চাটগাঁর কইলজা আঁরার আজাদী

ফারহানা ইসলাম রুহী | বুধবার , ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৫:৪৭ পূর্বাহ্ণ

শৈশব বেলায় প্রিয় দৈনিক আজাদী ছিল স্বদেশ ও বিশ্বকে জানার জন্য একটা খোলা জানালা। ঢাকার পত্রিকা আসতে প্রায় বিকেল, তাই শুভ সকাল জানাতে দুয়ারের কড়া নেড়ে পাঠক সমাজের তাৎক্ষণিক চাহিদা পূরণ করেছে ঐতিহাসিক দৈনিকটি। বয়সের ভারে নুয়ে না পড়ে চির যৌবনা, বরাবরই আধুনিক। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলছে, গতিময় ছন্দে। অকৃত্রিম ভালোবাসার বন্ধনে অগণিত পাঠক, লেখক প্রচুর খ্যাতিমান কবি ও সাহিত্যিক সৃষ্টিকারী ঈর্ষণীয় এক অবিস্মরণীয় কালজয়ী পত্রিকা চাটগাঁর গর্ব ‘আঁরার আজাদী’ ।

অর্ধশতাব্দীর চেয়েও বেশি সময় ধরে গৌরব ধরে রাখা নিঃসন্দেহে চ্যালেঞ্জিং। দৈনিক আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা প্রকৌশলী আবদুল খালেক চট্টগ্রামের মুদ্রণশিল্পের পথিকৃৎ। তাঁর প্রতিষ্ঠিত কোহিনূর ইলেকট্রিক হতে ১৯৬০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর আত্মপ্রকাশ করে  ৈদৈনিক আজাদী। প্রথমদিকে পত্রিকাটির মূল্য ছিল মাত্র দুআনা ১২ পয়সা। এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বর্তমান প্রজন্ম জানে না।

দেশের গৌরবগাথা অধ্যায়ের সাথে আজাদীর সম্পর্ক নিগূঢ়। দেশের গৌরবময় ইতিহাস ঐতিহ্যের সাক্ষী এই সংবাদপত্রটি ভয়ভীতি ও হুমকিকে পিছু ফেলে প্রচারক প্রকাশক হিসেবে সব রকমের ঝুঁকিকে সাহসিকতার সাথে নিয়েছে। ভাষা আন্দোলন কালে লিফলেট তৈরি ও কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরীর লেখা ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি ‘কবিতাটি কোহিনূর প্রেসে ছাপে। লালদিঘির মাঠে প্রচার করে। কোহিনূর প্রেসের সে সময়কার ম্যানেজার দাবির উদ্দিনকে গ্রেফতার করে এবং তাঁকে ছয় মাসের কারা ভোগ করতে হয়। এক কথায় আজাদী হয়ে ওঠে জনগণের বন্ধু। তৎকালীন সরকার স্বাধীনতা বিরোধীদের চক্ষুশূল হয়ে পড়ে। একসময় কোহিনুর ইলেকট্রিক প্রেসে তালা মেরে দেয় পুলিশ। আজাদী স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দৈনিক সংবাদপত্র। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের সংবাদটি পরদিন ১৭ ডিসেম্বর প্রকাশিত হয়। সত্য প্রকাশে নির্ভীক পত্রিকা আজাদীতে।

আঞ্চলিক ভাষাকে বিশেষ প্রাধান্য দিয়ে সংবাদপত্রে হেডলাইন জনগণের মন কেড়েছে। বীরচট্টলার গণ মানুষের ভাবাবেগের অনন্য বহিঃপ্রকাশ রূপে। চাটগাঁর সন্তান ড. ইউনূস যেদিন নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। পরেরদিন আজাদীর প্রধান শিরোনাম হয় ‘আঁরার ইউনূস নোবেল পাইয়ে’। এই চমৎকার শিরোনামটি দিয়েছেন আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক। ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর চট্টগ্রামে আঘাত হানার আগের দিন আজাদীর সংবাদ শিরোনামটি ছিল ‘রোয়ানু আইয়ের’। এর ফলে অঞ্চলের মানুষের আন্তরিক ভালোবাসাও হৃদ্যতা সৃষ্টি হয়েছে অনায়াসে। স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ জীবনঘনিষ্ঠ, সত্যনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশের এক চমকপ্রদ রুচিশীল সুনামধন্য দৈনিক।

টিভির পর এই দৈনিক আমার কাছে বিশ্ব আয়না। পরানের আজাদীতে লেখা ছাপলেই সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হই। স্কুল কলেজের ম্যাগাজিনে লেখা মাধ্যমে এই জগতে প্রবেশ হলেও আমাকে লেখক হিসাবে আত্মপ্রকাশ ঘটিয়েছে এই শৈল্পিক কারখানা। যেই পত্রিকার সাথে হৃদয়ের সখ্যতা আমার দুরন্ত শৈশব কৈশোরে। মিশে আছে গভীর ভালোলাগা। ইরাক যুদ্ধের সংবাদ, ৯০ স্বৈরাচার এরশাদ পতন ’৯১ সনের গণতান্ত্রিক সরকার গঠন খবর গুলো পড়ে টান টান উত্তেজনা কাজ করত। পরের দিনের খবরের অপেক্ষায় করতাম।

ছোটবেলায় পারিবারিক আড্ডায় জমাতে হাস্যরস আনন্দ দানে রসে টুইটুম্বুর ছিল বিশ্বকাপ কুইজ। গুণী সাহিত্যিকদের কলামগুলো ছিল বেশ উপভোগ্য। নারীদের সাহিত্য চর্চায় সবচেয়ে বেশি সুযোগ সৃষ্টি করেছে প্রাণ প্রিয় আজাদী। গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক খবর পরিবেশন সচেতনতা সৃষ্টি সহ সমাজের জনসাধারণের দুর্ভোগ, দুঃখ, কষ্ট বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খোঁজ খবর ও সংবাদ প্রকাশ করে অঞ্চলের সমস্যা সমাধানে বিরাট ভূমিকা পালন করেছে। এছাড়াও পরিবারের অনেক মূল্যবান প্রাপ্তিকে জায়গা দিয়েছে এই সংবাদপত্রটি। একুশে পদক, স্বাধীনতা পদক ও বাংলা একাডেমি পদকের মত রাষ্ট্রীয় সম্মান রয়েছে আজাদীর ঝুলিতে। নানা বৈপ্লবিক পরিবর্তন, বৈচিত্র্য এসেছে প্রকাশনা শিল্পে। বৈশ্বিক সেই বাস্তবতার নিরিখে নিজস্ব ধারা অব্যাহত রেখেছে। দীর্ঘ পথচলায় পেয়েছে জনগণের অকুণ্ঠ ভালোবাসা, প্রাচীন ও প্রিয় দৈনিকের তালিকায় আজাদীর সাথে চাটগাঁরবাসীর আবেগের সম্পর্ক। ৬৩ বছরে উত্তীর্ণ যুগান্তকারী এই সংবাদপত্র প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চায় শিল্প সাহিত্যে প্রসারে, সামাজিক উন্নয়নে সংস্কৃতিচর্চায় গ্রাহক ও পাঠক ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের মাঝে আজাদী বেচেঁ থাকবে প্রাণের বন্ধু হয়ে কাল হতে মহাকাল। আজাদীর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এক বুক গর্ব নিয়ে আজাদী পরিবার ও পরিবারে সাথে যুক্ত সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন ও ফুলেল শুভেচ্ছা জানাই।

লেখক: প্রাবন্ধিক, শিক্ষক সংগঠক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশুভ জন্মদিন দৈনিক আজাদী
পরবর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে