পত্র–পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের ঘটনার চিত্র। এসব দেখে দেশের আইন–শৃঙ্খলা পরিস্থিতি মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পারিবারিক কলহ, ব্যক্তিগত শত্রুতা, মাদকাসক্তি এবং ছিনতাইয়ের মতো কারণে সংঘটিত এসব হত্যাকাণ্ড দেশের সামগ্রিক আইন–শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এমন পরিস্থিতিতে যৌথ বাহিনীর অভিযান কিছুটা আশার আলো দেখালেও অপরাধের মূলে আঘাত হানতে আরো কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলেন, একটি সরকারের প্রাথমিক দায়িত্ব জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দেওয়া। জননিরাপত্তার ব্যত্যয় ঘটায় এবং সমাজে অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধিতে নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ, মন্ত্রণালয় এবং খোদ সরকার প্রশ্নের মুখে পড়ছে।
সামপ্রতিক সময়ে খুনের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা রীতিমত উদ্বেগজনক। ঘটনাগুলো সবাইকে উদ্বিগ্ন করে তুলছে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, এসব খুনের বেশির ভাগই ঘটেছে সামাজিক ও পারিবারিক কারণে। সাধারণত পারিবারিক কলহ, অর্থ লেনদেন, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব বা এলাকার আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের হাতে তারা খুন হয়েছেন। আশঙ্কাজনক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে পারিবারিক হত্যাকাণ্ড। অপর এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সারাদেশে প্রতিদিন গড়ে ১৪–১৫ জন খুন হচ্ছেন। তবে এসব খুনের বেশিরভাগ ঘটছে পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ে। বাবা অথবা মা নিজের শিশু সন্তানকে গলাটিপে হত্যা করছেন। বাবা অথবা মাও খুন হচ্ছেন সন্তানের হাতে। রাস্তা বা ডোবা থেকে উদ্ধার হচ্ছে তরুণীর খণ্ডিত লাশ। এতে উদ্বেগ–উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ছে সচেতন নাগরিক এমনকি জনসাধারণের মাঝে। এভাবে দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিনিয়ত ঘটছে হত্যাকাণ্ড।
সমাজবিজ্ঞানী ও আইনজীবীরা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছেন, বিচার বা যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত না হওয়াই সমাজে অনেক অপরাধের পুনরাবৃত্তির অন্যতম প্রধান কারণ। অপরাধী যখন বিচারের মুখোমুখি হয়েও আইনের ফাঁকফোকর গলে পার পেয়ে যান, তখন তার মধ্যে এই ধারণাই দৃঢ় হয় যে, অপরাধ যত বড়ই হোক তিনি আবারও পার পেয়ে যাবেন। চুরি, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, খুন, ধর্ষণ থেকে শুরু করে প্রতারণা, জালিয়াতি, অর্থ আত্মসাৎ কিংবা ঋণখেলাপি পর্যন্ত সব ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রেই অপরাধীদের মধ্যে এমন মনস্তত্ত্ব তৈরি হতে পারে। বিচারের ফাঁক গলে অপরাধীদের এভাবে পার পেয়ে যাওয়ার সঙ্গে সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র আর রাজনৈতিক ক্ষমতার যোগসাজশ যুক্ত, এমন অভিযোগ প্রায়ই মেলে। সামগ্রিকভাবে একেই বিচারহীনতার সংস্কৃতি বলে আখ্যায়িত করা হয়। এরই অনিবার্য ফল হলো, চিহ্নিত অপরাধীদের বারবার একই অপরাধে যুক্ত হওয়া। সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, পুলিশের তালিকাভুক্ত এমন আসামিরা জামিনে ছাড়া পেয়ে ফের নানা অপরাধে জড়াচ্ছে। আইন ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ সংকটের নেপথ্যে পুলিশের পেশাদারত্ব ও বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতার পাশাপাশি রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার দায়ী।
আইনের ভাষায় অপরাধ এমন কাজ, যা আইন বহির্ভূত ও পরিপন্থী। যা সম্পাদনের ফলে রাষ্ট্র সেই অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার এখতিয়ার রাখে। অপরাধ সেই ধরনের কাজ, যা আমাদের সমাজব্যবস্থায় অনেকাংশে নেতিবাচকভাবে প্রভাব ফেলছে। বর্তমানে আমরা দেখছি অপরাধ যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে, অপরাধের ধরনেও পরিবর্তন আসছে। সেই সাথে অপরাধীরাও তাদের অপরাধ সংগঠনের কৌশলে পরিবর্তন এনেছে।
বাংলাদেশে অপরাধ বৃদ্ধির কারণ হিসেবে সামাজিক বৈষম্যকে উল্লেখ করা হচ্ছে। সামাজিক বৈষম্য আমাদের সমাজে দিন দিন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। একটি হিসাব মতে, ২০২০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ৫.৩০ শতাংশ মানুষ বেকার যা আগের বছরের তুলনায় ১.১০ শতাংশ বেশি। অপরদিকে, ধনীরা দিন দিন আরও বেশি সম্পদশালী হচ্ছে এবং দরিদ্ররা আরও বেশি দরিদ্র। ফলে শ্রেণিবৈষম্য মারাত্মক আকার ধারণ করছে, যার ফলে সামাজিক চাপ (সোশ্যাল স্ট্রেইন) বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই কারণে অনেকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে এবং অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে।
প্রতিদিনই কোনো না কোনো নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। আমাদের সমাজ ধর্ষণের জন্য নারীদের পোশাক, চালচলনকে দায়ী করে। কিন্তু ধর্ষককে কোনো প্রকার দোষারোপ করে না। ধর্ষিতা নারীর পরিবারকেও নানা ধরনের কটূক্তির শিকার হতে হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘আইন–শৃঙ্খলা পরিস্থিতির দায় তো সরকার এড়াতেই পারে না। পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্য, শিক্ষার ভূমিকা এবং সমাজের দায়িত্বের প্রতি গভীর অবহেলার ফল হচ্ছে এসব সহিংসতা। এগুলো আমাদের ভেতরকার নৈতিকতা, সহানুভূতি ও মানবিকতাকে মেরে ফেলছে। প্রচলিত আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি সামাজিক অনুশাসন ও মূল্যবোধগুলো ফিরিয়ে আনতে হবে।’ সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে নাগরিকদের নিরাপত্তা দেওয়া, তাঁদের মনে স্বস্তি দেওয়া। আশা করি, সরকার সেই প্রচেষ্টাই চালাবে।