শিল্প সংস্কৃতিতে মে দিবসের ডাক

মিলন কান্তি দে | বৃহস্পতিবার , ১ মে, ২০২৫ at ৫:৫৪ পূর্বাহ্ণ

শ্রমিকরাজ কায়েমের রক্তরঞ্জিত দিন আজ পয়লা মে। মহান মে দিবস। ১৩৯ বছর আগে এই দিনে আমেরিকার শিকাগো শহরে সংঘটিত রক্তক্ষয়ী শ্রমিক আন্দোলনের চেতনা বিভিন্ন দেশে যেমন, তেমনি আমাদের প্রগতিশীল শিল্প সংস্কৃতিকেও উজ্জীবিত করেছে। আজ বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে একই সুরে গাওয়া হবে মেহনতি মানুষের জাগরণীমূলক সেই ঐতিহাসিক ইন্টারন্যাশনাল গানটিঃ জাগো সর্বহারা অনশন বন্দী ক্রীতদাস/ শ্রমিক দিয়েছে আজ সাড়া উঠিয়াছে মুক্তির আশ্বাস। মে দিবসের চেতনা শুধুমাত্র শ্রমিক পরিমন্ডলেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। প্রেরণা হয়ে এসেছে বিপ্লবে, যুদ্ধে শোষিত নির্যাতিত মানুষের দাবি আদায়ের আন্দোলনে। ম্যাক্সিম গোর্কির ‘লোয়ার ডেপথ’ নাটকটি ছিল মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রামের এক হাতিয়ার। ত্রৈমাসিক থিয়েটারে প্রকাশিত এক নিবন্ধ থেকে জানা যায়, ‘নাটকটি জার্মানীর বিভিন্ন মঞ্চে প্রদর্শিত হয়ে প্রথমবার এক লক্ষ জার্মান মার্ক আয় করেছিল।অক্টোবর বিপ্লবের নায়ক লেনিন বলেছেন, গোর্কি তার মহান শিল্পকর্ম দ্বারা নিজেকে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়েছেন শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবের সঙ্গে রাশিয়ায় এবং সমগ্র বিশ্বে।

শ্রমিক কুলের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার এই সংগ্রাম জন্ম দিয়েছে এক নতুন সাংস্কৃতিক দায়বোধের। যার প্রতিফলন দেখা যায় সাহিত্যে, নাটকে, যাত্রা ও পালাগানে। মে দিবসের শিক্ষা ও চেতনা ধ্রুপদী মাত্রা দিয়েছে আমাদের গণসঙ্গীতকে। শ্রমিক দলের গান গেয়েছেন বিদ্রোহী কবি নজরুল। সর্বহারা কাব্যগ্রন্থে কুলি মজুর কবিতায় শোষণকারী সমাজের প্রতিভূদের উদ্দেশ্যে তিনি লিখেছেনঃ তোমারে সেবিতে হইল যাহারা মজুর, মুটে ও কুলি, তোমারে বহিতে যাহারা পবিত্র অঙ্গে লাগালো ধূলি/ তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদেরি গান

তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে বিভিন্ন সভা সমাবেশে মে দিবসের প্রেক্ষাপটে যে গানটি তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল তার কয়েকটি চরণ এরকম: ওঠ দুনিয়ার গরীব ভুখারে জাগিয়ে দাও/ ধনিকের দ্বারে ত্রাসের কাঁপন লাগিয়ে দাও। আল্লামা ইকবালের একটি কবিতা থেকে এটি গানের রূপ দিয়েছিলেন ফররুখ শিয়র। গেয়েছেন প্রখ্যাত নজরুল গীতি শিল্পী শেখ লুৎফর রহমান। প্রবীণ সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানীর লেখা আমাদের সংস্কৃতি ও সংগ্রামনামে একটি বই থেকে জানা যায়, ৫০ ও ৬০এর দশকে প্রগতিশীল আন্দোলনের অংশ হিসেবে গণসঙ্গীতের ধারা ক্রমশই তীব্রতর হয়ে ওঠে। মুটে, মজুর ও নির্যাতিত মানুষের প্রতিনিধিত্বমূলক এসব জাগরণী গান পরিবেশনায় অগ্রণী ভূমিকা ছিল রাজনৈতিক ফ্রন্ট, কুবলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, অগ্রণী শিল্পী সংঘ, ছায়ানট, ক্রান্তি, সৃজনী, উদীচী, উন্মেষ প্রভৃতি সাংস্কৃতিক সংগঠনের। সেই সময় গণসঙ্গীত পরিবেশন করে সর্বাধিক জনপ্রিয়তা লাভ করেন ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সলিল চৌধুরী। মে দিবসের চেতনা সঞ্চারকারী সেই সময়ের আর একটি লোকপ্রিয় গানও দুনিয়ার মজদুর ভাইসব, আয় এক মিছিলে দাঁড়া, নয়া জমানার ডাক এসেছে, আয় এক সাথে দে সাড়া।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বাম রাজনীতি ঘেঁষা নাট্যকর্মীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সর্বভারতীয় যে গণনাট্য আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটেছিল, তার প্রেরণা হিসেবে অনেকাংশে আমরা মে দিবসের চেতনা খুঁজে পাই। আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছিল বিজন ভট্টাচার্যের নবান্নও তুলসী লাহিড়ীর ছেঁড়াতার‘- নাট্য মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে। ভুখানাঙ্গা মানুষের নিত্যদিনের বেঁচে থাকার লড়াই নাটক দুটির মূল উপজীব্য। যার বর্ণনায় সংলাপে রয়েছে মে দিবসের আবহ। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে এক নতুন নাট্যবলয় নির্মাণে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ ফেরত তারুণ্যের দুর্বার অভিযাত্রা। সমকালীন জীবন, সংস্কৃতি, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী দৈন্য, হতাশা, মূল্যবোধের অবক্ষয় ইত্যাদি বিষয়বস্তু নতুন প্রাণাবেগে স্পন্দিত হয়ে ওঠে নাট্যচর্চার। মে দিবসকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে আর একটি নাট্যধারা, যার পথিকৃৎ নাট্যজন মামুনুর রশীদ। তিনি রচনা করেন মে দিবসের পথনাটক কদমআলীর মে দিবস। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান এবং আরণ্যক নাট্যদলের উদ্যোগে পৃথক পৃথকভাবে উদযাপিত হয়ে আসছে মহান মে দিবস।

মে দিবসের আলোকে শ্রমজীবী মানুষের কথা উঠে এসেছে কয়েকটি যাত্রাপালার সংলাপে। এগুলো হচ্ছেঃ কালাপাহাড়, একটি পয়সা, পাঁচ পয়সার পৃথিবী, সূর্যসাক্ষী এবং মে দিবসকে উপজীব্য করে সরাসরি একটি যাত্রাপালা ওরা মরে না‘ (বর্তমান নিবন্ধকারের লেখা) প্রথম মঞ্চস্থ হয় ২০০০ সালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে।

যাদের হাড়ভাঙ্গা খাটুনিতে গড়ে ওঠে নগরসভ্যতা, সেই সব শ্রমজীবী মেহনতি মানুষ নির্যাতিত হচ্ছে আজও। কখনও সরকারী যাঁতাকলে, কখনওবা ওপর তলার মুখোশধারী মানুষদের অমানুষিকনির্যাতনে। মে দিবসের আদর্শ ও শিক্ষা থেকে আমরা যেন ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছি। কলকারখানায় শ্রমিকের আর্তনাদ শোনা যায় এখনও। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে গার্মেন্টসের মহিলা শ্রমিকরা। অপরিকল্পিত ভবন ধসে সংখ্যাতীত মৃত্যু প্রতিনিয়ত আমাদের ঠেলে দিচ্ছে অনিশ্চিত অন্ধকারে। এই জীবনযন্ত্রণা থেকে শ্রমিককুলকে বাঁচাতে এগিয়ে আসুক সংস্কৃতিকর্মীরা। অতীতের মত কবিতায়, গানে, নাটকে, যাত্রাপালায় ধ্বনিতপ্রতিধ্বনিত হোক মে দিবসের সেই বিশ্বজনীন উচ্চারণ: দুনিয়ার মজদুর এক হও।

লেখক : বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত ফেলো, যাত্রাশিল্পী

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রিয় দুঃখ
পরবর্তী নিবন্ধবাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষের বিদ্যমান অবস্থায় মে দিবসের প্রাসঙ্গিকতা