মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, /আমি তোমাদেরই লোক/ আর কিছু নয়, /এই হোক শেষ পরিচয়। কবিতাটির শেষ চারটি চরণ ঘাসফুল প্রতিষ্ঠাতা পরাণ রহমানের জীবনের পরিচয় দিতে অত্যন্ত সহায়ক ও সমার্থক। উন্নয়নের স্বার্থে উন্নয়নকর্মী পরাণ রহমান হরহামেশায় পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠির বসতভিটায় যাতায়াত করতেন। তিনি যখন যে কমিউনিটিতে যেতেন তখন পরিপূর্ণভাবে সে কমিউনিটির সাথে মিশে যেতেন। তার আচার আচরণে, কথাবার্তায় সেবাগ্রহীতারা আত্মীয়তার উঞ্চতা অনুভব করতেন। মূলত উন্নয়ন সেক্টরে পরাণ রহমানের সফলতা, সার্থকতা, গ্রহণযোগ্যতা এবং জনপ্রিয়তার মূল কারণ ছিলো এখানেই। ঘাসফুল প্রতিষ্ঠাতা শামসুন্নাহার রহমান পরাণ ১৮ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। তার জন্ম চট্টগ্রামে ১৯৪০ সালে ১লা জুন। তিনি মানুষের কাছে ‘পরাণ আপা’ নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন সমাজকর্মী, উন্নয়ন সংগঠক এবং নারী আন্দোলনের পথিকৃৎ সফল যোদ্ধা। শামসুন্নাহার রহমান পরাণের সামাজিক কর্মকাণ্ডের পরিসীমা এককথায় বহুমুখী, বহুব্যাপ্ত। একাত্তরে যুদ্ধ চলাকালীন সময় তিনি মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে কাজ করেন। একাত্তরের পর যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পূনর্গঠনে পূর্ণোদ্যমে নেমে পড়েন পাকিস্তানি হানাদারের হাতে লাঞ্চিত লক্ষ লক্ষ বাঙালি নারীর পুনর্বাসন ও স্বাস্থ্যসেবার কাজে। তার এই কর্মকাণ্ড তখন পূর্ণ সহায়তা দিয়েছিল সেবামূলক আইরিশ প্রতিষ্ঠান ‘কনর্সাণ’। পরবর্তী এক পর্যায়ে সমমনা কয়েকজনের সহযোগিতায় তিনি নিজেই প্রতিষ্ঠা করেন, সেবামূলক বেসরকারি সংগঠন ‘ঘাসফুল’, যা নিবন্ধিত হয় ১৯৭৮ সালে চট্টগ্রামে প্রথম রেজিস্টার্ড উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) হিসেবে। আর্থসামাজিকভাবে সমাজে যারা বঞ্চিত, দলিত, উপেক্ষিত তাদের শক্তি ও সাহস যোগানোর মাধ্যমে স্বাবলম্বী করে প্রষ্ফুটিত করার ইচ্ছা থেকে তিনি তার সংস্থাটির নামকরণ করেছিলেন ‘ঘাসফুল’। ধাপে ধাপে ঘাসফুল বিস্তৃত হয়, বর্তমানে বৃহত্তর চট্টগ্রাম, ফেনী, কুমিল্লা, ঢাকা, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী ও কক্সবাজারসহ দেশের আটটি জেলায় বহুমুখী উন্নয়ন কার্যক্রমের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। পরাণ রহমান বিশ্বাস করতেন অনগ্রসর সমাজের যে শিশুটিকে স্কুলে পড়ার ব্যবস্থা করা হয় তার বাবা–মায়ের জীবনযাত্রা উন্নয়নসহ পরিবারের বয়স্ক বা প্রবীণ (দাদা–দাদী) যারা রয়েছেন তাদেরও সুস্বাস্থ্য ও সামাজিক মার্যাদা প্রতিষ্ঠায় কাজ করা উচিত। এককথায় তিনি বিশ্বাস করতেন, সমন্বিত একটি কার্যকর উন্নয়ণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই সমাজে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব, অন্যথায় যে কোন উন্নয়নে সাময়িকভাবে সফলতা দেখা গেলেও প্রকৃত কিংবা স্থায়ী উন্নয়ন সাধন সম্ভব নয়। একারণে তিনি ঘাসফুলের মূল এজেন্ডায় রচনা করেন, গার্মেন্টসকর্মী থেকে শুরু করে বস্তিবাসী জনগণের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আইনীসেবা, আর্থিক উন্নয়নে ক্ষুদ্রঋণ ও মানবাধিকারসহ জীবনঘনিষ্ঠ সকল বিষয়গুলো।
১৯৯০ সালে তাঁর গড়া প্রতিষ্ঠান ‘ঘাসফুল’ চট্টগ্রামের সেরা এনজিও হিসেবে রাষ্ট্রপতি পদক লাভ করে। এছাড়াও ১৯৯৭ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে ‘ঘাসফুল’ পরিবার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে সেরা এনজিও হিসাবে পদক লাভ করে। পরাণ রহমান তাঁর রেখে যাওয়া কীর্তি বিবেচনায় মরণোত্তর বেগম রোকেয়া পদকে ভূষিত হন। পরাণ রহমানের শিল্প–সাহিত্য সংস্কৃতি ও সামাজিক পরিমণ্ডলেও একটি বিশেষ অবস্থান ছিল। তার সদা হাস্যময়ী, প্রণোচ্ছল, সুদৃঢ় ব্যক্তিত্ত্ব সৃজনশীলতায় এবং নীতিতে তিনি ছিলেন অনন্যা। পরাণ রহমান চট্টগ্রামের প্রায় শতাধিক দুস্থ মহিলাদের উন্নতমানের ধাত্রী প্রশিক্ষণ দিয়ে মহল্লায়–মহল্লায় নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাদের কাজের বন্দোবস্ত করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন এতে করে ওই সকল দুঃস্থ মহিলারা সামজ উন্নয়নে অংশগ্রহণ, নিজের আয়–রোজগারের পাশাপাশি সামাজিক মার্যাদাও লাভ করে। এ লক্ষ্যে সমাজের নিম্নআয়ের মানুষগুলোর পাড়ায় পাড়ায় এ সকল প্রশিক্ষিত ধাত্রীদের বাড়ির সামনে তিনি তাদের নামে সাইনবোর্ড স্থাপন করেন। তিনি অতি যত্নে গড়া নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিতকরণে নিয়োজিত এসকল প্রশিক্ষিত ধাত্রীদের কর্ম–জীবন, পারিবারিক জীবন নিয়ে ‘তৃণমূলের রমণী’ নামে একটি গ্রন্থও লিখেন।
পরাণ রহমান মক্তিযুদ্ধে নির্যাতীত মা–বোন বীরাঙ্গনাদের নিয়ে প্রচুর কাজ করেছেন। তিনি কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রামের ৭১ সালে নির্যাতীত এক কুলবধু; আফিয়া খাতুন খঞ্জনীকে হন্য হয়ে খুঁজতে থাকেন, এবং উদ্ধার করেন বীরাঙ্গনা খঞ্জনীকে। পরাণ রহমান ‘বীরাঙ্গনা’ শব্দটি বলতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন না। তিনিই প্রথম দাবী করেন, নির্যাতীত এ সকল মা–বোনদের যাতে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করা হয়।
পরাণ রহমান একদিকে বঞ্চিত মানুষের জন্য মাঠে–ময়দানে নেমে কাজ করেছেন, অন্যদিকে লেখালেখিতেও ছিলেন সমান অনবদ্য। জাতীয় এবং স্থানীয়ভাবে প্রকাশিত বিভিন্ন দৈনিকে সমসাময়িক বিষয়ে কলাম লেখার পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন ছোটগল্প, কবিতা, প্রবন্ধ। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে; সৃজনে মননে, উপলব্দির আঙিনায়, একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে, পুস্প পরাগ, গল্প মঞ্জুরী, তৃণমূলের অভিজ্ঞ রমণীগণ, মুক্তিযুদ্ধের কথকতা, আরশীতে সোনালী দহন, সুবচন সংগ্রহ, ছোটমণিদের বর্ণ–শব্দ–বাক্য শেখা, ছোটমণিদের লেখা শেখা উল্লেখযোগ্য। তিনি সম্পাদনা করেছেন জায়া (ত্রৈমাসিক), মর্মর (মাসিক), ঘাসফুল বার্তা (ত্রৈমাসিক), আমরা একঘর বাঙালী নামের বিভিন্ন প্রকাশনা।
পরাণ রহমান বিভাজন থেকে বন্ধনকে আবিষ্কার করতেন বেশি এবং বন্ধুত্বের সেতুবন্ধনে আবদ্ধ করেছেন অনেক মানুষকে। তিনি বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামালসহ নারী উন্নয়নযাত্রার মহিয়সী নারীদের এক সার্থক প্রতিনিধি। পরাণ রহমান উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সূচনা করেছিলেন চট্টগ্রামে, যা আজ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে। পর্দা ও সামাজিক বিধি নিষেধের মধ্যে তখনকার একজন নারীর জন্য কাজগুলো ছিলো চ্যালেঞ্জিং। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের শুরু থেকেই চট্টগ্রাম শহরে ছিল তার সরব উপস্থিতি। সময়ের প্রতিনিধিত্বশীল উন্নয়ন সংগঠন ‘ঘাসফুল’কে ঘিরে ছিল তার সৃজনশীল ভাবনা, স্বপ্ন ও জীবনগাথা। নারীর আর্থসামাজিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখায় পরাণ রহমানকে বাংলাদেশ সরকার ২০২১ সালে তাঁকে বেগম রোকেয়া পদকে ভূষিত করেন। বাংলাদেশের উন্নয়ন সেক্টরে যারা কাজ করছেন পরাণ রহমান এখনো তাদের পথের দিশা, আলোকবতির্কা। তার জীবনী উন্নয়নকর্মীদের জন্য একটি বিকল্প পাঠশালা। একজন উন্নয়নকর্মী হিসেবে পরাণ রহমান আমাদের চেতনার উৎস। উন্নয়নযাত্রার সহকর্মী হিসেবে তার স্মৃৃতি, উপদেশ, মমতা এখনো আমাদের হৃদয়ে অমলিন। কবির ভাষায় ‘নেমে আসে শ্রাবণের বৃষ্টিধারা যাঁর নামের ওপর/কখনো ধুলো জমতে দেয় না হাওয়া।’ সফল উন্নয়নকর্মী পরাণ রহমানের আজ নবম মৃত্যুবার্ষিকী। ঘাসফুল পরিবারের পক্ষ থেকে তাঁর বিদেহী আত্মার প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা।
লেখক: উন্নয়নকর্মী