পরিবারতন্ত্রের ভুল ও দ্বীপ কন্যা শ্রীলংকার সর্বনাশ

অনুপ দাশ গুপ্ত | বুধবার , ২৭ এপ্রিল, ২০২২ at ১০:৩১ পূর্বাহ্ণ

আমরা তো বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশের অনেক রকম সংকট দেখেছি ও সংকটের কথা শুনেছি, কিন্তু কাগজের অভাবে কোনও দেশ, তাদের সারা দেশের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা বন্ধের মতো ঘটনার কথা আগে কখনো শুনিনি। অর্থ সংকটের কারণে শ্রীলংকাতে এরকম ঘটনাটি ঘটেছে গত কিছু দিন আগে। শুধু তাই নয় দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এক বিলিয়ন ডলারের নীচে নেমে আসাতে বহু বিশ্লেষক বলছেন, শ্রীলংকা ঋণ খেলাপি হলো বলে।

বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে জ্বালানি তেল কিনতে না পেরে দেশটির বিদ্যুৎ বিভাগ মার্চের শুরু থেকে অন্তত সাড়ে সাত ঘন্টা দেশব্যাপি লোডশেডিং করার ঘোষণা দিয়েছেন। তেলের পাম্প গুলোতে জ্বালানির জন্য সাধারণ মানুষের লম্বা লাইন দেখা যাচ্ছে। কাগজ আমদানী করতে না পারায় স্কুলের পাবলিক পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে। এমনকি কাগজের অভাবে ইতোমধ্যে কয়েকটি সংবাদপত্র তাদের প্রিন্টিং সংস্করণ বন্ধ করে দিয়েছে। এ পরিস্থিতির মূলে আছে অকল্পনীয় ব্যালেন্স অব পেমেন্ট সংকট, যা শ্রীলংকা ২০২০ সালের শুরুর থেকে মোকাবিলা করে আসছে।

শ্রীলংকার অর্থনৈতিক নৈরাজ্যের উৎসে রয়েছে পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতি। ফলে প্রশাসনিক জবাবদিহিহীনতা ও আর্থিক অনিয়ম চলে আসছে অনেক আগে থেকেই, লম্বা সময় এভাবে চলার প্রভাব পড়েছে এখনকার অর্থনীতিতে। মূলত শাসক পরিরবারের মনের খেয়ালে নেওয়া অনেক সিদ্ধান্তের দায় শোধ করতে হচ্ছে শ্রীলংকাবাসীকে। করোনায় শ্রীলংকার আশপাশের সব দেশকেই অর্থনৈতিক টানাপোডেনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, কিন্তু কেউ তাদের মতো বেসামাল হয়নি। অনেকেই বলছেন, শ্রীলংকার এ সংকটের মূলে আছে চীনা ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে পড়া, তারা ঠিক বলছেন না। সমস্যার কারণ আরও গভীরে। শ্রীলংকার সরকারি ঋণের মাত্র ১৪ ভাগ হলো চীনের কাছ থেকে নেওয়া আর ৩৬ ভাগ নেওয়া হয়েছে বিশ্ববাজারে সার্বভৌম বন্ড ছেড়ে।

আগেই ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে শ্রীলংকার বর্তমান সমস্যা হলো দশকের পর দশক ধরে আর্থিক খাতে সংস্কারের ব্যাপারে সরকারগুলোর উদাসীনতার পুঞ্জিভূত রূপ, করোনার কারণে যা আরও জটিল রূপ নিয়েছে। তাছাড়াও বিশাল ঋণ নিয়ে হাম্বানটোটা সমুদ্র বন্দর ও বিমানবন্দর বানানো এবং পরে পরিচালনা না করতে পারার ব্যর্থতা। বর্তমান সংকট থেকে উদ্ধার পেতে সরকার চাচ্ছে চীনের সঙ্গে তার ঋণ চুক্তিগুলো পুনবিন্যাস করতে যেন তা পরিশোধের আরও সময় পাওয়া যায়। তবে এ সুবিধা পেলেও যে শ্রীলংকা সরকার চলমান সংকট থেকে মুক্তি পাবে, তা বলা যায় না। যেহেতু আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ না নেওয়ার বিষয়ে বর্তমান গোতাবায়া রাজাপাকসে কঠিন পণ করে আছেন, তাঁকে এখন চীন ও ভারতের কাছে হাত পাততে হচ্ছে। শ্রীলংকা বর্তমান এক কঠিন অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে। এমন পরিস্থিতি ১৯৪৮ সালে স্বাধীন হওয়ার পর দেশটি কখনোই দেখেনি।

দেশটির শাসন ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বসা ২০ জনের বেশি এক পরিবারের সদস্য। মন্ত্রীসভায় আছেন’ রাজাপাকসে’ পরিবারের পাঁচজন -প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, সেচমন্ত্রী ও যুবমন্ত্রী। প্রথম চারজন ভাই। তাদের মধ্যে সেজ ভাই, দেশটির প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের সাংবিধানিক ক্ষমতা রাজতন্ত্রের রাজার মতো। এই পরিবারের ৯ সদস্য আছেন ২২৫ আসনের পার্লামেন্টে। গণতান্ত্রিক যুগে এমন একপেশে পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির উদাহরণ খুব একটা দেখা যায় না।

অতীতে শ্রীলংকা রাজত্ব করেছেন ‘সেনানায়ক’, বন্দরানায়েক’রা। এখন চলছে রাজাপাকসেদের যুগ। সেই রাজাপাকসে পরিবারের ২০-২৫ জন সদস্যের হাতে শ্রীলংকার রাষ্ট্রীয় বাজেটের ৭৫ ভাগ খরচ হয়েছে গত কয়েক বছর। সুতরাং বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের দায় এ বংশের ওপর বর্তায় অনেকখানি। তারা আয় ব্যয়ের প্রয়োজনীয় হিসেব ছাড়াই বিশাল বিশাল বন্দর, রাস্তা, ভবন বানিয়ে জনগণকে মোহাচ্ছন্ন রাখার কৌশল গ্রহণ করেছিল। বিবেচনাহীন এমন উন্নয়ন নীতির শিকার শ্রীলংকা। যে নীতি অনুসরণ করছে দক্ষিণ এশিয়ার আরো দেশ। যা সত্যি পুনর্বার ভাবা দরকার। যাক সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ।

রাজাপাকসেদের উত্থান শ্রীলংকার দক্ষিণে ধান আবাদের জনপদ হাম্বানটোটা থেকে। অনেক জমিজমা ও নারকেল বাগান ছিল এ বংশের। তবে প্রতিপত্তি হয়েছে রাজনীতির হাত ধরে। গত দুই জাতীয় নির্বাচনে দেশটির নাগরিকরা রাজাপাকসেদের হাতে উদার হৃদয়ে নিজেদের ভবিষ্যৎ সঁপে দিয়েছেন। তামিল ও মুসলমানদের ‘নিয়ন্ত্রণে’ রেখে বৌদ্ধ-সিংহলিদের রাজাপাকসেরা উন্নতির চরম শিখরে নিয়ে যাবেন, এমন আসা জাগানো হয়েছিল। কিন্তু এখন সংসার চালানোর ঝুঁকি ও ভবিষ্যতে কী ঘটে তা নিয়ে অনিশ্চতায় পড়েছে পুরো দেশের সাধারণ মানুষ। জ্বালানি, ওষুধ, গুড়ো দুধ, সার-সবকিছু দুষ্প্রাপ্য হয়ে ওঠেছে।

বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় কোনো পণ্য পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। অথচ এ দেশকে ব্রিটিশরা বলত-‘জুয়েল অব দ্য ক্রাউন’। তাদের রাজত্বে এত সমৃদ্ধ ছিল দ্বীপটি ! পুরোনো লংকার সেই ‘ শ্রী’ এখন আর নেই! ইদানীং এও সংবাদ আসে শ্রীলংকা থেকে, ’তেল কেনার লাইনে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে দুজনের মৃত্যু,’ ‘কাগজের অভাবে সকল পরীক্ষা বন্ধ করে দিতে হলো’, গত ৭৫ বছরে এত দুর্দশা দেখেনি লংকাবাসী, ’পেট্রোল পাম্পে সৈন্য মোতায়ন ইত্যাদি। তাহলে এখন প্রশ্ন কীভাবে তারা এ দুর্দশার মধ্যে পড়ল? কেন দুই দশক আগে সমৃদ্ধ থাকা দেশটি দেউলিয়া হওয়ার পথে? এর মধ্যে সবচেয়ে জরুরি প্রশ্ন হলো শ্রীলংকার এই দুর্দশার চিত্র থেকে পার্শ্ববর্তী সার্কভূক্ত দেশে গুলোর কিছু শিক্ষা নেওয়ার আছে কিনা? বা সতর্ক হওয়ার কিছু আছে কিনা? গত ১৫ বছরে শ্রীলংকা বেশ কিছু মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর, রাস্তা এবং আরও নানা ধরণের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এর কাজ শেষ হতে সময় লাগবে ২৫ বছর এবং বাজেট ধরা হয়েছে প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার। বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন উৎস থেকে শ্রীলংকা ঋণ নিয়েছে।

বিপুল অর্থ খরচ করা হলেও অনেক প্রকল্প শ্রীলংকার জন্য এখন গলার কাঁটা’য় পরিণত হয়েছে। এর অন্যতম হলো-হাম্বানটোটা সমুদ্রবন্দর ও বিমানবন্দর। অন্যদিকে গত ১৫ বছর ধরে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে দেদার ঋণ নিয়েছে শ্রীলংকার বিভিন্ন সরকার। কিন্তু এই অর্থ কীভাবে পরিশোধ করবে সে ব্যাপারে খুব একটা চিন্তা-ভাবনা করেনি। এখন সব চেপেছে একসঙ্গে। ২০১৯ সালের নভেম্বরে ক্ষমতাসীন হয়ে গোতাবায়া সরকার ট্যাঙ কমানোর সিদ্ধান্ত নেন, ও জাতিয়তাবাদীদের খুশি করার জন্য। এ ধরণের পদক্ষেপে অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করছিলেন সেসময়ে। এমনকি ভ্যাট প্রদানের হারও ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে আট শতাংশে আনা হয়। ট্যাঙ-ভ্যাট কমানোর মূল কারণ ছিল অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করা। ২০০৯ সালে শ্রীলংকায় গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসে (বর্তমান প্রেসিডেন্টের ভাই) একই ধরণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এর ফলে যুদ্ধ বিধ্বস্ত অর্থনীতিতে গতি এসেছিল। সে আলোকেই বর্তমান প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসেও একই পদক্ষেপ নেন। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যে বিশ্ব জুডে করোনা মহামারির কারণে ও অন্যদিকে আয়কর ও ভ্যাট কমানোর ফলে সরকারের রাজস্ব আয় ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। আবার করোনার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অন্যদিকে ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতাও মেনে চলতে হয়। সবমিলিয়ে এসব ভুল সিদ্ধান্তের কারণে প্রচণ্ড চাপ তৈরি হয় অর্থনীতির উপর। শুধু এসব উন্নয়নের ভুল সিদ্ধান্ত নয়। এমনকি গোতাবায়া সরকারের নেওয়া অর্গানিক চাষের সিদ্ধান্তটিও ছিল ভুল।

২০১৯ সালে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া দেশে অর্গানিক কৃষি চালু করেন। সেজন্য কৃষি ক্ষেত্রে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। এর অংশ হিসেবে শ্রীলংকায় সার আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়, এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে কৃষিক্ষেত্রে। এতে চালের উৎপাদন ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। একসময় চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পপূর্ণ শ্রীলংকা বাধ্য হয় ৪৫০ মিলিয়ন ডলারের চাল আমদানি করতে। চালের দাম হু হু করে বাড়তে থাকে। অর্গানিক কৃষির নেতিবাচক প্রভাব পড়ে দেশটির চা উৎপাদনের ক্ষেত্রেও। আমরা জানি চা রপ্তানি করে শ্রীলংকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। তাতেও ধাক্কা লাগে। কৃষকদের ক্ষতি পুষিয়ে দেবার জন্য সরকার ২০০ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দেয়। দেশজুড়ে একই সঙ্গে খাদ্য ঘাটতিও প্রকট আকার ধারণ করে। মূলত অর্গানিক কৃষি চালু করার আগে বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা করা হয়নি। এতে উল্টো ফল হয়, উৎপাদন কমে যাওয়ায় গ্রামের কৃষকরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ফলে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যায় এবং খাদ্য আমদানীর জন্য আরও বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে হয়। একদিকে করোনার কারণে পর্যটন শিল্পের অবনমন, চা রপ্তানি কমে যাওয়া, অর্গানিক কৃষিতে ভুল সিদ্ধান্তের কারণে, চীন ও ভারতের ঋণের ফাঁদে পড়ে যাওয়াসহ গোতাবায়া সরকারের অসংখ্য ভুলের মাশুল গুনছে আজ শ্রীলংকার সাধারণ জনগণ।

শ্রীলংকার এই সংকটে সাধারণ জনগণের কী হবে? তা এখনো কেউ জানে না। যদিও ধীরে ধীরে জন ক্ষোভ বাড়ছে। হয়তো আর কিছুদিন গডিয়ে গেলে গোতাবায়া রাজাপাকসের ভুলনীতির বিরুদ্ধে সুপ্ত জনরোষ জন বিক্ষোভেও পরিণত হতে পারে। এও তো সর্বজনবিদিত যে রাজাপাকসে সরকার এলটিটিই দমনে কী নিমর্ম হয়েছিল।

লেখক : প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধশৈশবের শিক্ষা
পরবর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে