পথশিশুদের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া হোক

তরুণ কান্তি বড়ুয়া | মঙ্গলবার , ৩০ এপ্রিল, ২০২৪ at ১০:২৭ পূর্বাহ্ণ

রাস্তার অলিতেগলিতে, ফুটপাত, রেলস্টেশন, জাহাজঘাট, পার্কের ভেতর কিংবা বাজার সংলগ্ন মাঠে পড়ে থাকা শিশুদেরকে পথশিশু বা টোকাই বলা হয়ে থাকে। এদের হয়তো কারোর বাবা নেই, কারোর মা নেই, আবার কারোর মাবাবা কেউ নেই। মাবাবা, নিকটজনের স্নেহ ভালোবাসা বঞ্চিত হয়ে এসব পথশিশুরা সকালসন্ধ্যা ব্যস্ত থাকে জীবন জীবিকার অন্বেষণে। প্রয়োজনীয় কাপড়চোপড় কেনার সামর্থ্য না থাকায় ছেঁড়া এবং ময়লা কাপড় পরিধান করে এসব ভাগ্য বিড়ম্বিত শিশুদের জীবন কেটে যায়। ধনী লোকের সন্তানরা উৎসব আনন্দ ছাড়াও বছরের অধিকাংশ সময়ে যেখানে ফ্যাশন নির্ভর কাপড়চোপড় কেনাকাটা করে সেইক্ষেত্রে এসব সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুরা ছেঁড়াপুরনো কাপড় যোগাড় করতে ভিক্ষাবৃত্তির ওপর নির্ভরশীল। এসব শিশুর থাকার এবং ঘুমাবার কোনো নির্দিষ্ট জায়গা নেই। কাজেই ফুটপাত, রেলস্টেশন, জাহাজঘাট, শিল্পকারখানার বারান্দায়, পার্ক কিংবা গোরস্থান আঙ্গিনা, যাত্রী ছাউনি বা গাছের ছায়ায় একটু জায়গা খুঁজে পেলেই তারা ঘুমিয়ে পড়ে।

ইউনিসেফের তথ্য মতে বিশ্বের দেশে দেশে বিভিন্ন পরিস্থিতির কারণে যেমন দারিদ্র্যতা, জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং পারিবারিক ভঙ্গুরতা বাস্তুহারা শিশুদের পথে বসিয়ে দেয়। সময় এবং পরিস্থিতির উদ্ভবে বিভিন্ন দেশে অসহায় মানব সন্তানের ঠাঁই মিলে পথে পথে। ভিয়েতনামে পথশিশু যারা রাস্তায় থাকে তাদেরকে বুই ডইবলে যার অর্থ ময়লার শিশুবা জীবনের ধুলো। ফিলিপাইনের ম্যানিলায় শুধু ১মিলিয়ন পথশিশু বাস করে। উগান্ডার রাজধানী কাম্পালায় ৭১৪ বছর বয়সী ১৫০০০ পথশিশু রয়েছে। নাইজেরিয়াতে ৭ মিলিয়নের মতো পথশিশু রয়েছে। কেনিয়াতে ৩ লক্ষের মতো পথশিশু রয়েছে যেখানে রাজধানী নাইরোবিতে রয়েছে ৬০ হাজার পথশিশু। ২০০৭ এর এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় ইন্দোনেশিয়ায় ১,৭০,০০০ পথশিশু ছিল। ২০১৩১৪ এর এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় সিয়েরা লিওনে প্রায় ৫০,০০০ পথশিশু বাঁচার জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছিল। ভারতের দিল্লি, কোলকাতা এবং মুম্বাই নগরের প্রতিটিতে ১ মিলিয়নের অধিক পথশিশু রয়েছে। এক পরিসংখ্যান মতে ২০০১ সালে রাশিয়াতেও ১ মিলিয়নের মতো পথশিশু ছিল।

বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ কর্তৃক পরিচালিত ‘এস্টিমেশন অব দ্য সাইজ অব স্ট্রিট চিলড্রেন এন্ড দেয়ার প্রজেকশন ফর মেজর আরবান এরিয়াজ অব বাংলাদেশ২০০৫’ এর অনুসন্ধানের ওপর ভিত্তি করে ইউনিসেফ পথশিশুদের সংখ্যা নির্ধারণ করেছিলো ৬,৭০,০০০। ধারণা করা হচ্ছে বাংলাদেশে এখন ৬ লক্ষের অধিক পথশিশু রয়েছে যার ৭৫% বাস করে রাজধানী ঢাকায়। আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৮() এ শিশুদের অগ্রগতির জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক বিশেষ বিধান প্রণয়নের বিষয় সন্নিবেশিত করা আছে। আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদ, আমাদের সংবিধান, শিশু আইন ২০১৩, নারী শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ আইনে শিশুদের প্রতি সবধরনের নিষ্ঠুরতা, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আমাদের শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দের ২২ জুন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় শিশু আইন ১৯৭৪ প্রণয়ন করেন। পরবর্তীতে ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান সরকারের হাতে এ আইন সংশোধিত হয়েছে। বাংলাদেশ জাতিসংঘ সনদের মতো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দলিলে স্বাক্ষরকারি দেশ। এই সনদের ১৯ ধারা মতো শিশুদের যেকোনো ধরনের অনাচারের কবল থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের।

পথশিশুদের সঠিক সংখ্যা নিয়ে বর্তমানে কোনো সরকারি পরিসংখ্যান সম্ভবত নাই। সামপ্রতিককালে বাংলাদেশে জনসংখ্যা যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। সাথে সাথে পথশিশুর সংখ্যাও আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। পথশিশুদের যুদ্ধ হচ্ছে কিভাবে জীবিকা নির্বাহ করা যায়। জীবিকা অর্জনে ব্যর্থ হলে ভগ্ন মনোরথে, ক্লান্ত দেহে উপোস থেকে তাদের জীবন তরী চলতে থাকে। অসুস্থ হলে এসব পথশিশুদের সেবাযত্ন করারও কেউ থাকেনা। নি:স্ব মাবাবা থাকলেও দারিদ্র্যতার কারণে তাদের খাবারদাবার, স্নেহমমতা দিয়ে সেবাযত্ন করা সম্ভব হয়না। ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি পরিস্থিতি যেখানে এমন শোচনীয়, সেক্ষেত্রে ঠিকমতো তাদের চিকিৎসা ব্যয় বহন করার জন্য কাউকে পাওয়া যায় না। পথশিশুদেরকে তীর্যক প্রাণীদের কাতারে গিয়ে ডাস্টবিনের নোংরা উচ্ছিষ্ট খাবার খেতে দেখা যায়। ফলে রোগাক্রান্ত পথশিশুরা অধিক রোগাক্রান্ত হয়ে ক্রমে ক্রমে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস হলো এসব সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুরা তাদের মৌলিক চাহিদা, যথাক্রমে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। তারা অপুষ্টিতে ভোগে এবং অল্প বয়সে বিভিন্ন মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয়। এমনকি তাদের মধ্যে অনেকেই বয়স বাড়ার সাথেই নানান অনৈতিক কাজে, যেমন পকেটমার, ছিনতাই, অসাধু ব্যবসায়ীদের অবৈধ মালামাল বহন, মাদক পাচারের মতো জঘন্য অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে নিজেরা মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। পথশিশুদের অনেক সময় সংঘবদ্ধ অপরাধমূলক কাজে জড়াতে দেখা যায়। তখন অনেকে আবার চৌর্যবৃত্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। দোকান বাড়িঘর থেকে মূল্যবান জিনিসপত্র চুরি করে অল্প মূল্যে অন্যত্র বিক্রি করে দেয়। পথশিশুদের কোনো নির্ধারিত বয়স সীমা নেই যে তারা কখন কী কাজে জড়িয়ে পড়বে। ৬১২ বছরের পথশিশুরা জিনিসপত্র বিক্রি করে, ১৩১৫ বছর বয়সী শিশুরা অন্যান্য কাজ করে। ৪/৫ বছরের শিশুদেরও রাস্তায় কিছু বিক্রি করতে অথবা ইতস্তত এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। শিশুশ্রম নিষিদ্ধ থাকার পরও কর্মজীবী শিশু শ্রমিকদের পারিশ্রমিক সম্পর্কিত কোনো সংবিধিবদ্ধ নিয়ম নীতি না থাকায় এসব অসহায় শিশুরা পরিশ্রম অনুযায়ী প্রকৃত মজুরি পাওয়া থেকেও বঞ্চিত। ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোয়’ প্রবাদটি যেখানে তাদের জীবনের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে সেখানে এসব হতদরিদ্র শিশুরা শিক্ষার আলো থেকেও বঞ্চিত। নিরাপত্তার রক্ষাকবচ ‘শিশু অধিকার’ তাই তাদের কাছে ডুমুরের ফুল। অধিকাংশ মেয়ে পথশিশুদেরকে ১০ থেকে ১২ বছর বয়সে বিয়ের পিড়িতে বসতে দেখা যায়। এসব বিয়ে কোনো স্থায়ী সুখ বা সমাধান এনে দেয় না। তাদের মধ্যে বিয়ে বারবার ভেঙে যায় নিজেদের স্বেচ্ছাচারী মনোভাব বা ভিন্ন যৌন লালসার কারণে। অর্থাৎ পথশিশুদের ঠিকানা শেষ পর্যন্ত পথেই থেকে যায়।

পথশিশুদের কল্যাণের বিষয়টি মাথায় রেখে সমাজের মানুষের মধ্যে সচেতনতা ও নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্টি করতে হবে। শিশু অধিকার রক্ষায় আইনের যথাযথ প্রয়োগে সুনিশ্চিত হবে শিশুদের জন্য বাসযোগ্য সুন্দর সমাজব্যবস্থা যার ফলে রাষ্ট্রীয় ও বৈশ্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত হবে শিশু অধিকার বাস্তবায়নের সমুন্নত প্রয়াস। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাষায় বলা যায়: ‘এ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমিনব জাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার’। দেশের সামাজিক ও জাতীয় উন্নয়নের কথা ভাবা যাবেনা যদি শিশুদের একটি অংশ অযত্ন, অশিক্ষায় অবহেলিত থেকে যায়। পথশিশুদের দুর্ভোগ কমিয়ে আনার বিষয়টিতে সমস্যার সমাধান নয়, আর্থ সামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে মানব সন্তান হিসেবে সমাজ, রাষ্ট্রে সুনাগরিক হওয়ার নিশ্চয়তা বিধানে পথশিশুদের সমস্যা, অভাব অনেকাংশেই নির্মূল করা সম্ভব হবে। তাদের জন্য শিক্ষা, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসার স্থায়ী সমাধান এখন সময়ের দাবি।

১৯৯০ খ্রিস্টাব্দের শিশু সনদ, ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দের শিশু আইন ও ২০১৩ খ্রিস্টাব্দের শিশু বিল কার্যকর করার মাধ্যমে সমাজে শিশু বান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। রাষ্ট্রের প্রয়োজনে সব শিশুদের অভিন্ন সুযোগ সুবিধার আওতায় আনতে হবে। তাই অন্যান্য শিশুদের মতো পথশিশুদেরকে সুষ্ঠু সুন্দর জীবন যাপন করার সুযোগ করে দিতে হবে। পথশিশুদের ঠিকানা যদি পথেই থেকে যায় তাহলে তাদের নিয়ে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম এবং বিভিন্ন মহলের মানবিক সহায়তার আশ্বাস যে তিমিরে ছিলো সে তিমিরেই থেকে যাবে। বিশ্বায়নের যুগে মূল্যবোধ, মানবতাবোধকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে আমাদের ঔদার্য দিয়ে তাদেরকে পথকলি হয়ে প্রস্ফুটিত হতে সুযোগ করে দিতে হবে। তাদের প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে দেশের উন্নয়নের স্বার্থে।

লেখক : শিক্ষাবিদ, কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক; প্রাক্তন অধ্যক্ষ, রাংগুনিয়া সরকারি কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকঠোর হাতে দমন করতে হবে কিশোর গ্যাং
পরবর্তী নিবন্ধবিক্ষোভকারীদের ক্যাম্পাস ছাড়ার আলটিমেটাম দিল কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়