সর্বনাশা দিনটি ছিল শুক্রবার। থ্রি ব্যান্ড ফিলিপস্ রেডিও’র বিবিসি’র খবর শোনার জন্য প্রতিদিন সন্ধ্যায় পুরো পাড়ার লোকজন আমাদের বাড়িত ভিড় জমাতেন। আমার তখনো ঘুম ভাঙেনি। পুরো বাড়ি ভর্তি মানুষ। সবাই কি সব বলাবলি করছে। আমি এমনিতে ঘুম প্রিয় মানুষ। তখনকার দিনে বলা হতো, ভোররাত্রের পড়া মনে ধরে বেশি। মনে থাকে বেশি। ভোররাতে ডেকে দেয়ার ১০ মিনিটের মধ্যে আবার ঘুমিয়ে পড়তাম। সকাল ৮ টার আগে ঘুম থেকে উঠেছি তেমন খুব একটা মনে পড়ে না।
সেদিনকার বাড়ি ভর্তি মানুষের চেঁচামেচি। ফিস ফিসানিতে অগত্যা বিছানা ছাড়লাম। এরপর উঠানে যা দেখলাম তা মৃত্যু অবধি ভুলবার নয়। মেজ কাকাকে ঘিরে পুরো পাড়ার মানুষ। তাঁর হাতে রেডিও। বারবার প্রচার হচ্ছিল, ডালিমের সেই ভয়ঙ্কর আস্ফালন। সে বীরদর্পে ঘোষণা দিয়েছিল স্বৈরাচারী শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। সামরিক আইন জারী হয়েছে। বাংলাদেশ আজ থেকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইত্যাদি ইত্যাদি।
নবম শ্রেণির ছাত্র হলেও সেদিন যা বুঝেছি আজো তার একচুলও নড়চড় হয়নি। ততোদিনে লেলিন, স্ট্যালিন, ক্যাস্ত্রো, বেনবেল্লা, মাও সেতুং আমার পড়া হয়ে গেছে। কঠোর শাসন প্রবর্তন ছাড়া কোনো দেশেই বিপ্লব সফল হয়নি। শেখ ফজলুল হক মণি ঠিকই বলেছিলেন। প্রতিবিপ্লব অবধারিত। বায়াত্তরে আমরা বুঝিনি। একাত্তরের যুদ্ধকে জনযুদ্ধ, স্বাধীনতা যুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ যা’ই বলা হোক না কেন– ওটা ছিল একটা বিপ্লব। পৃথিবীর কোনো দেশেই বিপ্লবোত্তর সময়ে বুর্জোয়া গণতন্ত্রকে প্রশ্রয় দেয়া হয়নি। বাকশাল বা একদলীয় শাসন বায়াত্তরেই প্রবর্তন করা প্রয়োজন ছিল। ঐ ভুলের খেসারত দিয়েছেন স্ববংশে বঙ্গবন্ধু নিজে।
মেজ কাকা আকাশ বাণী ধরলেন। ঐ দিন ছিল ভারতের স্বাধীনতা দিবস। দিল্লীর লাল কেল্লা থেকে স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপনের খবর প্রচারিত হচ্ছিল। বুঝলাম, ঢাকার বিপর্যয় ঘটে যাওয়ার পরও ইন্দিরা গান্ধীর সরকার প্রকৃত ভয়াবহতার ধারে কাছেও ছিলেন না। পরবর্তীকালে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় মার্কিন–চীন–পাক গোয়েন্দা তৎপরতা ‘কেজিব’এর ‘র’ কে কেরীতিমতো ঘুমে রেখে ইতিহাসের নৃশংসতম এই হত্যাকান্ড সংঘটিত করে ফেলেছে। আজে মনে করি আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জানতো এবং দক্ষতার সাথে ঘটনা ঘটতে দিয়েছে। তখনকার ডিএফআই (সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা) প্রধান ছিলেন পাকিস্তান ফেরত বিগ্রেডিয়ার আবদুর রউফ। ইশারায় কাফি বলে একটি জুতসই বাংলা প্রবচন আছে!
ডালিম স্পষ্টভাবে বলেছিল, সামরিক বাহিনী রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করেছে। ঐ মুহূর্তে উর্ধ্বতন সামরিক কর্তাদের দায়িত্ব কী ছিল? বিপথগামী জুনিয়র সামরিক অফিসারদের কর্মকাণ্ড বলে পরবর্তীকালে অব্যাহত প্রচারণা চালিয়ে সামরিক কর্তারা ধোয়া তুলসী পাতা সাজতে চেয়েছে। কিছু একটা যে ঘটতে যাচ্ছে তা অধিকাংশ উচ্চপদস্থ অফিসাররা জানতেন। আসলে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তন ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের ক্ষমতা গ্রহণ সেনাকর্তারা ভালো ভাবে নেয়নি। সামরিক কর্তারা মনে করেছে দেশ তারাই স্বাধীন করেছে। দেশ শাসন করার অধিকারও তাদের। বঙ্গবন্ধুর লাশ ৩২ নাম্বারে পড়েছিল আর সেনাকুঞ্জের কর্তারা হিসেব করছিলেন, কে কখন রাষ্ট্রপতি হবেন। পরবর্তী ইতিহাস তাই’ই বলে।
সামরিক কর্তাদের জীবিত সবাই বই লিখেছেন বা সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। প্রত্যেকে নিজেকে ধোয়া তুলসি পাতা দাবী করে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দেয়ার অপচেষ্টায় থেকেছেন এবং এখনো আছেন। ডালিম অস্ত্র হাতে সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ’র চেম্বারে ঢুকে রেডিও স্টেশনে যাবার জন্য চাপ দিচ্ছিল। মনে রাখতে হবে, ঐ মুহূর্তে জিয়া, খালেদ, শাফায়াত সহ সব উর্ধ্বতন কর্তারাই উপস্থিত ছিলেন। কেউ রিভলবার হাতে নিল না। কেউ গর্জে উঠলো না। শফিউল্লার দরজায় সেন্ট্রি–ডিউটিতে ছিল। শফিউল্লাহ নির্দেশ দিলে ডালিমকে গুলিবিদ্ধ করা ছিল সেকেন্ডের ব্যাপার। ফারুক রশীদদের তখন একমাত্র প্রাপ্য ছিল গুলি। এতো বড় বড় জেনারেলরা বিড়ালের মতো চেয়ারে বসে রইলেন। আসলে অপদার্থ শফিউল্লাহ ছাড়া বাকীদের অনেকেই ঘটনা ঘটাতে যাচ্ছে জানতেন। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর এরা মনে মনে খুশী ছিল। কালো সানগ্লাসের ভিতর লুকিয়ে থেকে এরা রাষ্ট্রপতি হবার স্বপ্নে ছিলেন বিভোর।
শেখ হাসিনা একবার দুঃখ করে বলেছিলেন, কারবালার প্রান্তরেও এক পরিবারের এতো মানুষ হত্যা করা হয়নি। মীর মোশররফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু’ কয়েকবার পড়ে সত্যতা পেয়েছি। আসলে এক পরিবারে এতো প্রাণহানি কারবালার প্রান্তর কেন পৃথিবীর অন্য কোনো প্রাসাদ হত্যাকাণ্ডেও ঘটেনি। আলেন্দে হত্যা, বাদশাহ ফয়সাল হত্যা, গাদ্দাফী, সাদ্দাম, মহাত্মা গান্ধী, ইন্দিরা গান্ধী, লিয়াকত আলী খান, জন এফ কেনেডী, রাজীব গান্ধী, সপরিবারে রাজী বীরেন্দ্র, বেনজীর ভুট্টো সহ সাম্প্রতিক কোন রাজনৈতিক হত্যাকান্ডে এক পরিবারের এতো মানুষের লাশ পড়েনি।
নৃশংসতার দিকটি সম্ভবত: গত কয়েক শতকের ইতিহাসের সব’চে নির্মম, নিষ্ঠুর ও বিধ্বংসী। গত পাঁচ শতাব্দীতে সভ্যতার অনেক অর্জন আছে মর্মে দাবী করা হয়। এই সময়টাকে মানবাধিকার, নাগরিক অধিকার, মুক্ত চিন্তা, সহনশীলতা সহ অনেক কিছুই মানুষ অর্জন করেছে মর্মে দাবী করা হয়। শিশু রাসেলকে হত্যার মধ্য দিয়ে গত অর্ধসহস্রাব্দের সমস্ত অর্জনকে ধুলিসাৎ করা হয়েছে। সেদিন অনুভূতি বলতে আমার কিছুই ছিল না। আসলে ভাবছিলাম এতো অকতৃজ্ঞ জাতি বোধ হয় পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। উদির্পরা লোকগুলো মানব সভ্যতার কপালেই একে দিয়েছে কলঙ্ক তিলক। আরো সহস্র বৎসরেও এ কলঙ্ক ঘুচবে না।
১৫ আগষ্ঠ আসলেই আমার সব অনুভূতি অনেকটা লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। তখনো এ্যামনেস্টির মতো মানবাধিকারের ফেরিওয়ালার অভাব ছিল না। গোটা দিন গোটা রাত রেডিও’র পাশে বসা ছিলাম। পুরা পাড়ার লোকজনের একটাই প্রশ্ন আমাদের কি আবার শরণার্থী হতে হবে? মেজ কাকা শুধু বলেছিলেন, সামনের দিনগুলো এক কথায় ভয়াবহ। পৃথিবীর একটি দেশও এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিল না। শত শত নোবেল জয়ীর কেউ বললো না, এ হত্যাকাণ্ড গোটা মানবজাতির বিরুদ্ধেই এক জঘন্য অপরাধ। গোটা মধ্যপ্রাচ্যের একজন রাজাবাদশাও নিন্দা জানালো না। দেশে কতোসব জ্ঞানী গুনির বহর। বাংলার কোনো প্রান্ত থেকে প্রকাশ্যে উচ্চারিত হলো না, আমরা এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানাই। সন্তানতুল্য বাঘা কাদের, মৌলভী সৈয়দ, বিশ্বজিৎ নন্দী, মহিউদ্দীন চৌধুরী সহ যারা প্রতিবাদ করেছে, তাদের অনেককে চট্টগ্রাম ষড়যন্ত্র মামলায় আসামী করা হয়েছিল। জেনারেল জিয়ার দাপটে তারা দেশান্তরী হতে বাধ্য হয়েছিলেন। একাত্তরের মতো সেদিনও মাতৃস্নেহে আশ্রয় দিয়েছিলেন মনুষ্যত্বের প্রতীক নেহেরু তনয়া ইন্দিরা গান্ধী আর ধর্ম নিরপেক্ষতার ভারতবর্ষ। দিনটি কাছে এলে আজো হারিয়ে ফেলি আমার সব সুকুমার বৃত্তি, সব অনুভূতি।
লেখক: আইনজীবী, কলামিস্ট।