জাগো লক্ষ প্রীতিলতা

কুমার প্রীতীশ বল | মঙ্গলবার , ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৬:০৫ পূর্বাহ্ণ


‘চট্টগ্রাম! বীর প্রসবিনী চট্টগ্রাম! বীর সূর্য সেন আর কালজয়ী প্রীতিলতার পুণ্য স্মৃতি জড়িত এই চট্টগ্রাম। বীরের রক্তপ্রাত এ মাটি।’ বাক্য কয়খানা শেখ হাসিনা তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন পরম মমতায়। সেই চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজ আজ যখন মুখে মুখে সরব, হাসপাতাল চাই না। আমাদের সিআরবিতেই থাকুক আমাদের প্রিয় শতবর্ষী সিরিষতলা। হাসপাতাল চাই না চট্টলা, বীর প্রসবিনী চট্টলা। তখনই জানলাম, দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রাম পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাবের সামনে স্থাপিত বীরকন্যা প্রীতিলতার ভাস্কর্যটি একটি কালো কাপড় মুড়িয়ে রেখেছে একদল দুর্বৃত্ত। বিপ্লবী তারেকশ্বর দস্তিদার স্মৃতি পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার সিঞ্চন ভৌমিক এর প্রতিবাদ করে কালো কাপড়টি সরিয়ে নিয়েছেন। এই দুর্বৃত্তায়নের প্রতিবাদ করেছেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট রানা দাশগুপ্ত এবং প্রীতিলতা স্ট্রাস্ট্রের সভাপতি পঙ্কজ চক্রবর্তী। খবরটি পড়ে রীতিমতো বিস্মিত হয়েছি। বিস্মিত হয়েছি কালো কাপড়ে মুড়িয়ে দেওয়ার জন্য নয়। বিস্মিত হয়েছি চট্টগ্রামে বিবেকবান মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠতায়। বীর চট্টলায় দেশপ্রেমিক মানুষের সংখ্যা মাত্র এই কয়জন? তাহলে কি সত্যিই দেশটি দুর্বৃত্তায়নে ছেয়ে গেছে? এই যখন পরিস্থিতি, তখন খবরটি প্রথম দেখায় ভেবেছিলাম আমিও এড়িয়ে যাব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিবেকের দংশনে চুপ থাকতে পারলাম না। সত্যিই কি ভুলে গেছে এদেশের মানুষ প্রীতিলতার অবদান! আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে এই মহিয়ষী নারীর কোনো অবদান ছিল না।
চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে সাবেক ইউরোপিয়ান ক্লাবের সামনে স্থাপিত বীরকন্যা প্রীতিলতার ভাস্কর্যটি হয়েছিল কারণ প্রীতিলতা মানে প্রীতিলতা ওয়াদ্দাদার বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরীর ভাষায়, ‘আমাদের সুদীর্ঘ মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে প্রীতিলতা ওয়াদ্দাদার একটি অবিস্মরণীয় নাম। যে নাম বাঙালি জাতির ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে। এই মেধাবী মেয়ে চট্টগ্রামের সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে যোগ দিয়ে পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের নেতৃত্ব দিয়ে শহীদ হয়েছিল এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করে শহীদ হওয়া এটা সহজ কথা নয়, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ এক অসীম সাহসী নারী।’ ১৯৩২ সালে ২৩ সেপ্টেম্বর মাস্টারদা সূর্যসেনের নির্দেশে চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের নেতৃত্ব দেন। শান্তি চক্রবর্তী, কালী দে, প্রফুল্ল দাস, সুশীল দে ও মহেন্দ্র চৌধুরী ছিলেন সহযোদ্ধা। সম্পূর্ণ পুরুষের বেশে খাকী পোষাকে বীরকন্যা প্রীতিলতা আক্রমণের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। মাস্টারদার সহযাত্রী, ক্লাবের বাবুর্চি করিমের টর্চের আলোর সংকেত পেয়ে সেদিন বীরকন্যা প্রীতিলতা একটি সফল আক্রমণের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বিজয়ের আনন্দে উৎফুল্ল বিজয়ীরা ফিরে আসার সময়ে হঠাৎ কোথা থেকে একটা গুলি এসে প্রীতিলতার বুক এ ফোঁড় ও ফোঁড় করে দিয়ে চলে যায়। বীরকন্যা প্রীতিলতা মাটিতে লুটয়ে পড়ে। তখনও প্রাণবায়ু নিঃশেষ হয়ে যায়নি। ইংরেজ বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার সমূহ সম্ভাবনা থেকে সঙ্গে থাকা পটাসিয়াম সায়েনাইট খেয়ে আত্মাহুতি প্রদান করেন।
ঘটনার এই সরল বর্ণনা আজকের দিনে অনেকের কাছে নাটকীয় মনে হলেও ৯০ বছর আগে এমন একটি উদ্যোগ দুঃসাহসিকতার নামান্তর।
নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও ৯০ বছর আগের এই দুঃসাহসিকতা আজকের দিনে ঋভু সম্মানে নন্দিত হওয়ার কথা থাকলে সময় বয়ে নিয়ে আসছে ভিন্ন এক বার্তা। ‘ মার্তৃভূমির জন্য তাঁর এ আত্মত্যাগ ও দেশপ্রেম বাংলার স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষেরা নত চিত্তে যুগ যুগ ধও সে্মরণ করবে।’ বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরীর এমন একটি প্রত্যাশা আজ কালো কাপড়ে আচ্ছাদিত। তাহলে কি কেউই আমরা ঠিক জায়গাটিতে নেই? আমরা কি তাহলে যার যার আপাত স্বস্থানে অত্যন্ত বেমানান? যার যেখানে থাকার কথা নয়, সে কি ঠিক সেখানে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। কবি অরুণ কুমার চক্রবর্তীর ভাষায় বিবেকের উদ্দেশ্যে কি বলার সময় এসে গেছে, ‘হেথাকে তুকে মানাইছে নাই গ’/ইক্কেবারেই মানাইছে নাই/অ-তুই লালপাহাড়ীর দেশে যা…’।
বাঙালির গর্বের যে কিছু ঘটনা তার মধ্যে প্রীতিলতার ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ অবশ্যই একটি। বাঙালির গর্বের ইতিহাসে যেকজন বীরকন্যার অবদান স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার কথা এর মধ্যে অবশ্যই প্রীতিলতা থাকবেন। এঁেদর কারণেই তো গান্ধীজি সেদিন সগর্বে বলে ছিলেন-‘ চট্টগ্রাম সর্বাগ্রে।’ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য চট্টগ্রামের হরিখোলা মাঠে সাহিত্য সম্মেলনে দীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করিছিলেন-
‘ক্ষুধার্ত বাতাসে শুনি এখানে নিভৃত এক নাম চট্টগ্রাম : বীর চট্টগ্রাম
বিক্ষত বিধবস্ত দেহে অদভুত নি:শব্দ সহিষ্ণুতা আমাদের স্নায়ুতে স্নায়ুতে
বিদ্যুত প্রবাহ আনে আজ চেতনার দিন
চট্টগ্রাম : বীর চট্টগ্রাম।’
কদিন আগে বৃটিশ বিরোধি আন্দোলনের সূতিকাগার চট্টগ্রামের প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন কিংবদন্তি পুরুষ যাত্রা মোহন সেন (জে.এম. সেন)-এর দেড়’শ বছরের পুরনো বাড়ি দখলের অপচেষ্টা দেখেছি। এরও আগে কুখ্যাত রাজাকার দেলোয়ার হোসেন সাঈদী চট্টগ্রামের মাটিতে দাঁড়িয়ে সূর্যসেনকে ডাকাত সম্বোধন করার স্পর্ধা দেখিয়েছে। প্রতিবারই গুটি কয়েক মানুষকে সোচ্চার হতে দেখেছি। সেসব চেনামুখগুলোও ক্রমে ক্রমে হ্রাস পেতে পেতে নদী ভাঙনের মতো বিলীন হয়ে যাচ্ছে। জোড়ালো প্রতিবাদের অভাবে কিংবা দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করার কারণে দুর্বৃত্তরা দুর্বৃত্তায়নের চাদর ক্রমশ প্রসারিত করে চলেছে। ভাবতে অবাক লাগে, কেন জানি কারো নজরে আসছে না এর মাধ্যমেই অব্যাহত রয়েছে জাতিসত্ত্বার ইতিহাস মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র। বহু আগেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের অন্যতম সেনানী লোকনাথ বলসহ অনেক বিপ্লবীর স্মৃতিচিহ্ন। কেন মনে পড়ছে না, নিকট কিংবা দূর অতীতের নানান সব ষড়যন্ত্রের কথা। এই ষড়যন্ত্রকারীরা বাংলা ও বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস ঐতিহ্যকে অবজ্ঞা করছে প্রতিনিয়ত। তারা ইতিহাসের দ্বার উদঘাটন করে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টে। এভাবেই পালাবদল আর পদাঙ্ক অনুসরণের ইতিহাস রচিত হচ্ছে। ইতিহাস বিকৃত হচ্ছে নিয়মিত।
অনেক বছর আগে দেশ পত্রিকায় পড়েছিলাম, বিশ্বখ্যাত জাপানি সিনেমা পরিচালক অস্কার বিজয়ী কুরুশুয়া কোলকাতার নন্দনে কোনো এক উৎসবে এসে খালি পেয়ে হাঁটছিলেন। কুরুশুয়াকে খালি পায়ে হাঁটতে দেখে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি বলেছিলেন, এ পথে একদিন সত্যজিৎ হেঁটে ছিলেন, তাঁর পদধূলির স্পর্শ পেতে খালি পায়ে হাঁটছি। ঘটনাটি মনে পড়ল, সিআরবিতে হাসপাতাল করার খবরে। এরমধ্যে কর্ণফুলীর পানি অনেকদূর গড়িয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। সরকার চার সদস্য বিশিষ্ট কমিটি করেছে। আন্দোলন চট্টগ্রাম সীমানা ছাড়িয়ে ঢাকায় ছড়িয়েছে। তারপরও প্রীতিলতার আত্মাহুতি দিবসের কথা বলতে গিয়ে কেন সিআরবিকে টেনে আনলাম? কারণ সিআরবি দিয়ে হেঁটে গেলে চট্টগ্রামবাসীও প্রীতিলতা-সূর্যসেন-লোকনাথ বল কিংবা শহীদ আবদুর রবের পদধূলির স্পর্শ পেয়ে জেগে ওঠে। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল ইংরেজ গোড়াদের রেলওয়ে আম্মারি আক্রমণের আগে বীরপুত্র লোকনাথ বল সদল বলে সহযোদ্ধা অনন্ত সিং, গনেশ ঘোষের এই নির্জন প্রান্তরে শেষ সাক্ষাৎ করেছিলেন। তখন ছিল গোধূলি লগ্ন, সূর্য পশ্চিমাকাশে অস্তমিত হয়েছিল। সিআরবি’র অদূরে সূর্যসমরের বীরকন্যা প্রীতিলতা ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করে সফল হয়েও ইংরেজ গোড়াদের হাতে ধৃত হয়ে নির্যাতিতা না হওয়ার শপথে আত্মাহুতি দেন। ১৯৭১ সালে চাকসুর জিএস আবদুর রব কানুনগোপাড়ায় প্রিয় শিক্ষক সমাজবিজ্ঞানী অনুপম সেনের সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ করে মাতৃমুক্তি পণে বেরিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে শহিদ হন তাঁর প্রিয় সিআরবি’র সিরিষতলা। সিআরবি’র শিরীষতলায় পাবলিক-প্রাইভেট পাটনারশিপে হাসপাতাল স্থাপনা স্থগিতের জন্য এসব ঘটনা কি যথেষ্ট ছিল না?
আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য রক্ষার স্থান ক্রমেই সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। যে যাই বলুক না কেন বাংলাদেশের আগামী প্রজন্মের সাহসী তরুণের সাহসী ঠিকানা এসবই। তাই এগুলো মুছে ফেলার যে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র চলছে। কিন্তু এই ষড়যন্ত্র ঠেকিয়ে দেওয়ার মতো মানুষের দেখা মিলছে না। চারদিকে ষড়যন্ত্রকারীদের এমন আস্ফালন দেখে আজও অনেকে একক কিংবা দলীয়ভাবে সাইড লাইনে বসে খেলা দেখছেন। মহাকালের খেলা। কিন্তু এটা সম্পূর্ণই আত্মঘাতি হয়ে যাচ্ছে, আগুনের তাপ নিজের গায়ে লাগছে না ভেবে চুপ মেরে যাওয়ার সময় এটা নয়। হেফাজতের বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণে বিরোধিতা আর দুর্বত্তদের বীরকন্যা প্রীতিলতার ভাস্কর্যটি একটি কালো কাপড় মুড়িয়ে রাখার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এসব একই ষড়যন্ত্রের অংশবিশেষ। তালেবানি সমাজ প্রতিষ্ঠার একটা দূরভিসন্ধি ছাড়া ভিন্ন কিছু নয়। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, তালেবানিরা আফগানিস্থানের হাজার বছরের প্রাচীন সব ভাস্কর্য ধ্বংস করে আহেমিয়াত জালিয়াতি শাসন প্রতিষ্ঠার করেছে। পাকিস্তানেও সেই অপচেষ্টার দারপ্রান্তে। মনে পড়ে, সুচরিত চৌধুরীর লালদিঘি গল্পে আছে লালদিঘীকে বাঁচাতে ‘দিগভোলা প্রান্তরে গর্জে উঠলো এক উদাত্ত কন্ঠস্বর, ভাইসব এখনো কি তোমরা বুকের ব্যাথা নিয়ে ঘুমিয়ে থাকবে? মুখ কি তোমাদের কথা বলতে শেখায়নি? তোমাদের শ্রম নিয়ে গড়ে উঠেছে সভ্যতা আর তোমরা এখনো ডুবে আছো অসভ্য বর্বর যুগের অন্ধকারে। জাগো, জাগাও, জেগে পৃথিবীকে শ্রম দিয়ে প্রেম দিয়ে গড়ে তোল।’ তেমন করে একটি নয়, দুটি নয়, লক্ষ-অযুত কন্ঠস্বর আজ সরব, প্রতিবাদমুখর হতে হবে। এখনই এসবের বিরুদ্ধে সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিকভাবে গণ-প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। জেগে উঠতে হবে লক্ষ প্রীতিলতা, লক্ষ মুজিবকে, তবেই তো হবে প্রীতিলতা-সূর্যসেন আর বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ।
লেখক : কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার

পূর্ববর্তী নিবন্ধসুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে নিত্য প্রয়োজনীয় কিছু পণ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া সম্ভব : ২
পরবর্তী নিবন্ধমৎস্য সম্পদ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য বিপজ্জনক এক জাল