(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
তারকা হোটেল শেরাটনের আলীশান বিছানায় ঘুমানোর মজাটা আসলেই অন্যরকম। তাই রাতটা ঠিক কিভাবে গিয়েছে তা টের পাইনি। সকালে যখন ঘুম ভাঙ্গলো তখন মন মেজাজ সবই ফুরফুর করছিল। আজ সকালে কোন তাড়া নেই, রয়ে সয়ে উঠলে হবে বলে রাতেই জানিয়ে দেয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল যে, দশটা করে একটি সাইট সিয়িং করতে যাবে। সকাল দশটা মানে অনেক সময়। তাই ফাইভস্টার হোটেলের ব্যুফে ব্রেকফাস্টে যে দুই দফা কফি হবে তা মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম।
লায়ন ফজলে করিম ভাইকে ফোন দিয়ে ব্রেকফাস্টে যাওয়ার কথা বললাম। একই সাথে তাকে মর্নিং ওয়াকের নামে আমার ঘুমের বারোটা না বাজানোর জন্য ধন্যবাদ দিলাম। তিনি আমাকে রেস্টুরেন্টে যেতে বললেন।
নাস্তা পর্বের বর্ণনা কীই আর দেবো। বিশাল রেস্টুরেন্টে থরে থরে সাজানো সবই খাবার। যা ইচ্ছে নিয়ে খাওয়া যাচ্ছে, কিছু কিছু খাবার তাৎক্ষণিক বানিয়েও দিচ্ছে। লাল আলু এবং ভুট্টা এখানেও রয়েছে। বাদাম শসা কিচমিচ থেকে শুরু করে হরেক রকমের ফলের বাহার। তবে ফলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি টানছিল টসটসে লিচু। একেকটি আস্ত একটি রসগোল্লার সাইজ। একেবারে সরু চামড়াটি খসিয়ে মুখে দিলে মুখভর্তি হয়ে যাচ্ছিল রসে। বিচি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। কোন কোনটিতে বিচি নেই বলেও মনে হচ্ছিল। এমন মজাদার লিচু থাকতে অন্য ফলের দিকে চোখ সহজে যাচ্ছিল না। কিন্তু তাইজুর পৃথিবীখ্যাত কমলাকে অবহেলা করা ঠিক হবে না। তাই মিষ্টি রসে ভরা কমলাও চেখে দেখতে হলো। এ ক’দিনে যে পরিমাণ লিচু খেয়েছি তা অতীতে কোনদিন খেয়েছি কিনা মনে করতে পারলাম না। অবশ্য, এতো স্বাদের লিচুও এর আগে কখনো দেখিনি।
নাস্তা পর্ব শেষে দ্বিতীয় মগ কফিতে আমি যখন ঝড় তুলছিলাম তখনি ছুটে এলো শাসা। তাগাদা দিলো বাসে চড়ার জন্য। আমরা একে একে সবাই গিয়ে বাসে বসলাম। আমাদেরকে কী একটা যেনো দেখাতে নিয়ে যাবে। শাসা বললো, গ্রেটওয়াল। দারুণ জায়গা। আমি দ্বিতীয়বার জানতে চাইলাম। উত্তর আসলো–গ্রেটওয়াল। আমি মনে মনে বিব্রত হলাম। শাসা কিংবা ফ্রাঞ্চির ইংরেজী কি বুঝতে পারছি না? গ্রেটওয়াল এখানে কোত্থেকে আসবে। গ্রেটওয়ালতো বেইজিং থেকে যেতে হয়। এখান থেকে অন্তত দেড় হাজার মাইল দূরে! আমার সৌভাগ্য যে পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটি ওই গ্রেটওয়ালটি হেঁটে হেঁটে দেখার সুযোগ আমার হয়েছিল। তাহলে এখানে গ্রেটওয়াল আসবে কোত্থেকে! অবশ্য নিজে নিজে বললাম যে, চীনাদের কোন বিশ্বাস নেই। তারা হয়তো ওই গ্রেটওয়াল এখান পর্যন্ত তুলে নিয়ে এসেছে। নাকি ৮ হাজার ৮শ’ ৫১ দশমিক ৮ কিলোমিটার লম্বা গ্রেটওয়াল বেইজিংয়ের পাশ থেকে এই এতদূর পর্যন্ত নির্মিত হয়েছিল কে জানে। খ্রীষ্টের পূর্বের ৫শ’ বছর আগ থেকে ১৬শ’ শতাব্দি পর্যন্ত প্রায় ২ হাজার ১ শ’ বছর ধরে নির্মিত গ্রেটওয়াল কোত্থেকে যে কোথায় গিয়ে ঠেকেছে তার সঠিক তথ্য আমার জানা নেই। তবে পৃথিবীর মানবসৃষ্ট সেরা কীর্তিগুলোর একটি ওই গ্রেটওয়াল এতোদূর এসেছে বলে আমার মনে হচ্ছিল না।
যাক, আমাদের বাস চলছিল। গ্রেটওয়াল নিয়ে মাথায় ভাবনা থাকলেও আশপাশ দেখতে দেখতে এগুচ্ছিলাম আমরা। রথ দেখা এবং কলাবেচার এই যাত্রায় যা দেখি তাই ভালো লাগে। সুতরাং গ্রেটওয়াল হোক বা ক্যাপিটল হিল হোক তাতে আমার খুব বেশি কিছু আসে যায় না। পথে যখন নেমে পড়েছি, এখন যতটুকুই দেখা যায় তার সবটুকুই লাভ।
তুলনামূলকভাবে ছোট একটি মাঠে গিয়ে আমাদেরকে বাস থেকে নামানো হলো। বললো, সামান্য হেঁটেই গ্রেটওয়ালের গোড়ায় পৌঁছাতে হবে। তারপর সিঁড়ি ভেঙ্গে ওয়ালে চড়তে হবে। সামাণ্য হাঁটার পরই পাহাড়ের মতো একটি অবকাঠামো দেখলাম। ভিতরটা নেচে উঠলো। আসলেই তো, গ্রেটওয়ালেরই তো আদল। খুবই সুন্দর। যেনো সেই গ্রেটওয়ালের কিছুটা ছোট সংস্করণ।
আমরা গ্রেটওয়ালের পাদদেশে গিয়ে পৌঁছালাম। এবার প্রায় দুইশ’ ফুটেরও উঁচু সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে হবে। খবর নিয়ে জানলাম যে, ওখানে দুইশ’টি সিঁড়ি রয়েছে। এতগুলো সিঁড়ি কেমনে ভাঙবো। দুইশ’ সিঁড়িতে কত তলা হয়? দশ তলার কম নয়!!! ভিতরে ভিতরে ঘামতে শুরু করলাম।
শত শত মানুষ। নারী পুরুষ ও শিশু কিশোর। সবাই তরতর করে উঠে যাচ্ছে। কেউবা অন্যের সাহায্য নিয়ে সিঁড়ি ভাঙছে। এতো এতো বয়স্ক লোক সিঁড়ি ভাঙ্গতে পারলে আমি পারবো না কেন? সিঁড়ির দিকে হাঁটতে লাগলাম। সিঁড়ির গোড়াতেই একটি সাইনবোর্ড। তাতে ইংরেজী এবং চীনা ভাষায় গ্রেটওয়ালের বর্ণনা দেয়া আছে। এক ঝলক দেখে নিলাম। সাউথ গ্রেট ওয়াল। বুঝলাম যে, এটি দক্ষিণ দিকের দেয়াল।
আমি নেট দুনিয়ায় একটু চক্কর দিলাম। খুব বেশি কিছু পেলাম না। তবে ওখানে যতটুকু ইতিহাস লেখা রয়েছে কিংবা টুকটাক লিফলেট থেকে যা তথ্য পেলাম তাতে চমকিত না হয়ে উপায় ছিল না। চীনের পরতে পরতে রয়েছে নানা ইতিহাস ঐতিহ্যের স্মারক। কতকিছুই যে দেশটিতে রয়েছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। দুই দফায় চীন সফরে তাদের ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের নানাকিছু দেখে মুগ্ধ হয়েছি। সবচেয়ে ভালো লাগে তাদের ঐতিহ্য রক্ষার কসরত। কোন ঐতিহ্যই তারা হাতছাড়া করতে চায়না। চীনের পৃথিবীখ্যাত গ্রেটওয়াল থাকার পরও অপেক্ষাকৃত ছোট এই সাউথ গ্রেটওয়াল সংরক্ষন না করলেও চলতো। কিন্তু কী দুর্দান্ত আয়োজনেই না তারা স্থাপনাটি সংরক্ষন করছে। তাবত দুনিয়ার হাজার হাজার পর্যটক তাদের এই স্থাপনা দেখতে ভীড় করছে।
একটি একটি করে দুইশ’টি সিঁড়ি ভেঙে আমি যখন একেবারে শীর্ষে উঠে গেলাম তখন মনে হলো বিশ্বজয় করে ফেলেছি। এই দেয়ালের উপরটি গ্রেটওয়ালের মতো চওড়া নয়, তবে একেবারে সরুও নয়। দেয়ালের উপর দিয়ে অনায়াসে ঘোড়ার গাড়ি চলার মতো জায়গা রয়েছে। ১০ ফুটের বেশি চওড়া। আমি দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। তারপর দেয়ালের উপর দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম।
তাইজুর সাউথ গ্রেট ওয়াল মূলত চীনের দক্ষিণাঞ্চলের একটি প্রতিরক্ষা দেয়াল। এটি একটি প্রতিরক্ষা এবং সামরিক স্থাপনা। মিং রাজবংশের শাসনামলে ১৩৬৮ সালে এটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। সম্পন্ন হয় ১৬৪৪ সালে। ওই সময় চীনের দক্ষিণাঞ্চলে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী নিজেদের মধ্যে হামেশাই সংঘর্ষে লিপ্ত হতো। এক গ্রুপ অপর গ্রুপকে মেরে শুধু ভর্তাই বানাতো না, ধরেও নিয়ে যেতো। খুন ধর্ষন লুটতরাজকে এরা অনেকটা প্রাত্যহিক কর্মে পরিণত করেছিল। তৎকালীন শাসকেরা স্থানীয় অভিজাত হান জাতির মানুষদের মিয়াওসহ অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে সাউথ গ্রেট ওয়াল নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় এবং দীর্ঘ আড়াইশ’ বছরেরও বেশি সময়ে নির্মাণ সম্পন্ন হয়।
আমরা হাঁটছিলাম। দেয়ালের উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমার মানসপটে ভেসে উঠছিল চীনের বিখ্যাত গ্রেট ওয়ালের দৃশ্য। কিন্তু এই দেয়ালটিকে কোনভাবেই ওটির সাথে মেলাতে পারছিলাম না। এই দেয়ালটি হুনানের মিয়াওশান পাহাড়ে নির্মিত দেয়ালটি ১৯০ কিলোমিটার লম্বা। স্থানীয় ইট পাথর ব্যবহার করে দেয়ালটি নির্মাণ করা হয়েছে। প্রথমতঃ পাহাড়ী অঞ্চল, দ্বিতীয় খাড়া। এমন একটি স্থানে এভাবে দেয়াল নির্মাণ যে কী কঠিন ছিল তা আমি অনুধাবন করার চেষ্টা করছিলাম। চীনা প্রকৌশলীরা আধুনিক যুগে বিশ্ব জয় করেছে। আমি মনে মনে স্বীকার করলাম যে, ওই সময়েও চীনের প্রকৌশল বিদ্যার প্রসার পৃথিবীর অন্য অঞ্চল থেকে এগিয়ে ছিল। কী অসাধারণ দক্ষতার সাথেই না দেয়ালটিকে নির্মাণ এবং পাহাড়ের সাথে খাপ খাইয়ে দেয়া হয়েছে!
কিছুদূর এগুনোর পরই খেয়াল করলাম যে, দেয়ালের মাঝে মাঝে কামান স্থাপন করা হয়েছে। সেগুলো নিরাপদে দাঁড়িয়ে দাগানোর আয়োজনও রয়েছে দেয়ালের ভিতরে। হামলাকারীদের দূর থেকে দেখে লক্ষ্য ঠিকঠাক করে কামান ছোঁড়ার এমন আয়োজন!! আসলেই চীনা বুদ্ধির তারিফ করতে হয়।
পাহাড়ের উপর নির্মিত দেয়াল। পাহাড়ের পাদদেশ থেকে বিস্তৃত এলাকা জুড়ে ধূ ধূ করছে সবকিছু। হু হু করে আসছে বাতাস। সেই বাতাস সৈন্যদের গায়ে লাগানোর জন্য দেয়ালের রেলিংয়ের মাঝে মাঝে খোপ করে রাখা হয়েছে। কী দুর্দান্ত বাতাস! ঘামে গরমে একাকার হয়ে যাওয়া আমরা একেকজন একেক খোপে দাঁড়িয়ে শরীর জুড়িয়ে নিচ্ছিলাম। (চলবে)
লেখকঃ চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।