পদ্মা সেতু : একটি দুঃসাহসী প্রয়াসের সফল বাস্তবায়ন

মোহাম্মদ আমান উল্লাহ খান | বুধবার , ৭ জুলাই, ২০২১ at ৫:৪১ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু প্রথম যমুনা নদীর উপর সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। তার প্রথম জাপান সফরের সময় তিনি জাপান সরকারকে যমুনার উপর সেতু নির্মাণে সার্বিক সহায়তা করার ব্যাপারে সম্মত করান। এ ব্যাপারে কিছু প্রাথমিক প্রস্তুতি গ্রহণের পর পরই বঙ্গবন্ধুর শাহাদতের পরে জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসেন। তিনি উক্ত পরিকল্পনা ব্যয় সাপেক্ষ বলে কারণ দেখিয়ে বাতিল করে দেন। তার সময়কালে বন্ধ থাকার পর, তার মৃত্যু হলে জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় আসেন এবং তিনি তার জাপান সফরে জাপান সরকারকে ঐ পরিকল্পনা পুনরায় আরম্ভ করার জন্য সম্মত করান। তার নয় বছরের শাসনামলে উক্ত কাজ কিছুটা অগ্রসর হলেও সম্পূর্ণ হওয়ার অনেক আগে তাকে আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ত্যাগ করতে হয়।
অতঃপর বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি ক্ষমতায় আসলে উক্ত সেতুর অসমাপ্ত কাজ বহুলাংশে সমাপ্ত করলেও সম্পূর্ণ করার পূর্বে তারা নির্বাচনে পরাজিত হয়ে ক্ষমতা ত্যাগ করতে বাধ্য হন। অতঃপর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে এবং তাদের হাতে যমুনা সেতু বা বঙ্গবন্ধু সেতু সমাপ্ত ও উদ্বোধন হয়। যমুনা সেতু সমাপ্ত হওয়ার পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দ্বিতীয় পরিকল্পনা ছিল বাংলাদেশের বৃহত্তম নদী পদ্মার উপরে সেতু নির্মাণ করা। যা রাজধানী ঢাকাকে দক্ষিণ, দক্ষিণ-পশ্চিমের ২৯টি জেলার সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট করবে।
বাংলাদেশের ইতিহাসের বৃহত্তম এবং সর্বাধিক ব্যয় বহুল এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য তিনি বিশ্ব ব্যাংকের কাছে সহায়তা প্রদানের আহ্বান জানান। বিশ্ব ব্যাংক তাতে সম্মতি প্রদান করে এবং তাদের পক্ষ হতে একজন বিশেষজ্ঞকে প্রেরণ করে প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ ও প্রয়োজনীয় ব্যয় ইত্যাদির ব্যাপারে প্রাক-সমীক্ষা সমাপন করে। কিন্তু এ দেশ মীর জাফরের দেশ। মীর জাফরের বিষাক্ত নিঃশ্বাস এখনও এদেশের আবহাওয়াকে কলুষিত করছে। বঙ্গোপসাগরের প্রবল নির্মল বাতাস আজও একে বিলুপ্ত করতে পারেনি।
দেশের জনগণ যখন এ মহা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুখ-স্বপ্নে মগ্ন, তখনই পর্দার অন্তরালে ঘটে গেল এক অপ্রত্যাশিত অঘটন। একটি কাল্পনিক অভিযোগ সৃষ্টি করে বিশ্ব ব্যাংক উক্ত সহযোগিতা বাতিল করে দিল। বিশ্ব ব্যাংকের এ সিদ্ধান্ত যখন বাংলাদেশের মানুষের মাঝে হতাশা ও সরকারের প্রতি ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে, এমন সংকটময় মুহূর্তে জাতির পিতার সাহসী কন্যার নির্ভীক কণ্ঠে ঘোষিত হলো- পদ্মা সেতু হবে এবং আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়িত হবে। ইনশাআল্লাহ।
“তোমাদের যা কিছু আছে তা নিয়েই শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে” বঙ্গবন্ধুর এ ডাকে যেমন বাঙালি জাতি তাদের যা কিছু আছে তা নিয়ে অকুতোভয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, পৃথিবীর সেরা সৈন্য বাহিনীর বিরুদ্ধে নিজ মাতৃ ভূমিকে মুক্ত করার মহৎ উদ্দেশ্যে, তেমনি তাঁর তেজস্বী কন্যার আহবানে বাংলাদেশের সেরা মেধাবী সন্তানেরাও ঝাঁপিয়ে পড়ল পৃথিবীর জটিলতম কারিগরী কর্মে। দেশের বৃহত্তম ও সর্বাধিক খরস্রোতা প্রমত্তা পদ্মার উপর সেতু নির্মাণের দুরূহ কর্মে নিয়োজিত হলো দেশ প্রেমিক বাঙালি প্রকৌশলী, সেতু নির্মাণ বিশ্লেষজ্ঞরা। আপ্রাণ প্রচেষ্টায় আত্ম নিয়োগ করল তাদের প্রজ্ঞা, বুদ্ধিমত্তা, কারিগরী জ্ঞান ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে।
পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজে বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন কারিগরী ও প্রকৃতিগত চ্যালেঞ্জ এসেছে। পদ্মা নদী ভারত উপ মহাদেশের দীর্ঘতম ও প্রশস্ততম নদী সমূহের অন্যতম। পদ্মা সেতু নির্মিত হয়েছে এ সুদীর্ঘ এবং তীব্র খরস্রোতা নদীর প্রায় শেষ প্রান্তে। বর্ষার সময়ে এ বিশাল নদী প্রমত্ত আকার ধারণ করে। তা ছাড়া যে স্থানে এ সেতু নির্মিত হয়েছে এর তলদেশে পলি মাটি ও নরম মাটির স্থরটি খুবই গভীর। কারণ হিমালয়ে এর উৎপত্তি স্থল থেকে নেপাল আর ভুটান হয়ে এ নদী হিন্দুস্থানে প্রবেশ করেছে।
হিমালয়ের প্রান্তবর্তী গাঢ়োয়াল প্রদেশের গাঙ্গেত্রী নামক স্থান হতে এ নদী গঙ্গা নাম ধারণ করে হিন্দুস্থানে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশ এ নদীর নাম হয়েছে পদ্মা নদী। যে স্থানে সেতুটি নির্মিত হচ্ছে, উৎপত্তিস্থল থেকে এর দূরত্ব প্রায় ১৬০০ মাইল (নদীর গতিপথ হিসাবে) স্বাভাবিকভাবেই এ সুদীর্ঘ পথের স্রোতে বাহিত পলিমাটিও উভয় দিকের নরম খরপাতা পানির সাথে সংমিশ্রিত হয়ে নদীর মোহনার কাছে সঞ্চিত হতে থাকে। পদ্মা সেতু যে স্থানে নির্মিত হয়েছে সে স্থানটি মোহনার কাছে। স্বাভাবিকভাবে এ স্থানে নদী অতি প্রশস্ত এবং তলদেশে পলি ও অন্যান্য নরম মাটির স্থর খুব গভীর। স্বাভাবিকভাবে তাই এ সেতু নির্মাণে প্রকৌশলীগণকে যে কঠিন সমস্যার সম্মুখিন হতে হয়েছে এমন কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়নি পৃথিবীর অন্য কোন সেতুনির্মাণের বেলায়।
প্রমত্তা পদ্মার উপর দিয়ে যে সেতু নির্মিত হবে তার উপর দিয়ে চলবে বাস, ট্রেন। যাতায়াত করবে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিমের লক্ষ লক্ষ মানুষ। সুতরাং এ সেতুর প্রতিটি পাইল বিশ্বের গভীরতম। সর্বোচ্চ ১২২ মিটার পর্যন্ত গভীরে বসানো হয়েছে কোন কোন পিলার। কোটি মানুষের স্বপ্ন ও প্রত্যয়ের সাথে যোগ দেয় সহস্র কর্মীর হাত, শত প্রকৌশলীর মেধা, এক একটি পিলার বসানো, স্পান জোড়া দেওয়ার ঘটনা সবকিছু ছিল বাংলাদেশের জনগণের গর্বের বিষয়। মূল সেতুর প্রকল্প ব্যবস্থাপক দেওয়ান মোহাম্মদ আবদুল কাদের বলেন- যে কোন প্রকৌশলীর জন্য এমন অভিজ্ঞতা স্বপ্নতুল্য। শেষ স্পান বসানের মুহূর্তটি ছিল সকল প্রকৌশলী ও শ্রমিকদের জন্য জীবনের সব ছেয়ে বড় অর্জন। এটা নিশ্চিত বলা যায় যে, ইন্দো-গাঙ্গেয় সমভূমিতে নির্মিত দ্বিতীয় বৃহত্তম সেতু হতে চলেছে পদ্মা সেতু।
ভারতের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের বেশীর ভাগ এলাকা, পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল, বাংলাদেশ ও নেপালের দক্ষিণাঞ্চল নিয়ে ইন্দোগাঙ্গেয় সমভূমি। এর বৃহত্তম সেতু হল আসামের ভূপেন হাজারিকা সেতু যা ব্রহ্মপুত্রের শাখা লোহিত নদীর উপর নির্মিত। এটির দৈর্ঘ্য ৯.১৫ কিলোমিটার। পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার। পদ্মা সেতুর বিশেষত্ব হল এটি দ্বিতল, নিচের অংশে ছুটবে রেল, উপরের দিকে গাড়ি। সেতু বিভাগের সূত্রে জানা যায় পদ্মা সেতু প্রকল্পের নদী শাসন ও মূল সেতুর কাজে চার হাজারের বেশি কর্মী কাজ করেছেন। এর বেশির ভাগ বাংলাদেশি। চীনের কর্মী ছিলেন এক হাজারেরও বেশি, এছাড়া জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ডস ও যুক্তরাষ্ট্রের লোকজনও কাজ করেছে।
পরামর্শক দলে কাজ করেছেন প্রায় ১৪টি দেশের প্রকৌশলীরা। দেশগুলো হলো- বাংলাদেশ, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ফিলিপাইন, মালেয়শিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর, ভারত, নেপাল, কানাডা, যুক্তরাজ্য ইতালী ও নেদারল্যান্ডস।
প্রকল্পের কাজে ব্যবহৃত স্টিলের সব কাঠামো চীন থেকে এসেছে। রেলের গার্ডার এসেছে লুঙ্মেবার্গ থেকে। প্রকল্পে যত রড ও সিমেন্ট ব্যবহার হয়েছে সবই বাংলাদেশের। তবে অস্ট্রেলিয়া থেকে কিছু অতি মিহি সিমেন্ট ব্যবহার করতে হয়েছে বিশেষ ক্ষেত্রে। সংযোগ সড়ক নির্মাণে মধ্যপাড়ার কঠিন শিলাখনি থেকে পাথর ব্যবহার করা হয়েছে। এর বাইরে বেশিরভাগ পাথর ব্যবহার করা হয়েছে ভারত, দুবাই, ওমান ও ভিয়েতনামের।
যত বড় বড় ড্রেজার পৃথিবীর বিভিন্ন ভারি কাজে ব্যবহৃত হয় তার অন্তত তিনটি ব্যবহৃত হয়েছে পদ্মা সেতুতে। এগুলো আনা হয়েছে নেদারল্যান্ডস থেকে। পাইল বসানোর জন্য হাইড্রলিক হাতুড়ি (হ্যামার) এসেছে জার্মানি থেকে। সবচেয়ে বড় হাতুড়িটির ক্ষমতা ছিল তিন হাজার কিলোজুল। এর বাইরে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকে আনা যন্ত্রপাতিও ব্যবহৃত হয়েছে।
আর বাকি কিছু যন্ত্রপাতি চীনেরও ছিল। বিভিন্ন সময়ে ১৭টি বড় বড় ক্রেন ও ভারী যন্ত্রপাতি একসঙ্গে কাজ করেছে। এর মধ্যে সব চেয়ে বড় ভাসমান ক্রেনটি দ্বারা তিন হাজার দুইশত টন ওজনের ইস্পাতের স্পান বসানো হয়েছে।
সার কথা হলো পদ্মা সেতুতে পাইল বসানো হয়েছে মোট ২৮৪ টি। তার মধ্যে ২৬২ টি স্টিল আর ২৪টি কংক্রিট, প্রতিটির পরিধি তিন মিটার, মাটির নিচে গেছে ১১৪ থেকে ১২০ মিটার যা পৃথিবীর গভীরতম। মূল সেতুতে স্পান বসেছে ৪১ টি প্রতিটি স্পান ১৫০ মিটার। ২০১৭ সালে প্রথম স্পান বসানো হয় ৩০ সেপ্টেম্বর, আর ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর শেষ স্পান বসানো হয়েছে। ২০২২ সালে সর্ব সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকার অধিক ব্যয়ে নির্মিত এ সেতুটি। এ সেতু দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জীবনে এনে দেবে নুতন সম্ভাবনা। আমাদের সেতু মন্ত্রী সাহেব বলেছেন-“বিশ্ব ব্যাংককে দেখিয়ে দিয়েছি আমরাও পারি”। পদ্মা সেতু বিশ্বের বিস্ময়, ভারত উপমহাদেশের বুকে দ্বিতীয় তাজ মহল। শত বৎসর ধরে এ সেতু দিয়ে চলবে হাজার মানুষ আর তাদের স্বস্তি ও শান্তির মাঝে বেঁচে থাকবেন তার স্নেহময়ী জননী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পদ্মা সেতু নির্মাণের সময়ে এ সেতু শেখ হাসিনা সেতু নামকরণ করার প্রস্তাব উঠেছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নিজেই তা বাতিল করে এর নাম পদ্মা সেতু থাকবে বলে সিদ্ধান্ত দেন। ইতোপূর্বে একবার একজন মন্ত্রী প্রকাশ্য সভায় বলেছিলেন- ‘মাননীয় নেত্রী আপনি মাহাথির মোহাম্মদ হন’। তিনি জওয়াব দিয়েছিলেন- ‘আমি মাহাথির মোহাম্মদ হতে চাই না, আমি শেখ হাসিনা থাকব’। এটি আমাদের যোগ্য প্রধানমন্ত্রীর গভীর প্রজ্ঞার প্রমাণ।
লেখক : প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধশ্রদ্ধাঞ্জলি : অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ
পরবর্তী নিবন্ধভারতে চার মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন দৈনিক শনাক্ত