শহরের বুক জুড়ে এক টুকরো নির্মল স্বাস্থ্যকেন্দ্র

রুনা তাসমিনা | মঙ্গলবার , ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৬:০৪ পূর্বাহ্ণ

১৭৬০ সালে ব্রিটিশ শাসকরা নবাব মীর কাসিমের কাছ থেকে চট্টগ্রামের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল এবং ভারত বিভাগের আগে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত এটি শাসন করেছিল। তাদের শাসনকালে ব্রিটিশরা তাদের প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে বেশ কয়েকটি ভবন তৈরি করেছিল এবং এই বিল্ডিংগুলির মধ্যে একটি হল সিআরবি।
সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং (সিআরবি) বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের কোতোয়ালী থানার অধীনে টাইগার পাস সংলগ্ন পাহাড়ী এলাকায় অবস্থিত। এটি বাংলাদেশ রেলওয়ের (পূর্বাঞ্চলীয়) মহাব্যবস্থাপকের নিয়ন্ত্রণ কার্যালয়। ১৮৭২ সালে সম্পূর্ণ হওয়া ভবনটি বন্দর নগরীর প্রাচীনতম ভবন। এর পূর্বদিকে, সিআরবি সড়ক জুড়ে রয়েছে রেলওয়ে হাসপাতাল যা ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়। এখানে একটি ৫০ শয্যা বিশিষ্ট মেডিকেল কলেজ স্থাপনের প্রস্তাবনা ছিল এবং বর্তমানে যা ২৫০ শয্যায় উন্নীত হয়েছে। সিআরবি পার্শ্ববর্তী স্থানে রেল কর্মকর্তাদের জন্য একটি আবাসিক এলাকাও গড়ে উঠেছে। সিআরবি পাহাড়ে রয়েছে হাতির বাংলো। সবুজের সমারোহে আবেষ্টিত সিআরবি। এখানে আছে ১৯৭ প্রজাতির উদ্ভিদ। এ স্থান মাস্টার দা সূর্যসেনের নেতৃত্বে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন সংগ্রামে বিপ্লবীদের স্মৃতি চিহ্ন বহন করে। এছাড়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (চাকসু) প্রথম সাধারণ সম্পাদক (জিএস) মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদ আবদুর রবসহ ১০ শহীদের কবর রয়েছে নির্ধারিত স্থানটিতে।
এছাড়াও কেন্দ্রের দিকে রয়েছে শিরীষতলা নামে একটি প্রশস্ত মাঠ। শিরীষতলাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বাঙালি সংস্কৃতির উৎসব অঙ্গন। প্রতিবছর আয়োজিত হয় বাঙালির ঐতিহ্য বাংলা বর্ষবরণ ও বিদায়ী অনুষ্ঠান। এসময় বসে বলিখেলার আসর ও লোকজ মেলা। উদযাপিত হয় পহেলা ফাল্গুনসহ ঐতিহ্যগত উৎসব। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভাস্বর অপরূপ এই এলাকা সাধারণ মানুষের অবসর বিনোদন, প্রাতঃভ্রমণ ও বৈকালিক ভ্রমণের একমাত্র উপযুক্ত স্থান। তাই সিআরবি এককথায় চট্টগ্রামের ফুসফুস।
সমপ্রতি সিআরবি রেলওয়ে হাসপাতাল সংলগ্ন জমি ও রেলওয়ে হাসপাতাল কলোনির ৬ একর জমি সরকারি-বেসরকারি (পিপিপি) প্রকল্পের আওতায় ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ কোম্পানিকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫০০ শয্যার হাসপাতাল, ১০০ আসনের মেডিকেল কলেজ ও ৫০ আসনের নার্সিং ইনস্টিটিউট নির্মাণের জন্য। পুরো চট্টগ্রাম এখন সিআরবি’র ইতিহাস ঐতিহ্য ও সবুজ নিসর্গ রক্ষা আন্দোলনে সরব। চট্টগ্রামের বাতিঘর খ্যাত বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন স্যারের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে নাগরিক সমাজ।
প্রায় ১ কোটি মানুষ বসবাসকারী শহর চট্টগ্রাম। এখানে হাসপাতালের প্রয়োজন অবশ্যই আছে। কিন্তু সিআরবি ধ্বংস করে সেই হাসপাতাল হোক চট্টগ্রামবাসী চায় না। এমনিতেই বড় বড় দালানের মধ্যে চাপা পড়ে নিঃশ্বাস নেয়ার জায়গা নেই চট্টগ্রামে। তার মধ্যে সিআরবি একটি স্বস্তির জায়গা। এক টুকরো প্রশান্তি চট্টগ্রামবাসীর কাছে। করোনাকালীন সময়ে অক্সিজেনের অভাবে লক্ষ লক্ষ মানুষ মানুষ মৃত্যুবরণ করছে, সেই অক্সিজেনদাতা সবুজকেই ধ্বংস করার পাঁয়তারা চলছে। এর বিরুদ্ধে আমরা কঠোর প্রতিবাদ জানাচ্ছি। ‘গাছ লাগান, পরিবেশ বাঁচান’- এই শ্লোগানের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে আমরা যখন নতুন গাছ লাগিয়ে আমাদের শহর সবুজ করার চেষ্টা করছি, তখন নেয়া হচ্ছে সিআরবির সবুজ নিধন করে হাসপাতাল বানানোর উদ্যোগ। শহরের সবুজ, সৌন্দর্য ধ্বংস করার এই উদ্যোগ যারা নিয়েছেন তদন্ত হোক তাদের বিরুদ্ধে। চট্টগ্রাম শহরের আশপাশে বহু খালি জায়গা আছে। হাসপাতাল হাসপাতাল ওখানেও করা যায়। তাছাড়া চট্টগ্রাম শহরে ভিআইপি হাসপাতাল অনেক আছে। যেখানে চিকিৎসা করার সাধ্য সাধারণ মানুষের নেই। হাসপাতাল একটি সেবা প্রতিষ্ঠান। চট্টগ্রাম শহরে অনেক হাসপাতাল থাকলেও নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তশ্রেণির মানুষ উন্নতমানের চিকিৎসা সেবা নেওয়ার সাধ্য, সামর্থ্য তাঁদের নেই। যার কারণে অনেকের মৃত্যু হচ্ছে ভালো চিকিৎসা না পাওয়ার কারণে। ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ কোম্পানি যদি আন্তরিকভাবে মানুষের সেবা করতে চান, চট্টগ্রাম শহরের বাইরে করুন। মান ঠিক রেখে সেবা করুন সাধারণ মানুষের। আমরা তাঁদের উদারতা দেখতে চাই।
কতটুকু জায়গা আছে চট্টগ্রাম শহরের বুকে! দালানকোঠায় গিজগিজ করা এই শহরের প্রাণ সিআরবি। এই গাছগুলোর নিচে যেমন শীতল ছায়া, দূর থেকে তেমনি নয়নাভিরাম এই জায়গা। ইট-পাথরের বদ্ধ জীবনে সিআরবির সবুজ শহুরে জীবনের প্রশান্তি। স্বাস্থ্য সুস্থ রাখার জন্যেও শহরের বাসিন্দাদের জন্য সিআরবি একটি অন্যতম স্থান। এই ছোট্ট জায়গায়ও লোভের হিংস্র থাবা। রেলওয়ের হাসপাতালটাকে আরো সংস্কার করে চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা যায়। এই উদ্যোগ যারাই নিয়ে থাকুন, আমরা সমস্ত চট্টগ্রামবাসী এর বিরুদ্ধে। সাধারণ মানুষ ব্যয়বহুলতার কারণে উন্নত চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত।
ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ কোম্পানি সেই মানুষগুলোর কথা চিন্তা করে হাসপাতাল যদি শহরের বাইরে করেন, তাতে চট্টগ্রামবাসীর যেমন উপকার হবে, তেমনি তারাও সম্মানিত হবেন সাধারণ মানুষের কাছে। সিআরবি শুধু একটি সবুজ বেষ্টিত এলাকা নয়, চট্টগ্রাম শহরের বুক জুড়ে এক টুকরো নির্মল স্বাস্থ্যকেন্দ্রও বটে। এর আশপাশেও যদি হাসপাতাল হয় তার প্রভাব সিআরবিতে পড়বে। বেশ কয়েকটি উন্নতমানের হাসপাতাল চট্টগ্রাম শহরের বাইরে বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় হয়েছে। চট্টগ্রামবাসী আনন্দের সাথে তাদের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে। চট্টগ্রামের ফুসফুস, সিআরবি নিজেই একটি প্রাকৃতিক হাসপাতাল। এখানে যন্ত্রপাতি ভরা হাসপাতালের কোনো দরকার নেই। কর্ণফুলীর তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা চট্টগ্রাম জনসংখ্যার তুলনায় অনেক ছোটো একটি শহর। এই শহরের ভেতরের সবুজগুলো কেবলমাত্র শহরের সৌন্দর্য বহন করে তা-ই নয়, এই স্থাপনাগুলোর সাথে জড়িয়ে রয়েছে ঐতিহ্য ও ইতিহাস। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে এই ইতিহাস ছবি হয়ে থাকুক আমরা কেউ-ই তা চাই না।
লেখক : গল্পকার, শিক্ষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধদৈনিক আজাদীর প্রতি ভালবাসা
পরবর্তী নিবন্ধসুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে নিত্য প্রয়োজনীয় কিছু পণ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া সম্ভব : ২