বাংলার রুমি সৈয়দ আহমদুল হক

স্মরণের আবরণে

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ | রবিবার , ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ১১:০৪ পূর্বাহ্ণ


মরমী-ভাব দার্শনিক, উদার ও মুক্তবুদ্ধি ধর্মপরায়ণতা ও মানবতাবাদি আদর্শের প্রবক্তা, মওলানা রুমির অনুরক্ত ভক্ত-ব্যাখ্যাতা ও গবেষক, বাংলার রুমি, সৈয়দ আহমদুল হক ১৯১৮ সালের ২ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় জন্ম গ্রহণ এবং ২০১১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম শহরে লাল খান বাজারস্থ নিজ বাসভবন ’রুহ আফজা কুটির’ এ মৃত্যু বরণ করেন। তাঁর পূর্ব পুরুষগণ পবিত্র মক্কানগরী থেকে এদেশে এসেছিলেন। মাওলানা হামিদ উল্‌লা খানের চট্টগ্রামের ইতিহাস ‘আহাদীস উল খাওয়ানীন’ এ দেখা যায় চট্টগ্রামের বিশিষ্ট তেত্রিশ পরিবারের মধ্যে সৈয়দ হকের পরিবার বিশেষ সম্মানজনক ভাবে স্বীকৃত। আহমদুল হকের পিতামহ মুহম্মদ তজম্মুল আলী ছিলেন খ্যাতনামা আধ্যাত্মিক সাধু পুরুষ। তাঁর পিতা সৈয়দ মাওলানা সিরাজুল হক (১৮৮৯-১৯৫২) ছিলেন বরেণ্য বুযর্গ, সুফি সাধক, মাইজ ভান্ডারী তরিকার অনুসারী। ‘প্রকাশ সিরাজ বাবা’ নামে সমধিক পরিচিত তিনি ছিলেন সুফি সৈয়দ গোলামুর রহমান ভান্ডারীর মুরীদ। তাঁর চাচা সৈয়দ নুরুল হক মিশরের আলআজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন, ছিলেন ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞানে সুপন্ডিত। এই চাচার হাতেই হাতখড়ি (বিসমিল্লাখানি) হয় সৈয়দ আহমদুল হকের।
১৯৪৪ সালে সাব রেজিস্ট্রার পদে যোগদানের মাধ্যমে তাঁর ৩৬ বছরের সরকারি চাকুরিতে ক্রমান্বয়ে, ইন্ডাস্ট্রিজ ডাইরেক্টরেটে ডেপুটি ডাইরেক্টর, বিসিকের সচিব, শিল্প সংস্থার সচিব, ডেপুটি মেজিস্ট্রেট এবং ইপিবির ডাইরেক্টর হিসেবে ১৯৮০ সালে অবসর গ্রহণের মাধ্যমে ঘটে পরিসমাপ্তি। চাকরিরত অবস্থায় সৈয়দ আহমদুল হক ১৯৬২ সালে বৈরুতের আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লোক প্রশাসনে এম. এ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অর্জন করেন এবং বৃটেনের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও রফতানির উপর উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। বাংলাদেশে ও বাংলাভাষা ও সাহিত্যে রুমি চর্চাকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ও তাঁর রুমি তথা সুফিসাধনার স্বীকৃতি স্বরূপ ২০০৪ সালে তিনি ‘বাংলার রুমি’ উপাধিতে ভূষিত হন।
সুফি সাধক সৈয়দ আহমদুল হক একজন প্রতিশ্রুতিশীল লেখকও ছিলেন। তাঁর প্রধান প্রকাশিত রচনাবলীর মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য – A Short History Chittagong (১৯৪৯), চট্টগ্রামের শিল্প ও বাণিজ্য (১৯৮৮), প্রবন্ধ বিচিত্রা (১৯৯০), The Spirit of Masnavi Sharif (১৯৯৮), মসনভী শরীফের কাহিনী ও মর্মবাণী (২০০০), মুরলীর বিলাপ (১৯৯৬), দিওয়ানে শামস তাবরিযী (২০০৩), ফারসি গযল সংকলন (২০০৩), মসনবী শরীফের পয়গাম ও তফসির : বাণী ও ভাষ্য, প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ড (২০০৪ ও ২০১১), বাংলাদেশের সুফি সাহিত্য (২০০৭), The Main Theme of the Allama Rumi Society, (২০০৭)
সৈয়দ আহমদুল হকের ওপর পরিচালিত গবেষণা অভিসন্দর্ভে পরীক্ষা পর্যালোচনায় এটা সপ্রমানিত পাওয়া গিয়েছে যে বাংলাদেশে রুমি চর্চার শুরু ইত: বিক্ষিপ্ত ভাবে অনেক আগে শুরু হলেও এর প্রায়োগিক ও বিস্তারিত অবয়ব সনাক্ত করণ সম্ভব হয় সৈয়দ আহমদুল হকের হাতে। এই বিশাল বাংলায় সুফিবাদেও সগৌরব উপস্থিতি দীর্ঘকালের। কখনো প্রকাশ্য কখনো প্রচ্ছন্ন কখনো প্রগলভ, কখনো প্রতীকে প্রত্যয়ে মরমী ভাবধারা বাউল কবির কন্ঠে, সাইজীর আখড়ায় আপাত শ্রুত বলে মনে হলেও সেই প্রাচীন উপনিষ্‌দ কালেও তাদের ধ্যান ও দর্শনের মধ্যে সুফি তত্ত্বের যোগসূত্র সন্ধান মিলবে। ভলগা থেকে গঙ্গায় যে স্রোতধারা শতসহস্র বছরের বহমান, তার মধ্যে যাতায়াত ঘটেছে এই দর্শন আচারী আবহের। পারস্যেও কবি মওলানা জালালউদ্দিন রুমির অমিয়বাণী বাংলার পথে প্রান্তরে চারন কবির কন্ঠে, শুধু নয় নিভৃতচারী সাধক, কর্মবীর আর মুখরিত মানুষের মুখে মুখেও ফিরেছে। আমাদের জীবন মানে, ধ্যান ও জ্ঞানে, প্রত্যয় ও প্রত্যাশায়, চাওয়া পাওয়ার প্রান্তরে মরমী ধ্যান ধারণার অন্যতম সাধকের ভূমিকায় ছিলেন সৈয়দ আহমদুল হক।
বাংলাদেশের রুমি চর্চার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার জন্য যে রুমি সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয় তার সূত্রপাত ঘটান সৈয়দ আহমদুল হক। তিনি নিজে আজীবন সুফি সাধনায় আত্ম নিয়োজিত ছিলেন। রুমি চর্চায় তার নিজের আধ্যাত্মিকতা, অধ্যয়ন অধ্যবসায় আচার আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ থাকেনি তিনি বাংলা ভাষায় রুমির রচনাবলীকে সরল সরস প্রাঞ্জল অনুবাদ ভাবানুবাদের মাধ্যমে জনপ্রিয় করার পদক্ষেপ নিয়েছেন। সুফি সাধনা মূলত: মুক্তবুদ্ধি সনাতন ধর্মচর্চা-ধর্মের সাথে কর্মের সংযোগ সমন্বয় সাধনের যে আদর্শ ধর্মীয় গোড়ামী রহিত ও মানবিক মূল্যবোধের আদর্শে উজ্জীবিত-মানুষের মনুষত্বের উদ্বোধন আহবান – নিজেকে চেনার যে কোশেষ এ সবই সুফি সাধনার অন্তর্বিহিতবানী। এ কারণে সুফি সাধকরা যুগে যুগে মুক্ত বুদ্ধি মানুষ, সার্বিক সাংস্কৃতিক বিকাশ ও সমপ্রদায়গত ভেদ বুদ্ধি বিভাজন রহিত উদার উন্মুক্ত মনোভাব মনোভঙ্গির বিকাশকে প্রাধান্য দিয়েছে।
ধর্ম আর কর্মের মধ্যে সংযোগ-সমন্বয় সুফী তত্ত্বের সারকথা। চিন্তা থেকে কাজের উৎপত্তি। যেমন ভাবনা তেমনই তার বাস্তবায়ন। মনের মধ্যে বাস করে এক কর্মবিধায়ক তার আবাস অবগাহনের সুতা গাঁথা আরেক সূত্রে। ভাববাদীরা যাকে বলে, আদিবাস তার আরশে মহল্লায়, সেখানে সে থাকে প্রভু নিরঞ্জনের নিরন্তর তত্ত্বাবধানে। আর এদিকে তার ছায়া ‘(মানবদেহের) খাঁচার ভেতর অচীন পাখী’ হয়ে বারবার আসা যাওয়া করে – তার পায়ে বেড়ি দেয়ার প্রয়াস চললেও তাকে বাঁধা যায়না। কেননা তার মূল সুখ বাঁধা আছে আরশে মহল্লায় । তার প্রতিফলন ঘটে, আট কুঠরী নয় দরজারমধ্যে, অচীন এই পাখিটির পিঞ্জরায়। মুরুলী বাশীর সুর শুনে সে শুধু লাফায়। নিত্য যোগাযোগ তার সাথে। কিন্তু সে যোগাযোগের অবকাঠামো অনুধাবনে সকলের সম্মিৎ সমান যায়না। আয়নায় মরিচা ধরলে প্রতিফলন পরিস্ফুট হয়না – আয়না পরিস্কার থাকা চাই – রাখা চাই। মরমী সাধকেরা তাদের আয়না পরিস্কার রাখতে তৎপর। আর দশজনের চাইতে তাদের যোগাযোগের জ্যোতি ও গতিমাত্রা অনেক বেশি।
বাংলাদেশের মানুষ আবহমান কাল থেকেই ধর্মভীরু। সুদূর অতীত থেকে এতদঞ্চলে খ্যাতিমান অলি-আউলিয়া, সুফি-সাধক আর গাউস-কুতুবদের মাধ্যমে ইসলামের প্রচার-প্রসার ঘটেছে। নির্মোহ, নির্লোভ, নিঃস্বার্থ, নিরহংকারী আর অন্যের জন্যে নিবেদিত ও সৃষ্টির সেবায় জীবন উৎসর্গকারী এসব সুফি, পির ও দরবেশদের পরিচ্ছন্ন, নির্মল ও সহজ-সরল জীবন-যাপন এতদঞ্চলের জন-মানুষকে শানিতর ধর্ম ইসলামের প্রতি ব্যাপকভাবে আকৃষ্ট ও প্রভাবিত করেছিল। সুফি-সাধকগণের কোমল ব্যবহার, তাদের অনুপম চারিত্রিক মাধুর্য, ব্যক্তিত্বের যাদুময়ীতা আর অনন্য সাধারণ অলৌকিকত্বই এদেশে ইসলামের ভীতকে সুদৃঢ় ও শক্তিশালী করেছে। আর তাঁদের প্রভাবেই ধর্মপ্রাণ বাঙালি মুসলমানেরা যুগ-যুগ ধরে বাসতব জীবনে অলি-সুফিদের প্রভাবে প্রেমময় ইসলামের সুফিবাদী ভাবধারাকে স্বতঃস্ফুর্তভাবে হৃদয়ে ধারণ ও লালন করে আসছে। আধুনিক বাংলাদেশে সুফিবাদের এই ধারার সার্থক উত্তরাধিকারী সাধক পুরুষ ছিলেন সৈয়দ আহমদুল হক।
মানবতা আর অন্যের জন্যে নিবেদিত ও সৃষ্টির সেবায় জীবন উৎসর্গকারী সুফিসাধকদের পরিচ্ছন্ন, নির্মল ও সহজ-সরল জীবন-যাপন এতদঞ্চলের জন-মানুষকে মানবতা ও সহমর্মীতার প্রতি ব্যাপকভাবে আকৃষ্ট ও প্রভাবিত করেছিল। তাঁদের চিন্তাজগতে ভর করেছে শান্তিময় সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন-সাধনা, জাতি-ধর্ম আর বহু মত-পথের ভেদাভেদ ভুলে এক প্রভুর সৃষ্টি আশরাফুল মাখলুকাত মানুষ হিসেবে মূল্যায়নের চেতনা, অসামপ্রদায়িক মূল্যবোধ আর নৈতিক-চারিত্রিক উৎকর্ষতার প্রেরণা। সৈয়দ আহমদুল হকও একই ভাবাপূর্ণ ও চিন্তাধারায় বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি বেছে নিয়েছিলেন অবিরাম সুফিতাত্ত্বিক গবেষণা, মসনবী চর্চা ও রুমি দর্শনের আলোকে মানবচিত্তে শান্তির খোরাক বিতরণের পথকে। আর তা করতে গিয়েই তিনি সুফিতত্ত্বের গভীরে প্রবিষ্ট হয়েছেন; কুড়িয়ে এনেছেন অমূল্য সব রত্নরাজি তিনি ছিলেন সর্বোতভাবে উদার ধর্মবোধে বিশ্বাসী ও সামপ্রদায়িকতা রহিত মূল্যবোধের প্রবক্তা সৈয়দ আহমদুল হক ধর্মকে শান্তির উৎস হিসেবে দেখেছেন, তুলে ধরেছেন। আজও তাই তিনি এবং তাঁর আধ্যত্মবাদ ও মানবতাবোধের মরমী জ্ঞানী আমাদের অনুপ্রাণিত করে। তাঁর ভাবধারায় সমসাময়িক প্রাসঙ্গিকতা আমাদের জন্য এক নুতন অর্থ ও ব্যাঞ্জনা বয়ে আনে। সৈয়দ আহমদুল হকের জন্মবার্ষিকীতে বাংলাদেশের আমরা সবাই তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই আমাদের আন্তরিক শ্রদ্ধা। তিনি তাঁর কর্মের মধ্যেই আমাদের মধ্যে বেঁচে আছেন। নিশ্চিতভাবে ভবিষ্যতেও এর ব্যতিক্রম হবে না।
লেখক : কলামিস্ট; সরকারের সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান

পূর্ববর্তী নিবন্ধরক্তাক্ত পঁচাত্তর : কমিশন অত:পর ট্রুথ কমিশন
পরবর্তী নিবন্ধদুস্থদের মাঝে লালখান বাজারে ত্রাণ বিতরণ