গ্রীষ্মের খরতাপ আর লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণা, এই নিয়েই কেটে গেছে এপ্রিল মাস। আর তাতেই গত ৭৫ বছরে মধ্যে টানা তাপপ্রবাহের রেকর্ড গড়ল বাংলাদেশ। ৩০ এপ্রিল যশোরে তাপমাত্রা উঠেছিল ৪৩.৮ ডিগ্রি। এটিও ৫২ বছরে মধ্যে একদিনে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার নতুন রেকর্ড। তারপর নেমে এল স্বস্তির বৃষ্টি, সাথে বজ্রপাত আর ঝড়োবাতাস। আর ক্লাইমেট ভালনারেবল ইনডেক্স অনুযায়ী বিশ্বের ১৯২টি ঝুঁকিপূর্ণ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম।
এমন প্রেক্ষিতে একটি জাতীয় দৈনিকের প্রথম পাতায় সমপ্রতি প্রকাশিত একটি সংবাদে চোখ কপালে উঠার দশা! যার শিরোনাম, ‘আবহাওয়ার সব রাডারই নষ্ট‘ (দেশ রূপান্তর, ২৫ এপ্রিল ২০২৪)। ঝুঁকিপূর্ণ একটি দেশের জন্য যা অশনিসংকেত। ঝড়, বৃষ্টি, গরম কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, এসবের খবর জানতে রাডারই ভরসা। এখন সে রাডার যদি নষ্ট থাকে, অশান্ত ও অননুমেয় জলবায়ুর এ যুগে আবহাওয়া অফিস নির্ভর করছে কিসে? যখন আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানার বৈজ্ঞানিক উপায় ছিলো না, তখন খনার বচনই ছিলো ভরসা। প্রযুক্তির এই উৎকর্ষরতার যুগেও কি তাহলে খনার বচনে ফিরে যেতে হবে?
সংবাদে আরও জানা যাচ্ছে, জাইকার অনুদানে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে ঢাকা ও রংপুরের নষ্ট দুটি রাডার স্থাপন করার প্রক্রিয়া চলমান। কিন্তু এ দুটি স্থাপনের আগেই পুরনো অন্যসব রাডার নষ্ট হয়ে বিপাকে আবহাওয়া অধিদপ্তর। সমপ্রতি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) নিবিড় পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে ঢাকা, রংপুর, কক্সবাজার, পটুয়াখালী, রংপুর ও মৌলভীবাজারে পাঁচটি রাডার রয়েছে। এরমধ্যে ঢাকা ও রংপুরের রাডার দুটি স্থাপন করা হয়েছে ১৯৯৯ সালে। মেয়াদ শেষ হওয়ায় রংপুরের রাডার ইতোমধ্যে অচল। উঁচু ভবন বেশি হওয়ায় রেডিও জ্যামিংয়ের কারণে অকেজো ঢাকার রাডারও। যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়ে আছে বাকি সব রাডারের। বিশ্ববাজারে এসব খুচরা যন্ত্রাংশ আর পাওয়া যায় না। ফলে দুটি পুরোপুরি নষ্ট, বাকি তিনটি প্রায় অকেজো। গত দশক থেকেই এসব একেকটি রাডার অকেজো বা দুর্বল হওয়ার খবর গণমাধ্যমে এসেছে। তবুও কর্তৃপক্ষ কেন যথাযথ উদ্যোগ নেয়নি সেটিও প্রশ্ন।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ গণমাধ্যমে বলেন, ‘আমাদের কয়েকটি রাডার নষ্ট রয়েছে। জাপানের তত্ত্বাবধানে এগুলো রিপ্লেস (বদলে নতুন করে স্থাপন) করার কাজ চলছে। আশা করি দ্রুত সময়ের মধ্যে এগুলো রিপ্লেস হবে। রাডারের মাধ্যমে যে তথ্যগুলো নিয়ে থাকি তা এখন অন্যভাবে সংগ্রহ করা হচ্ছে।’ এখানে ‘অন্যভাবে সংগ্রহ’ বলতে কি আমরা ধরে নিব বিদেশী সংস্থাগুলোর কাছ থেকে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়াকে? নাকি অভ্যন্তরীণ উৎসে জোড়াতালি দিয়ে চলাবে? তা যেটাই হোক, কোনটাই কাম্য না। ১৯৬৯ সাল থেকে রাডারের মাধ্যমে আবহাওয়া বার্তা দেওয়া সংস্থাটির আধুনিক প্রযুক্তিতে এখনও স্বয়ংসম্পূর্ণ না হওয়াটা দুঃখজনক। ১৬৪৩ সালে ইতালীয় বিজ্ঞানী এভানজেলিস্টা টরিসিলির বাতাসের চাপ মাপার ব্যারোমিটার উদ্ভাবনের মধ্যদিয়ে জলবায়ু পর্যবেক্ষণের শুরু। এরপর একে একে তাপমাত্রা, ঝড়, বৃষ্টি, আদ্রতা, জোয়ার–ভাটা, ভূমিকম্প ইত্যাদি মাপার যন্ত্র আবিষ্কারের মাধ্যমে আবহাওয়ার নজরদারি ব্যবস্থা গড়ে উঠে। যা দিনে দিনে আধুনিক ও নিখুঁত হয়েছে।
গত বছর বিশ্বজুড়ে আবহাওয়া নজরদারি ও পূর্বাভাস দেওয়া কোম্পানিগুলোর বাজারদর ২.২ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে, যা প্রতিবছর ৬ থেকে ৭ শতাং হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে রাডার ও স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্যকে নিখুঁতভাবে বিশ্লেষণের জন্য যুক্তরাজ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে ১২০ কোটি পাউন্ড মূল্যের সুপার কম্পিউটার। প্রতিবেশি ভারত তাদের আবহাওয়া নেটওয়ার্ক সমপ্রসারণ ও সঠিক পূর্বাভাস পেতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার করছে। এসব উদাহারণেই স্পষ্ট বর্তমানে আবহাওয়া বার্তা কতটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর আমরা চলছি কিনা এনালগ, ডিজিটাল, অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি উৎসে প্রাপ্ত তথ্যের জোড়াতালি সিস্টেমে!
স্বাধীনতার পাঁচ দশক পার করা বাংলাদেশে গত দশক থেকে শুরু হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লব। ইতোমধ্যে নিজেদের স্যাটেলাইট আমরা আকাশে পাঠিয়েছি; ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ আর ইন্টারনেট পৌঁছে গেছে। বাজেটের আকার বেড়ে হয়েছে ৭ লক্ষ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। অনেক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন স্মার্ট বাংলাদেশ হওয়ার পথে। সুতরাং সেকেলে আবহাওয়া ব্যবস্থা এখন অকল্পনীয় একটি বিষয়। যদিও ঢাকা ও রংপুরে দুটি রাডার স্থাপনের জন্য ২০১৫ সালের ২৪ জুন বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে ১৮৬ কোটি টাকায় ‘ইমপ্রুভমেন্ট অব মেটেওরোলজিক্যাল রাডার সিস্টেম ইন ঢাকা অ্যান্ড রংপুর’ শীর্ষক একটি অনুদান চুক্তি হয়। পরবর্তীকালে ২০৮ কোটি টাকায় আবহাওয়া অধিদপ্তর কর্তৃক গৃহিত প্রকল্পটি দুই ধাপে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২৬০ কোটি টাকায়। কিন্তু ২০১৬ সালে হোলি আর্টিজানের অপ্রত্যাশিত ঘটনার কারণে প্রকল্পটিতে ২০২১ সাল পর্যন্ত অর্থায়ন বন্ধ ছিল। অর্থাৎ, হোলি আর্টিজানের নীরব ধাক্কায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের পাঁচটি বছর নষ্ট! আর আমরাও বিকল্প অর্থের সংস্থান করতে পারিনি। এখন নতুন করে এ প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
আইএমইডির নিবিড় পর্যবেক্ষণে প্রকল্পটির নানান অসঙ্গতি উঠে এসেছে। ২০১৫ সালে প্রকল্পটি হাতে নেয়ার সময় পাঁচটি স্টেশনে অন্যান্য রাডার পুরনো হলেও সচল ছিল। তবে নতুন প্রকল্পটি শেষ হওয়ার আগেই বর্তমান সব রাডার নষ্ট হয়ে পড়েছে। এতে প্রশ্ন ওঠে, এ রাডারগুলো যে পুরনো; নষ্ট হওয়ার শঙ্কা রয়েছে, সেগুলো সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে উঠে আসেনি কেন? তাছাড়া, এখন নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নের আগেই পুরনোগুলো সব একসঙ্গে নষ্ট হল কীভাবে? প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের দূরদর্শিতার ছাপ এখানে স্পষ্ট। বাংলাদেশের রাডারগুলো যে ঠিকমত কাজ করে না, তা গত কয়েক বছরে সংঘটিত বিভিন্ন দুর্যোগের পূর্বাভাস বিশ্লেষণেই পরিষ্কার। এসময়ে ঘূর্ণিঝড় কিংবা অন্য দুর্যোগগুলোর পূর্বাভাস বাইরের দেশের বিজ্ঞানীদের মাধ্যমেই জানতে হয়েছে। বিশেষত ভারত, জাপান, ইউরোপ ও নাসাসহ বিভিন্ন সংস্থার উপর নির্ভর করতে হয়েছে।
যা হোক, এখন নতুন রাডার স্থাপন প্রকল্পের পুরো সুফল পেতে হলে বাকি তিনটি রাডার স্টেশনের (কক্সবাজার, পটুয়াখালী ও মৌলভীবাজারে স্থাপিত) সঙ্গে আন্তঃযোগাযোগ স্থাপন করে একই প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসতে হবে। এজন্য গাজীপুর ও রংপুরের মতো এস ব্র্যান্ড ডপলার রাডারসহ অন্যান্য আধুনিক যন্ত্রপাতি কক্সবাজার, খেপুপাড়া ও মৌলভীবাজারের রাডার স্টেশনে সংযোজন করার তাগিদ বিশেষজ্ঞদের।
এতসব সীমাবদ্ধতার মধ্যেও ২০২২ সালের মার্চ মাসে আবহাওয়া অধিদপ্তরে একটি হাই–ইমপ্যাক্ট ওয়েদার অ্যাসেসমেন্ট টুলকিট সংযুক্ত করা হয়। বজ্রপাত, উচ্চ বৃষ্টিপাতের হার, শিলাবৃষ্টি এবং অন্যান্য আবহাওয়াজনিত বিষয়ের সম্ভাব্য পূর্বাভাস ৫৪ ঘণ্টা আগেই দেওয়ার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে এই টুলকিট। এছাড়াও আরও নিত্যনতুন প্রযুক্তির সংযোজন ঘটেছে। বাড়েনি শুধু প্রয়োজনীয় জনবল আর উন্নত রাডার।
একটা সময় পর্যন্ত নির্দিষ্ট কিছু শ্রেণি–পেশার মানুষ আর সরকারি–বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আবহাওয়া বার্তার উপর নির্ভর করত। বর্তমানে তা সবার জন্যই অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। তাই বৃষ্টি, খরা, বন্যা, কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস যথাসময়ে এবং যথাযথভাবে জানা দরকার। আর এমন সময় দেশের প্রায় সব রাডার অকেজো থাকা আজকের বাংলাদেশের জন্য বড় লজ্জার। সহজ কথায় যদি বলি, ৩০ হাজার কোটি টাকার অধিক ব্যয়ে পদ্মা সেতু, সাড়ে ১০ হাজার কোটিতে টানেল নির্মাণ করা বাংলাদেশের জন্য কয়েক হাজার কোটির অত্যাধুনিক রাডার নির্মাণ কঠিন কিংবা অসম্ভব কোনো বিষয় নয়। প্রয়োজন শুধু যথাযথ উদ্যোগ, আন্তরিকতা ও সততার সাথে সেটা বাস্তবায়ন করা। এছাড়াও বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটকে আবহাওয়ার তথ্য পেতে কাজে লাগানোর সুযোগ থাকলে সেটাও করা উচিত।
সরকার ও সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ উদ্যোগি হোক; আবহাওয়ার পূর্বাভাস যুগোপযোগী হোক। সরকারের ধারাবাহিক উন্নয়নধ্বনি আকাশে বাতাসেও বাজুক।
লেখক: ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।