নিজেদের আয় থেকে উড়োজাহাজের অর্থ পরিশোধ করছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। সংবাদ মাধ্যমে এমন দাবিই করেছে প্রতিষ্ঠানটি। যা আর্থিক সক্ষমতার এক অনন্য নজির হিসেবে বিবেচিত। তাঁদের ভাষ্যানুযায়ী, বোয়িং কোম্পানির ব্রান্ড নিউ ২টি ৭৩৭–৮০০, ৪টি ৭৭৭–৩০০ই আর, ৬টি ৭৮৭ ড্রিমলাইনার এবং ডি হ্যাভিল্যান্ড কোম্পানি ২টি ড্যাস ৮কিউ ৪০০ উড়োজাহাজ ক্রয়ের জন্য ২০১১ সাল থেকে এ পর্যন্ত ২ হাজার ৯৩ মিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা নিয়েছে। এপ্রিল ২০২৪ পর্যন্ত ঋণের আসল ও সুদ বাবদ ১ হাজার ৫৭০ মিলিয়ন ডলার কিস্তি কোন বিলম্ব ছাড়াই পরিশোধ করেছে। ২০২২ সালে একটি বোয়িং ৭৩৭–৮০০, ২০২৩ সালে দুইটি বোয়িং ৭৭৭–৩০০ উড়োজাহাজের সম্পূর্ণ ঋণ সফলতার সঙ্গে নির্দিষ্ট সময়ে পরিশোধ করেছে এবং ২০২৫ সালে আরো ২টি বোয়িং ৭৭৭–৩০০ উড়োজাহাজের সম্পূর্ণ ঋণ পরিশোধ হবে।
বিমান দুইটি উঅঝঐ–৮–৩০০ এবং দুইটি ৭৩৭–৮০০ উড়োজাহাজের লিজ শেষ হওয়ার পর নিজস্ব তহবিল ব্যবহার হতে ক্রয় করতে সক্ষমতা অর্জন করেছে। বর্তমানে বিমানের বহরে নিজস্ব উড়োজাহাজের সংখ্যা ১৯টি। কোনও প্রকার সরকারি ভর্তুকি ছাড়াই নিজস্ব আয় থেকে নিজ পরিচালনা ব্যয় নির্বাহ করা এবং উড়োজাহাজের মূল্য পরিশোধ করে এদেশের ইতিহাস এক অনন্য নজির স্থাপন করেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স।
বিশেষজ্ঞদের মতে, লোকসানে লোকসানে জর্জরিত বিমানের বর্তমান আর্থিক সক্ষমতা অর্জনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে অবস্থাকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। পেশাগত দক্ষতা বাড়ানোর লক্ষ্যকে সামনে রেখে জাতীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে কোম্পানিতে রূপান্তরিত করা হয়েছিল। কোম্পানি করার উদ্দেশ্য ছিল বাণিজ্যিকভাবে প্রতিষ্ঠানটিকে পরিচালিত করা। বিগত সময়ের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় দক্ষতা বাড়ার বদলে আরও অবনতি হয়েছে। বিমান আমলা নির্ভর একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করলে বুঝা যায়, আভ্যন্তরীণ রুটে অনেকগুলো বেসরকারি বিমান পরিবহন চালু হওয়া কিংবা আন্তর্জাতিক রুটে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়ার কারণে বিমান ব্যবসা হারাচ্ছে না। জাতীয় পতাকাবাহী এ সংস্থাটি ব্যবসা হারাচ্ছে, শুধুমাত্র অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতা ও সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত না নিতে পারার কারণে। সাম্প্রতিককালে বিমান পরিবহনের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি যাত্রীও বেড়েছে। এরপরও বিমান খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে অনেকটা। বিমানের রক্ষণাবেক্ষণের দুর্বলতার কারণে প্রায়শ বিমানের যাত্রাবিলম্ব প্রাত্যহিক বিষয়। কোনও সময় তারা লাভের মুখ দেখে আবার কোনও সময় লোকসানের বোঝা গুণতে হয়। আবার বিমান যে লাভের হিসাব দেয়, সেটা নিয়েও প্রশ্ন উঠে। বিমান সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘আগের তুলনায় বর্তমানে বিমানের সেবার মান বেড়েছে। কয়টার বিমান কয়টায় ছাড়ে এ বদনাম বিমান অনেকটা ঘুচিয়ে নিয়েছে। বর্তমানে মোটামুটিভাবে নির্দিষ্ট সময়ে বিমান সিডিউল মেইনটেইন করার চেষ্টা করছে। যা বিমানের জন্য এবং বিমানের যাত্রীদের জন্য সুখবর। এরপরও বিমানের সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠে। বিমানের কর্মকর্তা কর্মচারীদের উদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ, অসহযোগিতামূলক ব্যবহার, অদক্ষতা, অলসতা, দায়িত্বের প্রতি অবহেলা, যাত্রীদের প্রতি অযথা হয়রানি, সেবামূলক দক্ষতা না থাকা, কাজের সময় অযথা আড্ডা ও খোশগল্পে নিয়োজিত থাকা, বোডিং কার্ডধারী যাত্রীকে বিনা কারণে বিমান বন্দরে ফেলে চলে যাওয়া এবং এ বিষয়ে সমাধানতো দূরে থাক সামান্য পরিমাণ অনুসূচনা না করে উপহাসের ন্যায় ঘটনা নিত্য ঘটে চলেছে। এ ধরনের অনেকগুলো অভিযোগ উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট জমা পড়েছে বলে জানা যায়। এতে করে বিমানে সেবার মান ও দক্ষতা বৃদ্ধি পাওয়ার দাবি করা হলেও ছোটখাটো ভুল ত্রুটিগুলোর কারণে এবং বিমানের কর্মকর্তা কর্মচারীদের সেবামূলক মনমানসিকতার অভাবে বিমানের যত উন্নয়ন তা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
বিমান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। স্বাধীনতার পর ধ্বংসবিধ্বস্ত একটি দেশের হাল ধরেছিলেন তিনি।
রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ নং–১২৬ অনুসারে ১৯৭২ এর ৪ জানুয়ারি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স গঠিত হয়। এদিন বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি ডিসি–৩ বিমান নিয়ে জাতির গর্বিত বাহন হিসেবে বাংলাদেশ বিমান যাত্রা শুরু করে। সাবেক পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের ২৫০০ জন কর্মচারী ও কিছুসংখ্যক কর্মকর্তা এবং ১০ জন বোয়িং ৭০৭ কমাণ্ডার ও ৭ জন অন্যান্য পাইলটের সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠানটি গঠন করা হয়।
১৯৭২ এর ৪ ফেব্রুয়ারি অভ্যন্তরীণ সেবার মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে বিমান। ভারত থেকে নিয়ে আসা ম্যাকডনেল ডগলাস ডিসি–৩ ছিল বিমানের প্রথম সংযোজন, যেটি ঢাকার সাথে চট্টগ্রাম, যশোর এবং সিলেটের আভ্যন্তরীণ রুটে চলাচল করছিল। এভাবে ১৯৭৩ সালে ঢাকা–কোলকাতা, ঢাকা–লন্ডন, রুটে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সেবা প্রদান শুরু করে বিমান। ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি কাঠমুন্ডু, নভেম্বরে ব্যাংকক এবং ডিসেম্বরে দুবাই রুটে বিমান তার সেবা কার্যক্রম শুরু করে। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট কালোরাত্রিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করার পর বিমানের পরিষেবা ও অগ্রগতি অনেকটা থমকে দাঁড়ায়, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে থাকে জাতীয় পতাকাবাহী এ সংস্থাটি।
১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। তিনি মাত্র ৫ বছরের শাসনকালে উন্নয়নের পরিকল্পনায় দেশকে অনেকটা এগিয়ে নিতে সক্ষম হন। ১৯৯৬–২০০১ সাল মেয়াদে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে শাসনামলকে বাংলাদেশের উন্নয়নের স্বর্ণযুগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সে সময়ে ১৯৯৬ সালে বিমান প্রথম দুইটি দূরপাল্লায় এয়ারবাস এ৩১০ ক্রয় করে। ২০০০ সালে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স আর এয়ার জ্যামাইকা থেকে ভাড়ায় আনা এ৩১০ সংযোজন করা হয়। এতে বিমানের সক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিমান তাদের একটি অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সূচনালগ্ন থেকেই এর মালিকানা ছিল বাংলাদেশ সরকারের, কিন্তু ১৯৭৫ এর পটপরিবর্তনের পর ১৯৭৭ সালে বিমানকে একটি পাবলিক সেক্টর করপোরেশনে পরিণত করে সরকার কর্তৃক নিযুক্ত পরিচালিত পরিচালনা পর্যদের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। পরবর্তীতে ২০০৭ এর মে মাসে বাংলাদেশের সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনকালীন সময়ে বিমানকে একটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে পরিণত করা হয়। ২৩ জুলাই ২০০৭ বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে পরিণত হয়।
২০০৮ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পুনরায় সরকার গঠন করে। সেই বছর ২০০৮–২০০৯ অর্থবছরে বিমান প্রথম বারের ন্যায় ১৫০ মিলিয়ন ডলার আয় করে যা বাংলাদেশ বিমানের ইতিহাসে প্রথম আয়ের ইতিহাস হিসেবে বিবেচিত।
বর্তমান সময়ে সরকার প্রধান ও দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর আন্তরিক প্রচেষ্টায় ও পরিকল্পনায় বিমান দেশে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সুনাম বৃদ্ধি করে চলেছে। তাদের সেবার মানও বৃদ্ধি পেয়েছে। আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থাগুলোর সাথে তাল মিলিয়ে বিমানের অগ্রযাত্রা প্রশংসা অর্জন করেছে। বর্তমানে ছোট বড় ১৯টি নিজস্ব উড়োজাহাজ দিয়ে বিমানের কার্যক্রম চলছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিক প্রচেষ্টায় বিমানে আধুনিক প্রজন্মের বিমান অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
বিমান পরিচালনার ক্ষেত্রে অদক্ষতা একটা বড় ধরণের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞমহল। তাঁদের মতে, অন্যান্য বিমান পরিবহন যদি যাত্রী ও পণ্য পরিবহন করে লাভ করতে পারে বাংলাদেশ বিমান পারবে না কেন? বিমানের উচিত হবে সেবার মান বাড়িয়ে যাত্রীদের আস্থা অর্জন করা।
অন্যান্য বিদেশী বিমান সংস্থাগুলো ব্যবসা করে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লাভবান হচ্ছে এবং দিন দিন তাদের পরিধি বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেখানে ‘বিমান’ কেন ব্যবসার পরিধি বাড়াতে পারছে না। আমি একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে দেশে–বিদেশে ভ্রমণের ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের এয়ারলাইন্সের যে সেবা পেয়ে থাকি বাংলাদেশ বিমান হতে সে সেবা পাওয়া যায় না। টিকেটের মূল্য অনেক বেশি। সীট খালি থাকা সত্ত্বেও টিকেট না পাওয়া, সেবামূলক মনোভাব কর্মকর্তাদের মধ্যে না থাকার কারণে বিদেশী এয়ারলাইন্সগুলো একচেটিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছে। অভ্যন্তরীণ রুটেও বেসরকারি বিমান সংস্থাগুলো সুনামের সাথে তাদের ব্যবসা পরিচলিত করলেও বিমান সেখানে পিছিয়ে পড়ছে। কেন প্রতিযোগিতামূলক বাজারে বিমান পিছিয়ে পড়ছে? তা খুঁজে দেখা প্রয়োজন। ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গঠনের ক্ষেত্রে স্মার্ট পরিবহন ব্যবস্থায় এবং স্মর্ট কর্মীবাহিনী সৃষ্টি বিমানের জন্য অত্যাবশ্যক। বিমান বর্তমানে ২৩টি আন্তর্জাতিক ও ৮টি অভ্যান্তরীণ গন্তব্যে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন সেবা দিয়ে থাকে।
২০২২–২০২৩ অর্থবছরে বিমান বাংলাদেশ ২৮ কোটি ৬৫ লাখ টাকা লাভ করেছে বলে দাবি করেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স যা দেশের জন্য সুখবর বটে।
সমালোচনা বা বিমানের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত না করে আমরা চাই বাংলাদেশের অগ্রগতির সাথে সাথে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স একটি স্মার্ট এয়ারলাইন্স হওয়ার পথে এগিয়ে যাক। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিমান তার সুনাম বৃদ্ধি করে দেশের সুনামও বৃদ্ধি করুক।
লেখক: প্রাবন্ধিক, সম্পাদক –শিল্পশৈলী।