বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের একটি কবিতায় নর-নারীর ভূমিকা সম্পর্কে বলেছেন, ‘পৃথিবীতে যা কিছু সৃষ্টি চিরকল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ আমার যদি ভুল না হয় তবে এ কবিতা থেকে একটি শিক্ষা মানব জাতি পেতে পারে। চিরকল্যাণের জন্য যা কিছু সৃষ্টি হয়েছে তার অর্ধেক করেছে নারী। আর অর্ধেক করেছে নর। এখানে উল্লেখ্য যে, চিরকল্যাণকর বিষয়ে অবদানের জন্য তিনি প্রথমে উল্লেখ করেছেন নারীকে। পরবর্তীতে উল্লেখ করেছেন নরকে বা পুরুষ জাতিকে। তাহলে এ কথা বলা যায়, মানব কল্যাণে প্রথম অবদান নারীর। আর পরবর্তী অবদান পুরুষের। কিন্তু হিন্দু সমাজ ব্যবস্থায় তথা হিন্দু আইনে দেখা যায়, উত্তরাধিকার সূত্রে একজন হিন্দু নারী কিছুই পায় না। পিতার সমস্ত সম্পদের মালিক হয় পুত্র সন্তান। এরূপ সমাজ ব্যবস্থা বা হিন্দু আইনের পেছনে একটি যুক্তিও আছে। হিন্দু সমাজপতিরা বলে থাকেন যে, কন্যা সন্তান সম্পত্তির আনুপাতিক অংশ না পেলেও উক্ত কন্যা সন্তানের বিবাহ হওয়ার পর তাঁর স্বামী উত্তরাধিকার সূত্রে স্বামীর পিতার সম্পত্তির ন্যায় ভাগ পেয়ে থাকে। অতএব হিসাব একই। একজন কন্যা সন্তান পিতার সম্পত্তির ভাগ না পেলেও তাঁর স্বামী, শ্বশুরের সম্পত্তির ভাগ যথাযথ পাওয়ার কারণে স্বামীর অবর্তমানে সে সব সম্পত্তির মালিক হয়। সুতরাং হিন্দু সমাজব্যবস্থায় কোন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। হিন্দু সমাজবাদীদের আরো কঠিন যুক্তি হলো যে, অনাদিকাল থেকে এ নিয়মে হিন্দু সমাজব্যবস্থা পরিচালিত হয়ে আসছে। এ সমাজ ব্যবস্থার ধারাবাহিকতায় কত জ্ঞানী ও গুণীজনের জন্ম হয়েছে। এ জ্ঞানী ও গুণীজনের মধ্যে নারী যেমন আছে তেমনি পুরুষও আছে। কাজেই কালের পরীক্ষায় হিন্দু সমাজ ব্যবস্থা উত্তীর্ণ। সুতরাং এর পরিবর্তন হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই।
কিন্তু পরিবর্তনবাদী হিন্দু সমাজবাদীরা সেই যুক্তি মানতে নারাজ। তাদের কথা হলো অর্থনৈতিক অগ্রগতির সাথে সাথে মানুষের জীবনধারায় পরিবর্তন হয়ে যায়। তাই জীবনধারার উন্নয়নের জন্য এবং অগ্রগতির সাথে সামঞ্জস্য করার জন্য হিন্দু সমাজব্যবস্থা পরিশোধন করা উচিত। উদাহরণ হিসেবে তাঁরা উল্লেখ করেন যে, হিন্দু সমাজ ব্যবস্থায় সহ-মরণের রীতি প্রচলিত ছিল। স্বামী মারা গেলে স্বামীর শ্মশানে স্ত্রীকে আত্মাহুতি দিতে হতো। হিন্দু ধর্মের এ রীতি পরিবর্তন হয়ে সমাজ ব্যবস্থা হলো এরূপ- স্বামী মারা গেলে স্ত্রী বিধবা হবে এবং উক্ত বিধবা স্ত্রী পুনঃ বিবাহ করতে পারবে না। দীর্ঘদিন ধরে এ নিয়ম সমাজে প্রচলিত ছিল। রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখ সমাজ সংস্কারক ও বিদ্যানদের প্রচেষ্টায় এরূপ রীতির পরিবর্তন হয়েছে। এখন হিন্দু সমাজে বিধবা বিবাহের রীতি প্রচলন আছে। যদিও স্বামীর প্রতি অগাধ ভালবাসা, স্নেহ, মমতা থাকার কারণে এবং সন্তানদের প্রতি গভীর মমত্ববোধ থাকার কারণে কোন কোন সময় হিন্দু নারীরা অল্প বয়সে স্বামী হারালেও বিধবা জীবন ব্যবস্থাকে গ্রহণ করে। শুধুমাত্র সন্তানদের মানুষরূপে গড়ে তোলার জন্য বিধবা স্ত্রী পুনরায় বিবাহে রাজী হয় না। এ রকম হিন্দু সমাজে এখনও বহু উদাহরণ আছে। শুধু তাই নয়। বিধবা স্ত্রী স্বামীর মৃত্যুর পর কোন রকমে জীবিকা নির্বাহ করেও ভেজিটেরিয়ান হয়ে যায়। হিন্দু সমাজ ব্যবস্থায় অধিকাংশ নর-নারী এখনও মনে করে, বিবাহ হলো স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে চুক্তি নয়, বরং সামাজিক প্রথা। সামাজিক প্রথা ভিত্তিক বিবাহ রীতি হয় নর-নারীর মধ্যে এমন এক শক্ত বন্ধন যা পরবর্তীতে যে কোন কারণে বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রবণতা একেবারেই কম। এ কারণে হিন্দু বিধি ব্যবস্থায় বিবাহ বিচ্ছেদের পরিমাণ অন্য যে কোন ধর্মাবলম্বীর তুলনায় কম।
কিন্তু সমাজ ব্যবস্থায় নারীরা কি বঞ্চিত? হাজার হাজার বছর ধরে হিন্দু সমাজ ব্যবস্থায় এ প্রশ্নটি অন্তত পূর্বে বাংলাদেশে উপস্থাপিত হয়নি। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ট ভারতে অবশ্য এরূপ প্রশ্ন প্রায় দুই দশক আগে উপস্থাপিত হয়েছে। এতে হিন্দু সমাজের চিন্তাবিদরা অনেক বিচার বিশ্লেষণ করে দেখেন যে, সমাজের অগ্রগতির সাথে সাথে হিন্দু উত্তরাধিকার আইনও পরিবর্তন করা প্রয়োজন। হিন্দু নারীরা পিতার কোন সম্পত্তির ভাগ না পেলেও স্বামী কর্তৃক প্রাপ্ত শ্বশুড়ের সম্পদ স্বামীর অবর্তমানে তিনি মালিক হন- এ যুক্তি বর্তমান হিন্দু সমাজের চিন্তাবিদরা মেনে নিতে নারাজ। তাঁরা বলেন, পরিবারে দেখা যায়, যে সদস্যের আয় অধিক এবং যে সদস্যের সম্পদের পরিমাণ বেশি তিনিই পরিবারের যে কোন সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে। হিন্দু সমাজে উত্তরাধিকার আইন অনুসারে নারীরা যেহেতু পিতার সম্পদ পায় না, সেহেতু পরিবারে তাদের সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষমতাও থাকে না। একমাত্র যে সব হিন্দু নারী চাকুরীতে নিয়োজিত শুধুমাত্র তাঁরাই পরিবারে সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু হিন্দু সমাজে এরূপ চাকুরীরত নারীর পরিমাণ তুলনামূলক কম। তাছাড়া একজন হিন্দু নারী যখন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় তখন অনেক ক্ষেত্রে স্বামীর তেমন পারিবারিক সম্পদ থাকে না। এর ফলে বিবাহিত হিন্দু নারীরা হয়ে পড়ে অসহায়। এরূপ পরিবারের দারিদ্র্য অবস্থা ক্রমাগত নীচের দিকে নেমে যায়।
তাছাড়া যে কোন কারণে স্বামীর যদি অকাল মৃত্যু হয় স্ত্রী যদি চাকুরীরত না থাকে তবে সে ক্ষেত্রে পরিবারটির অবস্থা ক্রমাগত নীচের দিকে নেমে যায়। স্ত্রী উত্তরাধিকার সূত্রে পিতার সম্পত্তি না পাওয়ার কারণে এবং স্বামীর মৃত্যুতে আয়ের পরিমাণ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে হিন্দু সমাজ ব্যবস্থায় স্ত্রী সন্তানদেরকে নিয়ে এমন বিপদে পড়ে, না পারে নিজ সন্তানদের লেখাপড়া করাতে, না পারে পর্যাপ্ত খাদ্যের সংস্থান করতে। ফলে এ পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়। এক পর্যায়ে স্বামী হারা স্ত্রী ঘরে সন্তান রেখে অন্যের বাড়ীতে ঝি-এর কাজ করতে বাধ্য হয়। ফলে ঐ পরিবারের একটি জেনারেশন দারিদ্র্যে পতিত হয়।
এ অবস্থার প্রেক্ষিতে হিন্দু সমাজ ব্যবস্থার চিন্তাবিদরা হিন্দু ধর্মীয় আইন পরিবর্তন করার পক্ষে। এ সব কারণে ভারতে হিন্দু ধর্মীয় আইনের পরিবর্তন করে পিতার সম্পত্তির ভাগ কন্যা সন্তানেরা পাওয়ার ব্যবস্থা করে। কিন্তু বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মীয় আইন পূর্বের ন্যায় রয়ে গেছে। বাংলাদেশে হিন্দু উত্তরাধিকার আইন সংস্কার করার জন্য মার্চ ’২১-এ ঢাকায় এক ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হয়। এ বৈঠকের মূল থিম ছিল “হিন্দু উত্তরাধিকার আইন: সংস্কারের প্রস্তাব।” বৈঠকে যে সব হিন্দু সমাজ ব্যবস্থার চিন্তাবিদরা অংশগ্রহণ করেন তাঁদের প্রত্যেকে একমত হন যে, বাংলাদেশে বর্তমান আইনে হিন্দু নারীরা উত্তরাধিকার সূত্রে পিতার সম্পত্তির কোন ভাগ পায় না। ডিভোর্স দেয়ার অধিকার তাদের নেই। পুনঃবিবাহের সুযোগ বা সন্তান দত্তক নেয়ার কোন সুযোগ নেই। এ অবস্থার প্রেক্ষিতে হিন্দু ধর্মীয় আইন সংস্কার করার প্রয়োজন। তবে হিন্দু নারী বা পুরুষ ধর্মান্তরিত হলে কি হবে? এতে প্রতিটি হিন্দু পরিবারে একটা উদ্বেগ রয়েছে। এ উদ্বেগ নিরসনের জন্য হিন্দু সমাজব্যবস্থার চিন্তাবিদরা একটি প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। তারা প্রস্তাব রাখেন- ধর্মান্তরিত হলে হিন্দু নারী-পুরুষ উভয়ে উত্তরাধিকার সম্পত্তির অধিকার হারাবেন। হিন্দুরা যেহেতু বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সেহেতু প্রতিটি পরিবার সন্তানদের ব্যাপারে উদ্বেগের মধ্যে থাকে। বিশেষ করে কন্যা সন্তানদের নিয়ে। এ কারণে তাঁরা প্রস্তাব করেন, যে আইনের বলে হিন্দু নারী-পুরুষদের মধ্যে সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে, সেই আইনেই ধর্মান্তরিত হলে সম্পদ হারাবে- এ বিধি রেখেই হিন্দু উত্তরাধিকার আইন পরিবর্তন করা হোক। এতে হিন্দু সম্প্রদায়ের চাপাকৃত উদ্বেগ যেমন হ্রাস পাবে তেমনি এর বিরোধিতাও কেউ করবে না- অভিমত হিন্দু সমাজ উন্নয়ন চিন্তাবিদদের।
লেখক : পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক,
বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ