ভূগোলের গোল

ডাঃ কিউ এম অহিদুল আলম | মঙ্গলবার , ২৩ নভেম্বর, ২০২১ at ৬:১৮ পূর্বাহ্ণ

হাঁপানি : শীতকালে

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমাদের দেশেও ঋতুর আগমন আগের মত হয় না। অন্তত: মাস খানেকের পার্থক্য চোখে পড়া্‌র মতো। শীতও কার্তিক মাসেই আগাম বার্তা দেয়। তাই শীতকালীন রোগ বালাই ও মৌসুম পরিবর্তনের সাথে সাথেই শুরু হয়ে যায়। শীতের শুরুতেই হাঁপানি রোগ বেড়ে যায়।
পৃথিবীব্যাপী প্রায় ৩০-৩৫ কোটি হাঁপানি রোগ আছে বর্তমানে। তার মধ্যে বাংলাদেশে প্রায় ১ কোটি লোক হাঁপানি রোগে ভুগে। পৃথিবীর ধনবাদী দেশেও শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে সরকারি সাহায্য দৃশ্যমান।আমাদের দেশে স্বাস্থ্য সরকারী সাহায্য যতবেশীই হউক না কেন জনসংখ্যার ভারে তা অপ্রতুলই থেকে যাবে, তাই কয়েকটি রোগের চিকিৎসা ভার সরকারের হাতে থাকা অবশ্যক। ক্যান্সার, বাচ্চাদের সংক্রমণ রোগ এবং হাঁপানি অন্যতম। কারণ হাঁপানির চিকিৎসা ইনহেলার অতীব জরুরী সামগ্রী। চিকিৎসা নিতে আসা ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে যথাযথ ইনহেলার ব্যবহারের খরচ বহন করা সম্ভব নয়। আমরা যারা হাঁপানির চিকিৎসা করি তারা লায়ন্স ক্লাব, রোটারি ক্লাব সহ ধনীদের থেকে যাকাত হিসেবে শীতকালে ইনহেলার সংগ্রহ করি দরিদ্র রোগীদেরকে দেওয়ার জন্য। এসব হচ্ছে চিকিৎসার একটা দিক। অন্যদিকে হচ্ছে হাঁপানির দৃশ্যমান কারণগুলো থেকে বিরত থাকার প্রচেষ্টা। শীতকালে হাঁপানির প্রকোপ বেড়ে যায় বলে অনেকগুলো নিয়ম কানুন মানা কোনমতে উপসর্গ সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্য জরুরী। হাঁপানি মূলত: এলার্জিজনিত রোগ, এলার্জির কারণ ঘরে ও বাইরে শীতকালে বাতাস শুষ্ক হয়ে যায়। বাতাসে অনেক ফুল ও গাছের পরাগ ভেসে বেড়ায়, এক এক রোগীর এক এক জিনিসের কারণে হাঁপানি হয়। আমাদের দেশে শীতকালে ধান কাটা হয়। ধানের ঘর,ধানের উপরের আস্তরণ ছোট্ট কণা, হরেক রকমের উদ্ভিদ কণা (মোদ্দা ভাষায় ঐধু) শীতকালে বাতাসে ছড়িয়ে যায়। যাতে হাঁপানি বেড়ে যায়, এই জন্য যারা কৃষি কাজে নিয়োজিত তারা অবশ্যই মাক্স অথবা পাতলা রুমাল নাকে বেঁধে কাজ করবেন আর কাজ শুরুর আগে নাক ওজুর মত করে ভিজাবেন ও ঘনঘন নাক-মুখ চোখ ধুবেন। এতে পরাগ ও ঐধু ধুলিকণা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
শীতের দিনে বাইরে গেলে নাক ও পা সেইফ করে চলতে হবে। কিন্তু প্রথাগতভাবে আমাদের দেশে মানুষ গায়ে বাপ-দাদার যত জাকেট, সোয়েটার, শাল সব পরে। কিন্তু ঠান্ডা বাতাস নাক ও পা কে উত্ত্যক্ত করে শ্বাস রোগ শুরু হয়। রাতে ঘরে জানালা, দরোজা পুরো খোলা রাখলে বাতাসের ফ্লোটা নাকের ও শরীরের অ-ঢাকা অংশের রিসেপ্টরকে উত্ত্যক্ত করে যা নরমাল মানুষ এডজাস্ট করতে পারে। কিন্তু হাঁপানি রোগীরা অ্যাডজাস্ট করতে পারে না। অতএব গরমের ভেন্টিলেশন আর শীতকালীন ভেন্টিলেশন এডজাস্ট করতে হবে! এমনভাবে জানালা-দরজা এটে দিতে হবে যাতে সামান্য গতিতে বাতাস ঢুকে, হাই ফ্লো যাতে না হয়। ইঁদুর, তেলাপোকা চিকা আমাদের প্রায় ঘরেই দেখা যায়, এগুলোর মল ও ক্ষুদ্র কণা হাঁপানির অন্যতম কারণ। এগুলো ঝাড়ু না দিয়ে ভেজা কাপড় দিয়ে মুছে বেসিনে ফেলা উত্তম।শীত আসতে যেমন হাঁপানির ধাক্কা লাগে তেমনি শীত যেতে ও (ফেব্রুয়ারি-মার্চ) হাঁপানি বৃদ্ধি হতে দেখা যায়। এজন্য শীতের বিদায় ও সেইফ করে চলতে হবে।
গ্রামে বাচ্চারা খোলা মাঠে খেলে, কুয়াশায় ঘোরে, সেখানে ওকুয়াশা থেকে বাঁচার জন্য মাথায় ক্যাপ, পাতলা মাফলার (উলের নয়) দিয়ে নাক ঢাকা, পায়ে সকালে দুতিন ঘন্টা, বিকেলে শোওয়া পর্যন্ত হালকা মোজা (গরম নয়) ব্যবহার করা জরুরি, খেলার শুরু ও শেষে নাকে ওযু করার মত পানি দিয়ে ঘনঘন ধুয়ার অভ্যাস করতে হবে। বাচ্চা ও বয়স্ক ব্যক্তি, হাঁপানি রোগীদের শীত শুরুর মাস দুয়েক আগে অথবা যাদের শীতের শেষে রোগ বেড়ে যায় তাদের ক্ষেত্রে শীত শেষে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাকসিন দেওয়া উত্তম। যাদের কেবল ংবধংড়হধষ উপসর্গ হয় তাদের ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। সিজন শুরুর মাস দুয়েক আগে, বর্তমানে প্রাক সিজনাল (চৎবংবধংড়হধষ) কিছু বন্দোবস্ত আছে যা রোগীকে মৌসুমী উপসর্গ থেকে বাঁচায়।
অনেক মানুষ শখ করে পাখি, কবুতর, মাছের অ্যাকোয়ারিয়াম রাখে। এসব হাঁপানি করতে পারে। অনেকে প্রশ্ন করবেন অমুক বাসায় তো এসব পাখি, একুরিয়াম আছে। ওদের তো হাঁপানি হয় না, এর সাদামাটা জবাব রাস্তায় হাঁটলে গাড়ি চাপা সবাই পড়ে না, কেউ কেউ পড়ে। এক এক মানুষের এক এক জিনিসের প্রতি এলার্জি থাকে। যার হাঁপানি নাই সে ঘরে ওসব রাখুক। কিন্তু তার বংশে আছে বা যার উপসর্গের শুরু তার পরিবেশে ওসব রাখলে রোগ ভালো হবে না যতই দামী ইনহেলার ব্যবহার করা হোক না কেন।
পরিশেষে বলতে হয়, এত উন্নত চিকিৎসা সত্ত্বেও হাঁপানি থেকে মৃত্যু হচ্ছে। তাই প্রতিরোধীই আশা। নিজের পরিবেশ এলার্জি কারণ মুক্ত রাখা ও শীতকালীন আবহাওয়ার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কাপড়, মাস্ক, মাফলার, মোজা ব্যবহার করলে অনেক উপসর্গ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
লেখক: চিকিৎসক

পূর্ববর্তী নিবন্ধলোকসাহিত্যের গবেষক মুহাম্মদ ইসহাক চৌধুরী
পরবর্তী নিবন্ধকৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহারে উৎপাদন বেড়েছে