সমাজে, সংসারে, ঘরে, বাইরে সর্বত্র আমরা প্রতিনিয়ত শিক্ষা গ্রহণ করি এবং শিক্ষা দিয়ে যায়। যিনি শিক্ষা গ্রহণ করেন তিনি শিক্ষার্থী আর যিনি শিক্ষা দেন তিনি শিক্ষক। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত একে অপরকে শিক্ষা দেন এবং অপরের কাছ থেকে অনেক শিক্ষা নিয়েও থাকেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বলেছেন শিউলি ফুলের মতো শান্ত, কোমল, স্নিগ্ধ। সত্যিই প্রাথমিক পর্যায়ে শিশু কিশোর শিক্ষার্থীরা ফুলের সাথে তুলনীয়।
বিদ্যালয়ে যারা পড়ান তাদের আলাদা করে শিক্ষকের মর্যাদা দেওয়া হয়ে থাকে। গুরুগৃহে শিষ্য এবং শিষ্যের গৃহে গুরুর আগমন শিক্ষাদানের জন্য বহুকাল ধরেই জেনে আসছি। উনার শিক্ষকের আসনে অধিষ্ঠিত। বর্তমানে বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে পড়ানো হয় সত্যি, শ্রেণিকক্ষের শিক্ষাকে যথেষ্ট নয় মনে করে ‘কোচিং’ এর ব্যবস্থা অধিক প্রচলিত হয়েছে। এতে শিক্ষকের আয় উপার্জনের ব্যবস্থাও আশাতীত রকম বেড়ে গেছে।
শিক্ষক, শিক্ষার্থী উভয় পক্ষ কোচিং প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করতে তৎপর বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায়। পরীক্ষায় জিপিএ পাওয়া ছাড়াও নৈতিকতা, মানবিকতা, বিনম্রতা আরও অনেক রকম শিক্ষার কথা আমাদের ছেলে মেয়েরা ভুলতে বসেছে, যা শেখা খুব প্রয়োজন। শিশুদের ক্ষেত্রে এসব শিক্ষার জন্য ঘরে যেমন ভূমিকা আছে তেমনই বাইরে বিদ্যালয়ে শিক্ষকদেরও যথেষ্ট ভূমিকা আছে। ঘরে বড়দের কাছে, মা-বাবার কাছে শিশুরা অহরহ শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে, বড়দের চালচলন, কার্যকলাপ, বসনভূষণ, আলাপ আলোচনা, ত্যাগ তিতিক্ষা, সহমর্মিতা, কোনো কিছুই শিশুদের দৃষ্টির অগোচরে থাকে না।
নিজগৃহ থেকে শিশুর চরিত্র গঠনের জন্য বড় ধরনের শিক্ষা লাভ করে থাকে। শিশুরা ক্রমে বড় হতে হতে শৈশবের সেই সব অভিজ্ঞতাগুলি থেকে অভ্যস্ত সংস্কারে পরিণতি লাভ করে। এইধারাতেই প্রায় প্রতিটি মানুষ জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত চারিত্রিক গুণাবলির অধিকারী হয়। বড়দের ধ্যানধারণা, আচার-আচরণ, ন্যায়নিষ্ঠা, সততা, সবকিছুই শৈশবে, কৈশোরে মানসপটে প্রভাব বিস্তার করে। তারা সবসময় অনুকরণ প্রিয়। এই কারণে আপন গৃহ শিশুদের প্রথম এবং শ্রেষ্ঠ শিক্ষালয়। আপনগৃহের সদগুণাবলী দ্বারা শিশুর চরিত্র গঠিত হলে ভবিষ্যতে সে আলোকিত মানুষ হবে, দেশ ও দশের জন্য গৌরব অর্জন করবে।
ইদানীংকালে, অধিকাংশ ছেলে মেয়েদের আত্মসংযম, সহানুভূতি, সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা, কর্তব্যনিষ্টা, সত্যবাদিতা ইত্যাদি বহুবিধ গুণ গুলির অভাব ভীষণ ভাবে লক্ষণীয়। যা আগামীতে সমাজ সংসারে অশুভ প্রভাব ফেলতে পারে। আমদের পরিবার যেমন এক্ষেত্রে দায়বদ্ধতা এড়াতে পারে না, তেমনি বিদ্যালয়ের শিক্ষকও এক্ষত্রে দায়বদ্ধতা অস্বীকার করতে পারেন না। আমরা যারা শিক্ষক, ছাত্রছাত্রীকে সন্তানতুল্য মনে করা উচিৎ। ছাত্রছাত্রীকে সুন্দর আদর্শের শিক্ষা দেওয়া আমাদের গুরুদায়িত্ব। কখনো কখনো দেখা যায় শিষ্টাচার, সদাচার, সহমর্মিতা, মানবিকতা, সততা বিষয়গুলি নীতিকথা রূপে আলোচিত হয়, কিন্তু কার্যত তা প্রতিভাত হয় না।
যেনতেন ভাবে শুধু পাঠ্যসূচী সম্পন্ন করলেই ছাত্র ছাত্রীদের সুস্থ মনন তৈরি হয়ে যাবে না। স্বধর্ম পালন করা, পরধর্মে সহিষ্ণুতা, শ্রদ্ধাবোধ, গুরুজনদের মান্য করা, পরিশ্রমী হওয়া, আপন সংস্কৃতি চর্চা করা, স্বাবলম্বী হওয়া ইত্যাদি বিষয়গুলির উপর যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়ার অবকাশ আছে। উল্লিখিত বিষয়গুলি অভ্যস্ত সংস্কারে পরিণত হলে আমাদের ছেলে মেয়েরা সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠবে। নৈতিক শিক্ষার অভিজ্ঞতা শিক্ষকের কাছ থেকেই শিক্ষার্থীরা সঞ্চয় করে। বর্তমান সময়ে নৈতিক অবক্ষয় সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে। আদর্শ শিক্ষক আমাদের দেশে এখনো অনেকই আছেন।
উনারাই সজাগ থাকবেন এবং আমাদের ছেলেমেয়েদের আগামীদিনের ভয়াবহতা থেকে উদ্ধার করতে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারবেন বলে দৃঢ় বিশ্বাস করি। পরিবার থেকেও ছেলেমেয়েদের অধিক বিলাসী জীবন যাপনের ব্যবস্থা একটু সীমিত করা যায়, নৈতিক শিক্ষা, সদাচরণ, মান্যতা, সততা, সৌহার্দ্য সমপ্রীতির মহৎবাণীর চর্চা করলে আদর্শ মানুষ হয়ে মা-বাবার প্রতিও শ্রদ্ধা, দায়বদ্ধতা গড়ে উঠবে সর্বক্ষত্রেই তার প্রভাব পড়বে। অল্পবয়সে হেলাফেলা করলে সন্তান হাতের বাইরে চলে যায়। অল্প বয়সে শিক্ষার অভাবে অথবা ভুল শিক্ষায় ছেলে মেয়ে অনৈতিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ে, অনেক সময় ছেলেমেয়ে ভাল-মন্দ ঘটনার সত্য গোপন করে বেখেয়ালি মা বাবার কাছে। অতএব ঘরে হোক আর বিদ্যালয়ে হোক শিক্ষা শৈশবে এবং কৈশোরে দেওয়াটাই বাঞ্চনীয় যা মানসপটে অবশ্যই গভীর প্রভাব ফেলবে।