সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে নিত্য প্রয়োজনীয় কিছু পণ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া সম্ভব : ২

প্রসঙ্গ : লবণ

প্রফেসর সালমা রহমান | মঙ্গলবার , ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৬:০৫ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশে প্রাকৃতিকভাবে প্রচুর লবণ উৎপাদন হয়, একটু উদ্যোগ নিলেই দেশ লবণে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারবে। দীর্ঘদিন থেকে চট্টগ্রাম ও কঙবাজারে সমুদ্রের লোনা পানি থেকে লবণ উৎপাদিত হয়। আজকাল খুলনা,সাতক্ষীরা,চাঁদপুরসহ উপকূলীয় অঞ্চলে লবনের চাষ হয়। এদেশে লবণ চাষের রয়েছে শত শত বছরের ইতিহাস। পঞ্চদশ শতাব্দীতে কক্সবাজারে লবণ চাষ শুরু হয়, চট্টগ্রামের মুলঙ্গী নামে এক শ্রেণীর লোক অতীতে লবণ চাষের সাথে জড়িত ছিল। তাদের লবণ উৎপাদনের ক্ষেত্রকে বলা হত ‘তোফল’। মোগল আমলে ‘নিমক জায়গীর মহাল’ ও ‘নিমক এয়জ মহাল’ নামে দুটি সরকারি মহাল লবণ শিল্প নিয়ন্ত্রণ করত। নিজামপুর, বাহারছড়া ও জুলদিয়া এই তিনটি চাকলার অধীনে ৩৯ টি লবণ সংগ্রহ ক্ষেত্র ছিল। ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৫ সালের মধ্যে অনেক ইংরেজ প্রত্যক্ষভাবে বেনিয়াদের মাধ্যমে লবণ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে। বৃটিশদের উদ্যোগে ১৭৬৫ সালে বণিক সমিতি গঠিত হয় এবং ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্মকর্তারা লাভবান হত। পরবর্তীতে ওয়ারেন হেস্টিংস এই শিল্পে সরকারিভাবে একচেটিয়া আধিপত্য প্রয়োগ করে। তারা লবণ চাষের জন্য লবণ চাষের জমি সর্ব্বোচ্চ দরদাতাকে ৫ বছরের জন্য লিজ দিতে শুরু করে। ১৭৭৭ সালে এই পদ্ধতি বাতিল হয়ে বার্ষিক চুক্তিতে জমি লিজ দেয়া শুরু হয়। ১৮৬২ সাল পর্যন্ত কোম্পানীর আধিপত্য চলতে থাকে। বিদেশ থেকে লবণ আমদানী, ভারতে লবণ উৎপাদন নিষিদ্ধ এবং কোম্পানী কর্তৃক করারোপ প্রভৃতি কারণে দেশীয় লবণ শিল্প ধ্বংস হয়। ১৯৩০ সালে আবার লবণ উৎপাদন শুরু হয় মহাত্মা গান্ধীর লবণ আন্দোলনের প্রভাবে। ১৯৪৭ সালে কঙবাজার সদর উপজেলার গোমাতলী মৌজার এক ব্যক্তি প্রথম বাণিজ্যিক ভিত্তিতে লবণ উৎপাদন শুরু করেন। এরপর লবণ শিল্প পুরানো ঐতিহ্য ফিরে পায় কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তান থেকে খনিজ লবণ আমদানীর ফলে চট্টগ্রামের সামুদ্রিক লবণ প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে। ১৯৬০্ল-৬১ অর্থবছরে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক ) লবণ শিল্পের কার্যক্রম শুরু করে। ১৯৭১ সালে বিসিক এই শিল্প উন্নয়নের কাজ হাতে নেয়, ১৩ মিলিয়ন টাকার প্রকল্প গৃহীত হয়। উদ্দেশ্য ছিল লবণ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, গুণগত মান বৃদ্ধি, ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ, গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রম, চাষীদের উদ্বুদ্ধকরণ।এছাড়া লবণের চাহিদা, সরবরাহ ও উৎপাদন পর্যবেক্ষণ করা। ২০০৬-০৭ অর্থবছর পর্যন্ত প্রকল্পের কেন্দ্রগুলি ছিল কঙবাজারের ৭ টি থানা: সদর, মহেশখালী, রামু, চকরিয়া, পেকুয়া, টেকনাফ, কুতুবদিয়া ও চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালীর ১২ টি কেন্দ্র।
প্রথমে মানুষ সমুদ্রের পানি চুলায় বা রোদে শুকিয়ে লবণ বানাতো। সনাতন এই পদ্ধতিতে একর প্রতি উৎপাদন ছিল ১৭.২৫ মেট্রিক টন । ২০০০-২০০১ হতে পলিথিন পদ্ধতিতে চাষ শুুরু হয়, প্রথমে সমতল ভূমির চারপাশে মাটির আইল দিয়ে প্লট বানানো হয়। এরপর রোদে ভাল করে শুকিয়ে কাল পলিথিন বিছিয়ে দেয়া হয়।পরে নদী থেকে ইঞ্জিনচালিত শ্যালো মেশিন দিয়ে লোনা পানি দিয়ে প্লট ভর্তি করা হয়, পানি শুকিয়ে লবণ পলিথিনে জমা হয়। একটু ঝরঝরে হলে রিফাইন করে বস্তা ভরা হয়। নতুন এই পদ্ধতিতে একর প্রতি উৎপাদন হয় ২১ মেট্রিক টন। ডিসেম্বরের মাঝ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত লবণ চাষের ভর মৌসুম। বছরের অন্য সময়ে সেখানে চিংড়ি চাষ করা হয়।
এখন দেশে আন্তর্জাতিক মানের লবণ উৎপাদন হয়, যা দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানী করা সম্ভব। ২০১৯ সালে রেকর্ড পরিমান লবণ উৎপাদন হয়েছিল। বিসিকের মতে গত বছর লবণের বার্ষিক চাহিদা ছিল ১৮ লাখ, উৎপাদন হয়েছিল ১৮ লাখ ২৪ হাজার টন। গত কয়েক মৌসুমে সরকারি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে উৎপাদিত উদ্বৃত্ত লবণ মাঠে পড়ে ছিল। খাবার লবণ আমদানী নিষিদ্ধ থাকলেও কিছু অসাধু ব্যবসায়ী শিল্প লবণ আমদানী করে খাবার লবণ হিসাবে বিক্রি করে, যা মানুষের শরীরে অত্যন্ত ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে । শিল্প লবণ ও খাবার লবণ মিশিয়ে কখনো কখনো বিক্রি করা হয়। দেশের তিনটি কষ্টিক সোডা উৎপাদন প্রতিষ্ঠান শিল্পের কাঁচামাল হিসাবে প্রচুর লবণ আমদানী করে সেগুলো খাবার লবণ হিসাবে বিক্রি করে। ট্যারিফ কমিশনের হিসাব অনুযায়ী ভোজ্য লবণের আমদানী কর ৮৯% কিন্তু শিল্প লবণের আমদানী কর ৪৩% এতে শিল্প লবণ বেশি আমদানী হয়। দেশে উৎপাদিত লবণের দাম কমে গেছে এবং চাষীরা ন্যায্যমূল্য না পেয়ে লবণ চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। বর্তমানে লবণের অনেক মাঠ খালি পড়ে আছে, বন্ধ হয়ে গেছে অনেক কারখানা। সারা দেশের চাহিদার ৮০ ভাগ লবণ আসে কঙবাজার থেকে, বিসিকের তথ্যমতে শুধুমাত্র কঙবাজার জেলায় ৬৩ হাজার ৫৩২ একর লবণের জমি আছে, যেখানে প্রায় ৪৩ হাজার ৫০০ লোক কাজ করছে। উপযুক্ত দাম না পাওয়ায় লবণ শিল্পে জড়িত লাখ লাখ লোক দুর্দশায় পড়েছে। আয়োডিনযুক্ত যে লবণ বাজারে প্রতি কেজি ৩৫/৪০ টাকায় বিক্রি হয়, মাঠ পর্যায়ে চাষী মূল্য পায় মাত্র ৪ টাকা-যার উৎপাদন খরচ প্রতি কেজি ৬ টাকা। অর্থাৎ লবণ চাষী উৎপাদন খরচও তুলতে পারছেনা। বাজারে সব পণ্যের দাম উর্ধ্বমূখী হলেও কৃষক পর্যায়ে লবণের দাম খুব কম। চলতি বছরের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী এক মণ লবণের মোট উৎপাদন খরচ পড়ে ২৩০ টাকা। অথচ এক মণ লবণের বিক্রয় মূল্য ১৫০ টাকা। এতটা লোকসান দিয়ে লবণ চাষী টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তারা একদিকে মূল্য পাচ্ছেনা অন্যদিকে বেড়েছে উৎপাদন খরচ, চাষীরা পড়েছে বিপাকে। উৎপাদন খরচের শতকরা ৪১ ভাগ ব্যয় হয় জমির ভাড়া বাবদ, ৩৯ ভাগ শ্রমিক ব্যয়, ১০ ভাগ পলিথিন ক্রয়ে, ৫ ভাগ পানির পাম্পের এবং ৫ ভাগ হচেছ অন্যান্য ব্যয়। এই সবগুলো ব্যয় এখন উর্ধ্বমূখী, ফলে সংকট বেড়েই চলেছে।
লবণ শিল্পের সমস্যা সমাধানের জন্য সরকার অনেকগুলো উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, বিশেষ করে সাম্প্রতিককালে ‘আয়োডিনযুক্ত লবণ আইন ২০২০’ এর চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এই আইন অনুযায়ী নিবন্ধন ছাড়া কেউ লবণ আমদানী, গুদামজাতকরণ, ভোক্তাপর্যায়ে পাইকারি সরবরাহ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, পরিশোধন, বা আয়োডিনযুক্ত কারখানা পরিচালনা করে অথবা এর গুণগতমান নিশ্চিত না হয় তাহলে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড বা অর্থদন্ড হবে। এই আইনের যে ৫১ টি ধারা আছে তার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল: একটি জাতীয় লবণ কমিটি করা হবে- সেই কমিটি লবণের উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, পরিশোধন, আয়োডিনযুক্তকরণ, মজুত, বিক্রয়, পরিবহন, বাজারজাতকরণ, আমদানী নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যবস্থাপনা নীতির বিষয়ে সুপারিশ প্রণয়ণ করবে। বিসিক লবণের উৎপাদন বৃদ্ধি ও উৎপাদনে বিজ্ঞানভিত্তিক কৌশল প্রয়োগ এবং লবণ উৎপাদনকারীদের প্রয়োজনে স্কিল ডেভেলপমেন্টের ব্যবস্থা করবে। প্রয়োজনে সরকার লবণ গবেষণা ইন্সটিটিউট স্থাপন করবে। লবণ প্রক্রিয়াজাত শিল্পাঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা হবে। চট্টগ্রাম ও কঙবাজার জেলার প্রান্তিক লবণ চাষীদের লোনের জন্য বিসিক নিজস্ব তহবিল থেকে ৫ কোটি টাকা দিবে। সরকারিভাবে এক লাখ মেট্রিক টন লবণ ধারণের ক্ষমতাসম্পন্ন বাফার গুদাম তৈরি করবে শিল্প মন্ত্রণালয়। এছাড়া লবণের উৎপাদন খরচ কমানোর কাজ করবে মন্ত্রণালয়।
লবণ আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশ খুব শিগগিরই লবণে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠবে। আইনের প্রতিটি ধারা বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা সে ব্যাপারে সারা বছর মনিটর করা প্রয়োজন। কারণ অতীতেও লবণ শিল্প রক্ষার জন্য অনেক আইন করা হয়েছে কিন্তু সেগুলোর সফল প্রয়োগ হয়নি। কোন কিছুতেই অসাধু ব্যবসায়ীদের অপতৎপরতা বন্ধ করা যায়নি। নানা অজুহাতে, নানান অপকৌশলে লবণ আমদানী চলছে। শিল্প লবণ আমদানীর আড়ালে যাতে খাদ্য লবণ আমদানী করতে না পারে সেজন্য আইনের কঠোর বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রকৃতির অপার দানের ফসল লবণ, অতি গুরুত্ব দিয়ে এই লবণ শিল্পকে রক্ষা করতে হবে। তবেই আমরা দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে লবণ রপ্তানি করতে পারব। সেই সাথে বহু লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগও হবে। অতি প্রয়োজনীয় এই পণ্য উৎপাদনে সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষ এগিয়ে আসুক, লবণ আইন ২০২০ এর বিধিগুলো কার্যকর হোক এই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজ

পূর্ববর্তী নিবন্ধশহরের বুক জুড়ে এক টুকরো নির্মল স্বাস্থ্যকেন্দ্র
পরবর্তী নিবন্ধজাগো লক্ষ প্রীতিলতা