহে। বৃহত্তর গ্রামবাংলার নৈসর্গিক আবহ থেকে নগরজীবনের যান্ত্রিকতায়, পাহাড়েসমতলে বর্ষবরণের উৎসবমুখর দৃশ্যপটে বস্তুত বাঙালিত্বেরই মহিমা প্রকাশিত হয়।

বাঙালি মূলত উৎসবপ্রবণ জাতি। বাংলার মানুষের জীবন ও জীবিকায় রয়েছে বারো মাসে তেরো পার্বণ। এর মধ্যে রয়েছে ধর্মীয় উৎসব। যেমন ইসলাম ধর্মালম্বীদের ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, সনাতন ধর্মালম্বীদের দুর্গাপূজা, বৌদ্ধ ধর্মের বুদ্ধপূর্ণিমা। কিন্তু সকল ধর্মবিশ্বাসীদের সর্বজনীন পার্বণ হলো বাংলা নববর্ষ উদযাপন।

বাঙালির জীবনপটে বর্ষবরণের দীর্ঘ ঐতিহ্য থাকলেও বিদ্যমান নববর্ষ বা বাংলা বর্ষপঞ্জি রূপায়নের স্থপতি হলেন মুঘল সম্রাট আকবর। পূর্বে নববর্ষ পালিত হতো ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে। মুঘল শাসনামলে আরবি হিজরি পঞ্জিকা অনুযায়ী কৃষিপণ্যের খাজনা আদায় করা হতো। কিন্তু এই বর্ষপঞ্জি কৃষকদের জন্য উপযোগী ছিল না। কারণ চন্দ্র বছরের ৩১ বছর সৌর বছরের ৩০ বছরের সমান। কৃষিকার্য সৌর বছরের হিসাবের ওপর নির্ভর করা সত্ত্বেও চন্দ্র বছরের হিসাবেই কৃষকদের রাজস্ব প্রদানে বাধ্য করা হতো। তাছাড়া চন্দ্র বছর ৩৫৪ দিন আর সৌর বছর ৩৬৫ বা ৩৬৬ দিনের মধ্যে ১১ বা ১২ দিনের ব্যবধান। ফলে রাজস্ব আদায়সহ অন্যান্য কাজকর্মে প্রশাসনিক জটিলতা তৈরি হতো। এ পরিপ্রেক্ষিতে ১৫৮৪ সালের ১০ মার্চ মুঘল সম্রাট আকবর এক ডিক্রি জারির মাধ্যমে প্রবর্তন করেন ‘তারিখইলাহি’ বাংলা সন। আর তা কার্যকর হয়েছিলো আকবরের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার ১৫৫৬ সালের ৫ নভেম্বর থেকে। আকবর একটি কর্মপোযোগী বৈজ্ঞানিক ও সর্বজনীন বর্ষপঞ্জি প্রণয়ণের জন্যে বিখ্যাত বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদ আমির ফতুল্লাহ সিরাজিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাঁর হাত ধরে হলো বাংলা বর্ষপঞ্জি। হালখাতা প্রথাও শুরু হয় আকবরের সময় থেকে। পুরো বছরের হিসাব গুটিয়ে নতুন হিসাব খোলার খাতা হলো হালখাতা।

পাকিস্তান আমলে পূর্ববাংলায় বাংলা নববর্ষ উদযাপনের আতুরঘরের সঙ্গে ছায়নটের নাম জড়িয়ে রয়েছে। তখন একদিকে আইয়ুব খানের জুলুম, নিপীড়ননির্যাতন অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষ উদযাপন নিষিদ্ধকরণের প্রতিবাদে ১৯৬৫ সনে জন্ম নেয় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ছায়ানট’। ১৯৬৭ সাল থেকে রমনার বটমূলে ছায়ানট বাংলা নতুন বছর বরণ শুরু করে। তখন বর্ষবরণ অনুষ্ঠান ছিল মূলত একটি সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ। অতঃপর ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে আয়োজিত মঙ্গল শোভাযাত্রা ছিলো স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক বিদ্রোহ। বিশালাকার পশুপাখির বিচিত্র মুখোশ ও সাজসজ্জার পাশাপাশি ঢাকঢোল বাদ্যযন্ত্র ও নৃত্যের মাধ্যমে জাকজমকপূর্ণ শোভাযাত্রা আজ বাংলা নববর্ষের অবধারিত অনুষঙ্গ।

নববর্ষের উৎসব গ্রামীণ জীবনের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত। সাধারণত নববর্ষে গ্রাম বাংলার বৃহত্তর সমাজের মানুষ তাদের বাড়িঘর পরিছন্ন করে। মিষ্টিপিঠাপায়েসসহ নানারকম লোকজ খাবার তৈরির ধুম পড়ে। বৈশাখী মেলার আয়োজন হয় বাংলার সর্বত্র। স্থানীয় কৃষিজাত দ্রব্য, কারুপণ্য, লোকশিল্পজাত পণ্য, কৃষির শিল্পজাত সামগ্রী, সকলপ্রকার হস্তশিল্প ও মৃৎশিল্প সামগ্রী পাওয়া যায় এই মেলায়। এছাড়া লোকজ খাদ্যদ্রব্য মুড়ি, মুড়কি, বাতাসা, কদমা, ইত্যাদিরও পশরা সাজিয়ে বসেন দোকানিরা। কোথাও কোথাও হয় ঘুড়ি ওড়ানো উৎসব, গরুর লড়াই ও বলিখেলা। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর আধিবাসীরা উদযাপন করে বৈসাবি উৎসব। চাক্‌মাদের বিজু, মারমাদের সাংগ্রাই ও ত্রিপুরাদের বিজু মিলিয়ে বৈসাবি। সবকিছু মিলিয়ে বলা যায় বাঙালিত্বের প্রতীক নববর্ষ। বাঙালির সম্প্রীতি, সংস্কৃতি ও অসাম্প্রদায়িক আমজের দু’টি অনুষ্ঠান তথা আত্মপরিচয়ের স্মারক রয়েছে। এর একটি হলো শহীদ দিবসআন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসযার রক্তস্নাত সিঁড়ি বেয়েই আমাদের মহান স্বাধীনতাসহ তাবৎ অর্জন। অন্যটি বাংলা নববর্ষ। একটি শোকেরগৌরবের, অন্যটি উৎসবে তৎপর্যপূর্ণ।

অতিমারি করোনার আঘাত সামলে ওঠা নববর্ষের উৎসব এবারও কিছুটা সীমিত হতে পারে। এবারের নববর্ষ আমাদের দুয়ারে এসে উপস্থিত হয়েছে পবিত্র রমজান মাসে। পবিত্রতা ও ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে তাকওয়া অর্জন বা আত্মশুদ্ধির মাস রমজান। আর নববর্ষ হলো নিখাদ বাঙালিত্বেরও মধ্যে নিজস্ব সাংস্কৃতিক চেতনায় উদযাপনের পর্ব। ধর্ম মানুষকে নৈতিকতা শিক্ষা দেয় এবং সংস্কৃতি মননকে পরিশুদ্ধ করে। অনেকে লোকসংস্কৃতি ও প্রকৃতির নির্দেশক বাংলা সাহিত্য কবিতা ও গানের সাথে ইসলাম ধর্মের কল্পিত বিরোধ রচনা করতে প্রয়াসী হন। অথচ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭২’র সংবিধানে প্রত্যেক বাঙালির জন্য ধর্মের সাথে নাগরিক অধিকারকে প্রত্যেকের জন্য স্থিত করেছেন। এই বৃহত্তর সংস্কৃতিতে সকলেরই রয়েছে সমান অধিকার। বাঙালিত্ব, সম্প্রীতি, অসাম্প্রদায়িকতা তথা নববর্ষ উদযাপনের জন্য চাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় মুক্তমন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাপূর্বাপর বহু স্বৈরচারী শাসক বাঙালিত্বের চর্চাকে দমন করতে চেয়েছে। তারা ধর্মের দোহাই দিয়ে নানা অপকৌশলে বাঙালির সাংস্কৃতিক জাগরণকে রুখতে চেষ্টা করেছে। আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল ভাষাসংস্কৃতি ও বাঙালিত্বের শক্তিতে। সারা জীবনের সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু যে মুক্ত বাংলাদেশ এনে দিয়েছিলেন তা ম্লান হতে পারে যদি উৎসববান্ধব, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির রাজনৈতিক ক্ষমতার ধারাবাহিকতা না থাকে।

আবহমান বাংলার আত্মসত্তা পরিচিতির স্মারক নববর্ষ বয়ে আনুক মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বাঙালির গৌরব, সেটিই প্রার্থনা।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক, প্রফেসর, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ সাবেক ডিন, কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমার ভাবনায় বাংলা নববর্ষের সেকাল ও একাল
পরবর্তী নিবন্ধযাত্রাশিল্পে পহেলা বৈশাখ