শ্রদ্ধাঞ্জলি : অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ

মোহাম্মদ খোরশেদ আলম | বুধবার , ৭ জুলাই, ২০২১ at ৫:৪০ পূর্বাহ্ণ

১৯৭২ সালে রচিত বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধান প্রণয়ন কমিটির ৩২ জন সদস্যের মধ্যে অন্যতম সদস্য ছিলেন অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারের মৃত্যুর পর দৈনিক আজাদীর সম্পাদকের দায়িত্ব নেন তিনি। ১৯৬২ সাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক স্বাধীনতা পদক প্রাপ্ত এই গুণীজন ১৯২২ সালের ৬ জুলাই তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বিহার রাজ্যের রাজধানী পাটনায় তাঁর পিতা আবদুল হাদী চৌধুরীর কর্মক্ষেত্রে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পৈতৃক নিবাস চট্টগ্রামের রাউজানের সুলতানপুর গ্রামের দারোগা বাড়ি। ১৯৪২ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই কলেজের ছাত্র ছিলেন। পারিবারিক কারণে পাঠ সমাপ্ত না করে দেশে ফিরে এসে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে স্নাতক সমাপ্ত করে পরবর্তীতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামের ইতিহাসের স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৪৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হন। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা হলে তিনি এদেশের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৪-এর সাম্প্রদায়িক প্রতিরোধ আন্দোলন, ’৬৬-এর ঐতিহাসিক ৬ দফা আন্দোলন ’৬৯-এর গণ আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। ’৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর মনোনীত প্রার্থী হিসেবে রাউজান-হাটহাজারী সংসদীয় আসনে নির্বাচনে অংশ নিয়ে তৎকালীন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পিকার ফজলুল কাদের চৌধুরীকে বিপুল ভোটে পরাজিত করেন। ’৭১ সালে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে তিনি চট্টগ্রামে ছাত্র ও যুব সমাজকে সংগঠিত করেন এবং সংগ্রাম পরিচালনার জন্য গঠিত ৫ জন সদস্যের মধ্যে অন্যতম সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে কালুরঘাটে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনায় তিনি সরাসরি জড়িত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মুজিব নগর সরকারের তথ্য দপ্তরের দায়িত্ব প্রাপ্ত হিসেবে স্বাধীন বাংলা বেতারের উপদেষ্টা নিযুক্ত হন। পাশাপাশি মুজিব নগর সরকারের মুখপাত্র হিসেবে প্রকাশিত ‘জয় বাংলা’ পত্রিকার সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু তাকে বাকশালের উত্তর জেলার গভর্নর নিযুক্ত করেন। চট্টগ্রামের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসা ছিল। তিনি ছিলেন মাটি ও মানুষের নেতা। উন্নয়নের ভূমিকা রাখতে শত নাগরিক কমিটি গঠন করে চট্টগ্রামের দলমত নির্বিশেষে সকলকে একই প্লাটফর্মে আনেন যা অন্য কোন রাজনীতিক নেতার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তচিন্তা চর্চার পথিকৃৎ। এই মহান ব্যক্তিত্বের স্মরণে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব প্রতি বছর অধ্যাপক খালেদ স্মারক বক্তৃতার আয়োজন করে থাকে। চট্টগ্রাম একাডেমি প্রতি বছর ফেব্রুয়ারিতে অধ্যাপক খালেদ শিশুসাহিত্য পুরস্কার প্রদান করে থাকে। ইতিমধ্যে বাংলা একাডেমি তাঁর জীবনী গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। তিনি সকল লোভ লালসার ঊর্ধ্বে ছিলেন। বঙ্গবন্ধু একনিষ্ট ও ঘনিষ্ঠ সহকর্মী হিসেবে তাঁর অনেক সুখ্যাতি ছিল। জাতীয় পরিষদ সদস্য থাকাকালীন সর্বক্ষেত্রে তাঁর অবদান ছিল প্রশংসনীয়। আজ কাল অনেক মন্ত্রী ও এমপির বিরুদ্ধে দুর্নীতি বা সমাজের অপরাধ ঘটানোর প্রবণতা দেখা যায়। অধ্যাপক খালেদ সাহেবের আমলে এই সব চিন্তা করা দুঃস্বপ্ন ছিল। এক কথায় সে সময় সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির ছিটেফোঁটাও ছিল না। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সাথে আমার সু-সম্পর্ক ছিল। তিনি আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট প্রেক্ষাপট নিয়ে অনেক চিন্তা ভাবনা করতেন। বঙ্গবন্ধু ও দলের প্রতি তাঁর আনুগত্য, শ্রদ্ধাবোধ ছিল। যার কারণে তিনি খন্দকার মোস্তাকের লোভনীয় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। সে সময় ইচ্ছে করলে আরাম আয়েশি জীবন যাপন করতে পারতেন। নীতি এবং আদর্শের প্রতি অবিচল থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর জয়গান গেয়েছেন। মৃত্যুর এক মাস আগে তাঁর বড় ছেলে মো. জমির দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। ছোট ছেলে মো. জহির সাপ্তাহিক স্লোগান পত্রিকার সম্পাদক। অধ্যাপক খালেদ আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারের জামাতা ও বর্তমান সম্পাদক এম. এ. মালেকের ভগ্নিপতি। আমার মরহুম পিতা আবদুল মাবুদ সওদাগরের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ২০০১ সালে মার্চ মাসে চেরাগী পাহাড়স্থ সেন্টার পয়েন্ট হাসপাতালে আমার অসুস্থ পিতাকে দেখতে আসেন তিনি এবং সেখানে দীর্ঘ সময় অবস্থান করেন। সাথে ছিলেন বাঁশখালীর কৃতী সন্তান ভারতের কোলকাতার দক্ষিনেশ্বর আদ্যাপীঠের ধর্ম গুরু মুরাল ভাই। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সুস্থ অবস্থায় তিনি কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদে পবিত্র জুমার নামাজ আদায় করতেন। বয়সে ছোট হলেও কাউকে আপনি ছাড়া তুমি বলে সম্বোধন করতে শুনি নি। আপাদমস্তক একজন ভদ্রলোক ছিলেন তিনি। সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। সবসময় রিকশা যোগে যাতায়াত করতেন।
দেওয়ান বাজারস্থ আমেনা মঞ্জিলে একটি ভাড়া বাসায় জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন। দৈনিক আজাদীর মতো ঐতিহ্যবাহী ও বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রের সম্পাদক হয়েও তাঁর মাঝে কোনো অহংকার ছিল না। দীর্ঘ ৪১ বছর সততা ও নিষ্ঠার সাথে আজাদীর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। একজন সম্পাদকের উপর নির্ভর করে পত্রিকার জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা। চট্টগ্রামের রাজনীতিকরা তাদের যে কোনো সংবাদ অন্য পত্রিকায় ছাপানোর আগে আজাদীতে ছাপিয়েছে কিনা সেটা নিশ্চিত করেন। এমন ক্ষণজন্মা পুরুষের আবির্ভাব এদেশে আর হবে কিনা সন্দেহ আছে। ২০০৩ সালের ২১ ডিসেম্বর তিনি না ফেরার দেশে চলে গেছেন। তাঁর এই শূন্যতা কখনো পূরণ হওয়ার নয়। আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারের প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করেছেন অধ্যাপক খালেদ, পরে সেই পথ অনুসরণ করে চলেছেন বর্তমান সম্পাদক এম এ মালেক। আজাদী তার আদর্শ থেকে একবিন্দু বিচ্যুত হয়নি। অধ্যাপক খালেদের মৃত্যুতে দেশবাসী হারিয়েছে একজন বরেণ্য বুদ্ধিজীবী। আমরা হারিয়েছি একজন রাজনীতিক অভিভাবক। আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করি তিনি যেন তাকে জান্নাতবাসী করেন।
লেখক: শ্রম বিষয়ক সম্পাদক, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধপদ্মা সেতু : একটি দুঃসাহসী প্রয়াসের সফল বাস্তবায়ন