নিজস্ব সংস্কৃতির জোরে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে হবে আমাদের

ববি বড়ুয়া | শুক্রবার , ১৪ এপ্রিল, ২০২৩ at ৫:২২ পূর্বাহ্ণ

এখন বাংলা নববর্ষের কথা আসলেই কল্পনায় যে চিত্র ভেসে আসে থাকে তা হলো ডিসি পাহাড় হতে ভেসে আসা দলীয় কণ্ঠে রবিঠাকুরের বাঙালির চির পরিচিত নবজাগরণের গান ‘এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ। তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে, বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক। যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলেযাওয়া গীতি, অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক।’ আর সেই পাহাড় চত্বরকে ঘিরে বাঙালি ললনাদের সাদা লাল শাড়ি, মাথার খোপায় গোঁজা রঙ বেরঙের ফুল, কাচের চুরি, মাটির গয়না, কপালে বড় টিপ, পায়ে নুপূর আবার গালে এঁকে দেওয়া শিল্প কলা বিভাগের ছাত্রদের বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী হাত পাখা, ঢোল কিংবা বাঁশির চিত্র। বাদ পড়ে না বড়দের মতো একই সাজে সাজতে চাওয়া কন্যা শিশুদেরও ছোট্ট শরীরে কষ্টে মোড়ানো শখের শাড়ি, চুরি, গয়না। কিশোর কিংবা যুবকদের রঙ বেরঙের পাঞ্জাবীতে আঁড়চোখে কিশোরী যুবতীদের চোখাচোখি কিংবা প্রেমিকা বা স্ত্রীকে নিয়ে সগৌরবে পদচারণা। আর ফটো সাংবাদিকদের এই নববর্ষকে ঘিরে নানা চালচিত্রকে জীবন্ত করে তোলার প্রাণান্ত চেষ্টার মুখরতা ।

শুধু সাজুগুজু করা সৌখিন রমনীগণ ডিসি পাহাড় কিংবা সিআরবিতে ঘোরাঘুরিতেই ক্ষান্ত হন তা নয়। ঘরে মাটির বাসনকোসনে নানা জাতের নাড়ু, পিঠা, পাজন কিংবা নানা পদের ভর্তা আর উচ্চ দরে কেনা ইলিশের সাথে পান্তা ভাতে সাজানো টেবিলে নানা আয়োজন। যে আয়োজনে সামিল হন আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব কিংবা একান্ত প্রিয়জন। আরও সবচেয়ে আনন্দ বা মজার বিষয় হলো, এই আনন্দ ভাগাভাগি করতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চিত্র প্রদর্শনীর প্রতিযোগিতা। এটা অবশ্যই ভালো দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখা যায়। কারণ সংস্কৃতির এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে এমন রণাই বাঙালিয়ানার সংস্কৃতির ধারাবাহিকতার রক্ষাকবচ। যদিও শুধুমাত্র এসব রঙচঙে উৎসবাদি পালনই এই নববর্ষের একমাত্র কারণ বা উদ্দেশ্য নয়। এর পেছনে আছে হাজার বছরের ঐতিহ্য, আছে গৌরবময় ইতিহাস। বাঙালি সংস্কৃতি ও ভাষা অন্যান্য প্রভাবশালী ভাষা সংস্কৃতির মতোই একটি সজীব, সচল ও আত্মীকরণশীল। এই সংস্কৃতি যেমন বিভিন্ন ধর্মমতের মানুষকে তার কোলে স্থান দিয়েছে, তেমনি বিভিন্ন ভাষা থেকে তার নিজের ভাষার উপাদানও গ্রহণ করেছে।বাঙালি সংস্কৃতির সমন্বয়বাদী বৈশিষ্ট্য থেকেই মূলত বাংলা নববর্ষের সৃষ্টি। যার সূচনা করেছেন সম্রাট আকবর। বার্ষিক কর, কৃষিকর, ভূমিকর, জলকর আদায়ের উদ্দেশ্যেই বাংলা সাল প্রচলন করেন। ফসল ঘরে তুলে সব কর মিটিয়ে বছরের প্রথমে কৃষক উৎসবের আনন্দে মেতে ওঠে। সকল ধর্ম, বর্ণের মানুষ এক হয়ে নববর্ষের উৎসব পালন করে। ধর্মীয় উৎসবগুলো নিজ নিজ ধর্মের মানুষের মধ্যে উৎসবমুখর হয়ে ওঠে। কিন্তু বর্ষবরণে সকল ধর্মের মানুষের উপস্থিতি থাকে সমান। দেশের সীমানা পেরিয়ে অন্য দেশেও এর ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে। এটা কোনো জাতি বা গোষ্ঠী অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। পৃথিবীর যেখানেই বাঙালি রয়েছেসেখানেই বাংলা নববর্ষকে স্বাগতম জানাতে থাকে। সামপ্রদায়িকতা দূর করে সকল বাঙালিকে সমান একটি রেখায় দাঁড় করাতে পারে বাংলা নববর্ষ। বাঙালির কৃষিনির্ভর ওই জীবনে গ্রামীণ বাংলাদেশের সামাজিক পরিবর্তনের ধারা ছিল খুবই শ্লথ। নদীনালা, খালবিলের বিপুল বিস্তার, যাতায়াত ব্যবস্থার দুর্গতি এবং নগদ পয়সার অভাবে জনজীবন ছিল স্তিমিত। বাঙালির বাংলা সন যেমন ফসলি সন, তাদের জীবনেও ছিল ফসলের মৌসুমের উষ্ণতা, উচ্ছলতা। বর্ষাকালে ধানপাট কাটা হলে তা বিক্রি করে যে নগদ পয়সা হাতে আসত তা দিয়েই বছরের নতুন কাপড় কেনা, খাজনার পাট চুকানোর পর ক’টা মাস অলস সময় কাটানো।

শীতকালের আমন ধান ঘরে উঠলে আবার পিঠাপুলি খাওয়া, নবান্ন উৎসব, নানা রকম মেলার আয়োজন, যাত্রা, কবিগান, জারিসারি, রামায়ণ, গম্ভীরা, কীর্তন, পালার আসর, ষাঁড়ের লড়াই, মোরগের লড়াই, লাঠিখেলা, মেয়েদের গার্সি উৎসব, সহেলা উৎসব, ছেলেদের দাড়িয়াবান্দা, গোল্লাছুট, বাণখেলা, হাডুডু, খেলার জমজমাট আনন্দফুর্তি। এরপর বড়ো আকারের চৈত্রসংক্রান্তির মেলা এবং পহেলা বৈশাখের ভোরে কৃষক পরিবারের পারিবারিক ‘আমানি উৎসব’ যার লক্ষ্য সারা বছরের শান্তি, সুখ, সমৃদ্ধি এবং উৎকৃষ্ট ফলনের আকাঙ্ক্ষা। পরে সারাদিন ধরে হালখাতা উৎসব, নানা জায়গায় বড় ধরনের মেলা। তাতে সাংসারিক তৈজসপত্র, মৃৎশিল্প ও কারুপণ্যের বিকিকিনি। বিনোদনের জন্য নাগরদোলা, পুতুল নাচ, সার্কাস, বক্স সিনেমার, বাইস্কোপের বাক্সে ভালো’র স্থির চিত্রের প্রদর্শনী। এ নিয়েই গ্রামীণ মানুষের সেকি আনন্দ! পুঁতির মালা, আলতা, বাঁশি, কাঠবাঁশের খেলনা, কদমা হাওয়ার মিঠাই দিয়েই হাসি ও সুখের আভা ফোটানো যেত অল্পে তুষ্ট গ্রামীণ নারী ও শিশুর মুখে। এসব গল্প হরহামেশাই শুনতে পাওয়া যায় আমাদের ঠাকুরমা, দীদার কাছে। ভাবতেই মনটা যেন চিনিতে গুলে মিষ্টি হয়ে যায় যেমনটা হয় হাওয়াই মিঠা। গ্রাম বাঙলার এসব আজ শুধুই স্মৃতি। সময়ের পালের হাওয়ায় আজ পরিবর্তন হয়েছে। এখন এসব আচার অনুষ্ঠান শহরেও বিস্তৃত লাভ করে পালিত হয় শহুরে ঢঙে। যেন গ্রামকে শহরে এনে নতুন করে গ্রামশহরকে ঢেলে মিশিয়ে একাকার করে নেয়ার চেষ্টা।

বাঙলার সংস্কৃতির শব্দটা শুনলেই এখন শুধু একটি উক্তি মাথায় ঘুরপাক পাক খায় তা হলো, ‘দেশে সংস্কৃতি ও রুচির দুর্ভিক্ষ চলছে।’ এই উক্তি যেন বাঙালিকে আরেকবার নেড়েচেড়ে দিয়ে গেলো। মনে হতে লাগলো, তাইতো! আমাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি, আমাদের রুচির একি দশা! সমপ্রতি অভিনয় শিল্পী সংঘের একটি অনুষ্ঠানে মামুনুর রশীদ স্যার সময়পোযোগী এই কথাটি বলেছেন। ‘দুর্ভিক্ষ’ নিয়ে নাট্যজন মামুনুর রশীদের আগে আর একজন মহৎ প্রাণ মানুষ উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন। মামুনুর রশীদ তার বক্তব্যে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনকে উদ্ধৃত করেছেন। তার বক্তব্যটি ছিল এরকম, ‘আজ থেকে ৫০৬০ বছর আগে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন বলেছিলেন, ‘দেশে একটা রুচির দুর্ভিক্ষ চলছে। আমরা সেই রুচির দুর্ভিক্ষের মধ্যে পড়ে গেছি’।

রুচির দুর্ভিক্ষ নিয়ে সামাজিক মাধ্যম এবং মূলধারার গণমাধ্যমে যে আলোচনা তর্কবিতর্ক হচ্ছে, এ ধরনের আলোচনা, সংলাপকে স্বাস্থ্যকর বলে মনে হয়। অনেকদিন পর এমন একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, যা আমাদের শিক্ষা সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত। এই সুযোগে সব শ্রেণির মানুষ এমন একটি বিষয় নিয়ে তর্কে অবতীর্ণ হয়েছেন। সুচিন্তিত তর্কবিতর্ক থেকে অনেক সত্য কথা বেরিয়ে আসে, যা থেকে কিছুটা হলেও পথ নির্দেশনা পাওয়া যায়। আর এই বিষয়টি এই লেখায় প্রাসঙ্গিকতায় না জড়ালে বিবেকের কাছেও কেমন মুক্তি অসম্ভব মনে হলো। কথাগুলোতে আসলেই একটা অন্য রকম শক্তি আছে। আরেকবার নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। বাংলা সংস্কৃতির চর্চা যদি বাঙালির মধ্যে না থাকে, বাঙালি যদি তার বাঙালিত্ব, বাংলা ভাষা, ইতিহাসঐতিহ্য, কৃষ্টি ভুলে যায় এবং তার চর্চা থেকে বিরত থাকে তবে বাঙালির নিজস্বতা বলতে তো আর কিছুই থাকবে না। তাই অপসংস্কৃতি প্রতিহত করতে নিজস্ব সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করতে হবে। সকল অপসংস্কৃতিকে প্রতিহত করে নিজস্ব সংস্কৃতির জোরে আবারও বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে হবে আমাদের।

রবিঠাকুরকে আরও একবার স্মরণ করে বলা যায়, ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা। রসের আবেশরাশি শুষ্ক করি দাও আসি, আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাঁখ। মায়ার কুজ্ঝটিজাল যাক দূরে যাক, এসো হে বৈশাখ, এসো এসো।। বেঁচে থাকুক আমাদের ইতিহাসঐতিহ্যকৃষ্টিসংস্কৃতি। অচিরেই কাটিয়ে উঠুক আমাদের সংস্কৃতি ও রুচির দুর্ভিক্ষ। আমরা আবারো গৌরবময় সেরা জাতি বাঙালি হই। লেখক: প্রাবন্ধিক; অধ্যাপক, ওমরগণি এম ই এস কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমক্কা বিজয় ছিল ইসলামের বিশ্ববিজয়ের সূচনা
পরবর্তী নিবন্ধআমার ভাবনায় বাংলা নববর্ষের সেকাল ও একাল