ছাদে রেস্তোরাঁ নয়, বাগান দরকার : বাঁচুক পরিবেশ

ফজলুর রহমান | শনিবার , ১৯ এপ্রিল, ২০২৫ at ১০:২২ পূর্বাহ্ণ

নগর সভ্যতার অংশ রেস্তোরাঁ। নাগরিক জীবনে যা না হলেই চলে না। রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি ঈদেপরবে কিংবা অন্য কোন কারণে কয়েকদিন বন্ধ থাকলেই বুঝা যায় এর গুরুত্ব কতটুকু। কিন্তু এই রেস্তোরাঁ ক্রমেই উঠে যাচ্ছে ছাদে। নিচে বসতবাড়ি কিংবা অফিস। আর উপরে রেস্তোরাঁ।

আর এই রেস্তোরাঁ মানে রাশি রাশি গ্যাস সিলিন্ডারের উঠানামা, আগুনের হলকা, বেস্টনে মরা ছাদ। অথচ এই ছাদ মানে খোলা আকাশ, বুক ভরে নেয়া বাতাস, আয়েশ করার স্থান, সবুজ বাগান গড়ার পরিসর। এক কথায়, ছাদ কেবল ছাদবাগান বানানোর জন্যই উপযুক্ত।

পরিবার বা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডা কিংবা নিরিবিলি সময় কাটাতে কয়েক বছর ধরে খোলামেলা পরিবেশে ছাদ রেস্তোরাঁকে বেছে নিচ্ছেন নগরের বাসিন্দারা। বদ্ধ নগরীতে বিনোদন ও মনোরঞ্জনে এ ধরনের রেস্তোরাঁকে ভালো বিকল্প ভাবা হচ্ছে। সংবাদ মাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকায় বেসরকারি উদ্যোগে দুই শর মতো ছাদ রেস্তোরাঁ চালু রয়েছে! চট্টগ্রাম শহরেও এই ছাদ রেস্তোরাঁ গড়ার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ছাদে উচ্চ তাপে রান্না এবং প্লাস্টিকজাতীয় দাহ্যবস্তু ব্যবহার করে সাজানোর কারণে সংশ্লিষ্ট ভবন ও এর আশপাশের ভবনে আগুন লাগা এবং তা ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বাড়ছে। নিয়মনীতি ও অনুমোদনের তোয়াক্কা না করে ব্যক্তিমালিকানাধীন এ ধরনের রেস্তোরাঁর সংখ্যা বাড়ছে।

২০২০ সালে বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ছাদে উদ্ভিদের উপস্থিতি বাইরে থেকে ভবনের ভেতরে তাপ প্রবেশে বাধা দেয়। তাই স্বল্প পরিমাণ তাপ ভবনে প্রবেশ করে। এ কারণে জ্বালানির (বিদ্যুৎ) ব্যবহার কমে এবং ভবনের বাসিন্দাদের জন্য আরামদায়ক পরিবেশ তৈরি হয়। ভবনের ছাদে বাগান থাকলে তা আশপাশের এলাকার তাপমাত্রাও কমাতে বড় ভূমিকা পালন করে। নানা বাস্তব বিবেচনায় ভবনের ছাদ উন্মুক্ত রাখা কিংবা সবুজ বাগান গড়ে তোলা জরুরি।

বিশ্বব্যাংকের গবেষণা আরো বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে শহরে যে তীব্র তাপপ্রবাহ সৃষ্টি হয়, তা কমাতে বহুতল ভবনের ওপর ছাদবাগান হতে পারে অন্যতম বিকল্প। কিন্তু ছাদবাগানের পরিবর্তে ভবনের ছাদগুলো হয়ে উঠছে একেকটি জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড। ছাদগুলোর একাংশে রান্নার সরঞ্জাম বসিয়ে উচ্চ তাপে বাংলা, থাই এবং চায়নিজ খাবার রান্না করা হয়। ফলে যে ছাদ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অতিরিক্ত তাপমাত্রা মোকাবিলায় ভূমিকা রাখতে পারত, তাই বাড়িয়ে তুলছে তাপপ্রবাহ।

বিশ্বব্যাংকের গবেষণায় আরো বলা হয়েছে, যে ছাদে গাছ আছে সেটির পৃষ্ঠের তাপমাত্রা উল্লেখযোগ্য হারে কম থাকে। ফলে ছাদের বাগান আশপাশের পরিবেশকে ঠাণ্ডা রাখতে সাহায্য করে। এছাড়া এটি বাড়ির ভেতরের তাপমাত্রা কমিয়ে দেয়, যা বিদ্যুৎ খরচ কমাতে এবং মানুষের আরামদায়ক জীবনযাত্রায় সাহায্য করে। গবেষকরা শহরের যেসব ছাদে বাগান করার সক্ষমতা আছে, সেখানে বাগান তৈরির ক্ষেত্রে জোর দিয়েছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কারণে শহরে যেভাবে তাপপ্রবাহ বাড়ছে সেটি মোকাবিলায় খোলা জায়গায় গ্রিন স্পেস (গাছপালা) ও ব্লু স্পেসের (জলাশয়) পাশাপাশি ছাদবাগানের বিকল্প নেই। গবেষকেরা ভবনের ছাদের এক, দুই ও তিন মিটার উচ্চতায় গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীতের বাগানবিহীন এবং বাগানসহ ছাদের তাপমাত্রা পরিমাপ করেন। ফলাফলে দেখা যায়, শীতকালে এক মিটার উচ্চতায় বাগানসহ ছাদের তাপমাত্রা বাগানবিহীন ছাদের তুলনায় ৩ দশমিক ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস কম থাকে। অবশ্য দুই ও তিন মিটার উচ্চতায় দিনের সময়ের ভিত্তিতে তাপমাত্রার তারতম্য হয়। যেমন দুই মিটার উচ্চতায় বাগানসহ ছাদের বাতাসের তাপমাত্রা কমানোর হার অনেক বেশি। একই ছাদে তিন মিটার উচ্চতায় ভোর এবং সন্ধ্যার তাপমাত্রা কমানোর হার বেশি।

বিভিন্ন ধরনের ফুলফল ও শাকসবজির গাছ দিয়ে সাজানো বাগানে তৈরি হয় সবুজ ছাদ। এই সবুজ ছাদ নিচের ফ্ল্যাটকে সরাসরি সূর্যের আলো থেকে ছায়া দেয়। উদ্ভিদগুলো নিজেদের খাবার প্রক্রিয়ার কাজে সূর্যের আলো শুষে নেওয়ার কারণে ছাদের পৃষ্ঠসহ আশেপাশের বায়ুর তাপমাত্রা উভয়ই হ্রাস পায়। এতে করে ছাদের আর্দ্রতা অপসারিত হয়ে ছাদ ও নিজের ঘরের পরিবেশ সহনীয় অবস্থায় থাকে। ঘরের ছাদ ঠান্ডা রাখা ছাদবাগান সবুজ ছাদ শুধু পরিবেশগতভাবেই স্বস্তিদায়ক নয়, এটি দালানের সৌন্দর্যায়নেও অপরিসীম ভূমিকা রাখে। এভাবে মহল্লার সবগুলো ছাদ সবুজায়ন করা হলে পুরো এলাকায় কাঙ্খিত শীতল পরিবেশ বিরাজ করে। এ ছাড়া বাগানহীন ছাদের তুলনায় সবুজ ছাদগুলো ১০ থেকে ১৫ বছর বেশি স্থায়ী হয়।

আমরা যদি কোনো উদ্যানে প্রবেশ করি, তাহলে সেখানে এক রকম তাপমাত্রা আর সেখান থেকে বের হলে তাপমাত্রা কমপক্ষে ২ থেকে ৩ ডিগ্রি বেশি। এতেই বোঝা যায়, আমাদের জন্য গাছ কতটা প্রয়োজনীয়। গাছের অভাবে পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা যদি আমাদের বাড়ির ছাদে গাছ লাগাই, তাহলে খুব সহজেই এ সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। ছাদে বাগান থাকলে পরিবারের একটি বিনোদনের জায়গাও গড়ে ওঠে, সবার মধ্যে মানসিক প্রশান্তি এনে দেয়। বাচ্চাদের গাছপালা ও পশুপাখির প্রতিও ভালোবাসা বাড়ে।

শহরে অপরিকল্পিত আবাসন এবং রাস্তাঘাট নির্মাণের ফলে কমে যাচ্ছে উন্মুক্ত স্থান, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমছে গাছপালা। এতে নগরীর তাপমাত্রা দিন দিন অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। বিশুদ্ধ অক্সিজেনের যোগান কমছে। উন্মুক্ত স্থানের যথেষ্ট অভাব বলে খালি জায়গায় গাছ লাগানোর সুযোগ কম। এ অবস্থায় ভবনের ছাদে বাগান করে নগরের পরিবেশ পাল্টে দেওয়া সম্ভব। তাই ছাদে রেস্তোরাঁ নয়, ছাদবাগান করাই শ্রেয়। এজন্য সামাজিক সচেতনতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। বাস্তবতা এই যে, ছাদবাগান এখনো সৌখিনতার অংশ। এটিকে আরো গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে, নগর জীবনের অংশ করে নিতে হবে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিজনিত বিপদে জেরবার সবাই। তাপমাত্রা কমানোর নানা উপায় নিয়ে ভাবনার শেষ নেই। এমন সময়ে ছাদবাগান নামের একটি বিকল্প আছে আমাদের হাতে। সেটি ব্যবহার করতে পারি সহজেই।

লেখক : উপপরিচালক (জনসংযোগ), চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)

পূর্ববর্তী নিবন্ধজীবন হবে সুন্দর সমৃদ্ধ ঝলমলে
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে