বাংলাদেশে ঘনঘন সড়ক দুর্ঘটনা একটি ভয়াবহ ও উদ্বেগজনক সমস্যা। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ সংহারের চিত্র আমাদের দেশে যেন নিত্যনৈমিত্তিক দৃশ্য যা কোনো কোনো তৃতীয় বিশ্বের দেশে অনেকটা নিয়ন্ত্রণের পর্যায়ে রয়েছে। বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের মহাসড়কগুলোতে সড়ক দুর্ঘটনার হার মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সামগ্রীক উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের উন্নয়নের দৃশ্যমান অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। সেই সাথে যাতায়াত ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন হওয়ার সত্ত্বেও সড়ক দুর্ঘটনার হার আশংকাজনকভাবে বেড়ে চলেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক প্রকাশিত “গ্লোবাল স্ট্যাটাস রিপোর্ট অন রোড সেফটি –২০১৮ এর তথ্য মতে বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ১০ লাখ ৩৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হয় সড়ক দুর্ঘটনায়। এছাড়া ২০–৫০ লাখ মানুষ মারাত্মকভাবে আহত হয় কিংবা পঙ্গুত্ব বরণ করে। বিশ্বব্যাপী শতকরা ৯০ ভাগ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে যার সংখ্যা উন্নত দেশগুলোর তুলনায় ০৩ গুণ বেশি। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে যুগপৎভাবে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের চিত্র অনেকটা অভিন্ন। প্রতিবেদনের তথ্য মতে সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে প্রতিবছর মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার, পাকিস্তানে প্রায় ২৭ হাজার এবং ভারতে প্রায় ৩ লাখের মতো। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের মতে ২০২১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশে মোট ৫ হাজার ৩৮১ টি সড়ক দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ৬ হাজার ২৬৪ জন মানুষ নিহত হয়েছে এবং আহত হয়েছে ৬ হাজার ৪৬ জন। ২০২৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৬ হাজার ২৬১টি। এতে প্রাণ হারিয়েছে ৭ হাজার ৯০২ জন এবং আহত হয়েছে ১০ হাজার ৩৭২ জন। বিগত ৯ বছরে নিবন্ধিত যানবাহনের পাশাপাশি ছোট যানবাহন বিশেষকরে মোটরসাইকেল ও ইজিবাইকের সংখ্যা চার পাঁচ গুণ বেড়েছে। একইসঙ্গে সড়ক আইন অমান্য করে এসব যানবাহন জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে অবাধে চলাচল করায় দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বেড়েছে বলে এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
বুয়েটের ” এক্সিডেন্ট রিসার্চ সেন্টার ” পরিচালিত এক প্রতিবেদনে উঠে আসে বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ১২০০০ লোক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় এবং ৩৫০০০ লোক আহত বা পঙ্গুত্ব বরণ করে। বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে ১০,০০০ যানবাহনের মধ্যে ৮৫.৬ শতাংশ মারাত্মক ভাবে সড়ক দুর্ঘটনায় দৃশ্যমান। সুতরাং বাংলাদেশের সড়ক সমূহের অবস্থা ভীষণ জীবন বিধ্বংসী বললেও অত্যুক্তি হবে না। রাস্তা বা সড়কগুলোতে যানবাহনের অনিয়ন্ত্রিত উপচে পড়া ভিড় এবং চালকের বেপরোয়া যানবাহন চালানো সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ। অধিকন্তু পথচারী এবং পশুদের রাস্তা বা সড়ক দখল করে চলাচলও সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। অনেক সময় পথচারীরা রাস্তা পারাপারের সময় মোবাইল ফোনে কথা বলতে থাকে। পথচারীর অসাবধণতার কারণেও সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। অনেকক্ষেত্রে রাস্তাঘাটের অবকাঠামোগত দুরবস্থা ও অপ্রতুল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার ফলে মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনাসমূহ ঘটে থাকে। ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা সর্বকালের উচ্চ হারে পৌঁছেছিল। বিভিন্ন অবস্থার প্রেক্ষিতে এ বর্ধিত হারের কারণ নিহিত ছিল। প্রথমত: আমাদের দেশের রাস্তাগুলোর বেহাল অবস্থা মাঝেমধ্যে আমাদের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অসমান রাস্তাঘাট, অপর্যাপ্ত সড়ক বাতি বিশেষকরে রাত্রিতে চালকদের গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে মারাত্মক ঝুঁকির সৃষ্টি করে। দ্বিতীয়ত সড়ক বিধি বা ট্রাফিক আইন মানার ক্ষেত্রে আমাদের দেশের চালকরা খুবই উদাসীন। চালকরা অনিয়ন্ত্রিত গতিতে গাড়ি চালায়, সঙ্কেত না দিয়ে ভুল দিক দিয়ে গাড়ি অতিক্রম করে এবং গাড়ি চালানো অবস্থায় মোবাইল ফোনে কথা বলে, অনেক চালকের আবার বৈধ লাইসেন্স থাকেনা এবং অধিকাংশ যানবাহনগুলো রাস্তায় চলাচলের জন্য অনুপযোগী। এ অবস্থা সুস্পষ্ট ভাবে লক্ষ্যণীয় বিভিন্ন উৎসব এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠান উদযাপনের সময়ে।
বাংলাদেশে ২০২৩ খ্রিস্টাব্দে সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে ১৭ জানুয়ারি। ওইদিন ৩৫টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২০ জন নিহত ও ৩১ জন আহত হয়েছে। দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি নিহত হয়েছে ৭ জুলাই। ঐদিন ৩০ টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪১ জন নিহত ও ৯৮ জন আহত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি আহত হয়েছে ৪ মার্চ। এদিন ২৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৯ জন নিহত ও ১৪৮ জন আহত হয়েছে। চালকদের অবহেলা, রাস্তাঘাটের দুরবস্থা ছাড়াও বৈরী আবহাওয়ার কারণেও সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। আমাদের দেশে ট্রাফিক আইন না মেনে তড়িঘড়ি করে গাড়ি চালাতে গিয়ে চালকরা অনেক দুর্ঘটনা ঘটিয়ে থাকে। পাশ কাটিয়ে গাড়ি চালাতে গিয়ে তারা অনেক সময় ঝুঁকিপূর্ণভাবে গাড়ি চালিয়ে রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটা পথচারী কিংবা যানবাহন চাপা দেয়, ধাক্কা লাগিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ডিভাইডারের ওপর গাড়ি তুলে দেয় কিংবা রাস্তার পার্শ্ববর্তী বিলে বা খাদে যানবাহন ফেলে দিয়ে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে থাকে। এসব দুর্ঘটনার পেছনে চালকদের অধৈর্য, অদক্ষতা ও বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানো অনেকাংশেই দায়ী। অথচ তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশে যেমন মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা এবং ভিয়েতনামে অটো সিগনাল মেনে চলা এবং চালকদের সতর্কতামূলক গাড়ি চালানোর কারণে আমাদের তুলনায় সেসব দেশে সড়ক দুর্ঘটনা অনেক কম। এসব দেশের রাস্তায় লাল সিগনাল পড়ার সাথে সাথে গাড়িগুলো সারিবদ্ধভাবে একটার পেছনে অন্যটা দাঁড়িয়ে যায়। এখানে চালক কিংবা গাড়ির মালিকদের কাছে না আছে তাড়াহুড়োর মানসিকতা না আছে অবৈধভাবে পাশ কাটিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার অদম্য প্রবনতা। সবুজ সংকেত পেতে তাদেরকে বড়জোর ৫/১০ মিনিট অপেক্ষা করতে হয়। সবুজ সংকেত পেয়ে গাড়িগুলো পিঁপড়ের মতো এগিয়ে গিয়ে গন্তব্যের পথে চলে যায়। সিডনির রাস্তায় চালক কিংবা গাড়ি মালিকের সৌজন্যবোধ দেখে অভিভূত হয়েছিলাম। রাস্তা পারাপারের সময় ডানপাশে দূরত্বে গাড়ির অবস্থান লক্ষ্য করে রাস্তা পার হয়ে ডিভাইডারে উঠে বামপাশ থেকে চলমান গাড়ি চলে যাবার অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছি। সবুজ সিগনাল চলমান থাকা সত্ত্বেও চালক গাড়ি থামিয়ে হাসিমুখে রাস্তা পেরিয়ে যাবার জন্য ইশারা করেছিল। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে একজন চালকের সৌজন্যমূলক সহযোগিতা ও সহমর্মিতা প্রদর্শনে গাড়িটির পেছনে আরও ৮/১০ টা গাড়ি দাঁড়িয়ে গেলো। অথচ কোন চালক এতে সামান্য বিরক্তবোধ করেনি। চালকদের ভালো প্রশিক্ষণ এবং ধৈর্যশীল আচরণই কেবল এমন সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়ক হতে পারে।
আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে হলে সরকারসহ বিভিন্ন সংস্থা এবং সাধারণ জনগণকে গঠনমূলক বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। প্রথমত সড়ক অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনায় সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহকে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নিয়ে নজরদারি বাড়াতে হবে। সতর্কতামূলক প্রচারণা, সুষ্ঠু যানবাহন নীতির প্রয়োগ ও নিয়ম–নীতির প্রতি সংশ্লিষ্টদের শ্রদ্ধাবোধ সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে সাহায্য করবে। ট্রাফিক আইন অমান্যকারী চালকদের বিচারের আওতায় এনে তাদের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা নিতে হবে। চালক এবং জনগণের জন্য সড়ক নিরাপত্তা বিষয় ও বেপরোয়া যানবাহন চালনার নেতিবাচক দিকগুলো সম্পর্কে শিক্ষা দানের ব্যবস্থা থাকতে হবে। সড়ক নিরাপত্তা একটি সমন্বিত দায়িত্ব। নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যাপারে প্রত্যেক নাগরিককে স্ব স্ব অবস্থান থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। কারণ আমাদের জীবন এবং সম্পদের ওপর সড়ক দুর্ঘটনার প্রভাব অত্যন্ত মারাত্মক। এতে অনেকের জীবন সংহার, দৈহিক আঘাত এবং সম্পদের ক্ষতি সাধিত হয়ে থাকে।
সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে রাস্তাঘাট নির্মাণ, রাস্তা প্রশস্ত করণ, আধুনিক যানবাহন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি চালুকরণ এবং সকল স্তরে ট্রাফিক আইন মেনে চলা হলে সড়ক দুর্ঘটনা কমে আসবে যেখানে থাকবেনা বিশৃঙ্খল অবস্থায় মহাসড়কে গাড়ি পাশ কাটানোর অবৈধ চেষ্টা কিংবা অনিয়ন্ত্রিতভাবে গাড়ি চালানোর উগ্র মানসিকতা। মেয়াদোত্তীর্ণ অকেজো যানবাহনগুলোকে রাস্তায় নামানোর ক্ষেত্রে কঠোর সরকারি নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে হবে। চালকদের জন্য আধুনিক প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা সরকার এবং বি আর টি এর কঠোর নজরদারিতে সম্পন্ন করতে হবে। সততা এবং নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থায় চালকদের লাইসেন্স প্রদানের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে। চালকদের পর্যাপ্ত ঘুম এবং বিশ্রামের প্রয়োজন। অসুস্থ বা ক্লান্ত–পরিশ্রান্ত অবস্থায় গাড়ি চালানো মোটেই যুক্তিযুক্ত নয়। গাড়ি চালানো অবস্থায় মোবাইল ফোনে কথা না বলা, গাড়ি চালানোর গতিবেগ মেনে সীট বেল্ট বেঁধে সতর্কতার মাধ্যমে গাড়ি চালালে দুর্ঘটনা অনেকাংশেই কমে আসবে। মদ্যপান বা মাদকদ্রব্য সেবন করে যাতে যানবাহন না চালায় সে বিষয়ে চালকদেরকে সচেতন করে তুলতে হবে। চালকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা, বিশেষকরে দৃষ্টি শক্তি পরীক্ষার ব্যাপারে গুরুত্ব দিতে হবে। দৈবচয়নের ভিত্তিতে করা সমীক্ষায় দেখা গেছে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশের বেশি চালকের চশমার প্রয়োজন কেননা তারা রাত্রিকালীন দৃষ্টি সমস্যায় ভোগেন। তাছাড়া চালকদের বাধ্যতামূলক বিশ্রাম নেওয়ার কোনো সুযোগ দেওয়া হয় না। তাই দূরপাল্লার যাত্রায় অনেক চালক গাড়ি চালানো অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়ে। বাস মালিকরা খরচ বাঁচানোর তাগিদে বাড়তি চালক না রেখে চালককে ওভারটাইম দেওয়ায় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। এমনটা দেখা যায় চালককে সুবিধা দিতে হেলপার বাস চালানোর ফলে অনেক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে।
সুতরাং সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সর্বোপরি চালকদেরকে দায়িত্বশীল হয়ে সতর্কতার সঙ্গে যানবাহন চালাতে হবে। ট্রাফিক আইন মেনে চলার মানসিকতা চালকসহ সকলের মাঝে সহজাত অভ্যাসে পরিণত হোক। নিয়ম শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় এবং প্রতিপালনে সর্বমহলের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলে দেশে সড়ক দুর্ঘটনার হার ক্রমশ হ্রাস পাবে। সবাইকে ভাবতে হবে, সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি। ঝুঁকিমুক্ত পরিবেশে সড়ক মহাসড়কে যাতায়াত নির্বিঘ্নে নিরাপদ হোক। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করাই এখন সময়ের দাবি। কাজেই সরকার, চালক, মালিক, শ্রমিক ও যাত্রী সাধারণকে এ লক্ষ্য অর্জনে অধিক সতর্ক ও সচেতন হতে হবে।
লেখক : শিক্ষাবিদ, কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক ও প্রাক্তন অধ্যক্ষ, রাংগুনিয়া সরকারি কলেজ।