চট্টগ্রামের বিভিন্ন ইলেকট্রিক মার্কেটে বিক্রি হচ্ছে নকল ও নিম্নমানের বৈদ্যুতিক পণ্য। এসব পণ্যের কিছু আমদানি করা, কিছু দেশে তৈরি করা হচ্ছে। কারসাজি করে আসল ব্র্যান্ডের বলে রেপ্লিকা পণ্য পাইকারি ও খুচরা মূল্যে বিক্রি করা হচ্ছে। এসব পণ্য কিনে প্রতারিত হচ্ছেন ক্রেতারা। পাশাপাশি ভুয়া ওয়ারেন্টি–গ্যারান্টির মাধ্যমেও ঠকানো হচ্ছে ক্রেতাদের।
চট্টগ্রামের সবচেয়ে পুরনো ও নামী ব্র্র্যান্ডের কেবি ফ্যানের নাম ব্যবহার করে নকল কেবি ফ্যান বিক্রির মাধ্যমে গ্রাহকদের প্রতারিত করার ঘটনায় চট্টগ্রামের জেলা জজ আজিজ আহম্মদ ভূঞার আদালতে মামলা হয়েছে। হাটহাজারী এলাকার মেসার্স হক ফ্যান ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক আবদুল হকের করা ওই মামলায় আসল কেবি ফ্যানের ট্রেডমার্ক ব্যবহার করে নকল কেবি ফ্যান উৎপাদন ও বাজারজাত করার ওপর অন্তর্বর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে উল্লেখিত আদালত। ওই কেবি ফ্যান কোম্পানির (নকল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক হচ্ছেন চট্টগ্রাম নগরীর দক্ষিণ হালিশহর এলাকায় বসবাসকারী সুমন কুমার দে। হাটহাজারী এলাকার মেসার্স হক ফ্যান ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক আবদুল হকের করা মামলার বিষয়ে আদালত থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে জানা যায়, নকল কেবি ফ্যান বাজারে দেখার পর উল্লেখিত আবদুল হক গত এপ্রিলে চট্টগ্রামের জেলা ও দায়রা জজ আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় বিবাদী করা হয় কেবি ফ্যান (নকল) কোম্পানি লিমিটেড ও এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুমন কুমার দে’কে। মামলার আরজিতে আসল কেবি ফ্যানের ট্রেডমার্ক নকল করে বানানো কেবি ফ্যানের উৎপাদন ও বাজারজাত করার উপর অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা চান বাদী। জবাবে আদালত ২০ জুন উল্লেখিত নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন বলে জানান চট্টগ্রাম বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবসায়ী গ্রুপের সভাপতি এম ইলিয়াছ খান আইয়ুব।
সরেজমিনে ইলেকট্রিক পণ্যের মার্কেটগুলোতে নকল ও নিম্নমানের বৈদ্যুতিক পাখা, পানির পাম্প, বাল্ব, টিউব লাইট, এলইডি লাইট, বৈদ্যুতিক সুইচ, সকেট, কাটআউট, হোল্ডার, রেগুলেটর, মাল্টিপ্লাগ ও বৈদ্যুতিক তারসহ নানা পণ্য বিক্রি করতে দেখা গেছে। রিয়াজউদ্দিন বাজার ও শাহ আমানত মার্কেটের প্রায় প্রতিটি দোকানেই নিম্নমানের ইলেকট্রিক পণ্য দেখা গেছে। নামিদামী বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বৈদ্যুতিক পাখা, টেলিভিশন বিক্রি করতে দেখা যায়, যার সবই মূলত নিম্নমানের রেপ্লিকা। কিন্তু ক্রেতাদের এসব পণ্য আসল বলেই বিক্রি করা হচ্ছে।
অদূরেই হাঁকডাক দিয়ে বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের এলইডি লাইট। মাইকে ‘৩০০ টাকার লাইট ১৫০ টাকা’ বলে বিক্রি করা হচ্ছে। পাশাপাশি এক বছরের ভুয়া গ্যারান্টিও দেওয়া হচ্ছে। এদিকে ছাড়ের এই হুজুগে অনেক ক্রেতাই ভিড় করেন লাইট কিনতে। এছাড়া কয়েকদিন ব্যবহারের পর নষ্ট লাইট নিয়েও অনেকে হাজির হয়েছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৫০ টাকায় যেসব এলইডি লাইট বিক্রি হচ্ছে তা কোনো ধরনের মানদণ্ড নিশ্চিত করা ছাড়াই কারিগর দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে। প্রতিটি লাইটে ৫–৬টি ছোট আকারে এলইডি লাইট, একটি নিম্নমানের আইসি ও মাদারবোর্ড যুক্ত করে ৪০–৫০ টাকা খরচে তৈরি করা হয়। এরপর বিক্রি হচ্ছে বেশি দরে। কিছুদিন ব্যবহারের পর এসব লাইট নষ্ট হয়ে যায়। এতে ক্রেতার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। পাশাপাশি নিম্নমানের এসব পণ্যের কারণে বড় ধরনের বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটের আশঙ্কাও থাকে।
রাহুল নামে এক ক্রেতা বলেন, ৮ দিন আগে এই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় মাইকে ১৫০ টাকায় লাইট বিক্রির অফার শুনে দুটি কিনেছিলাম। সঙ্গে ১ বছরের গ্যারান্টিও ছিল। কিন্তু আট দিন যেতে না যেতে দুইটা লাইটই নষ্ট হয়ে যায়। এখন ওরা বলছে, এই লাইট আমি এখান থেকে কিনিনি।
সাতকানিয়া থেকে ফ্যান কিনতে আসা গ্রাহক মিজানুর রহমান জানান, বাজারে নকল ফ্যানের ছড়াছড়ির কথা মাথায় রেখে রাইফেল ক্লাব মার্কেটে কেবি ফ্যান কিনতে এসেছি। নকল ফ্যানের উৎপাদন ও বাজারজাত বেড়ে গেছে বলে জানালেন এখানকার সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দেখা দরকার বলেও জানান এই গ্রাহক।
আরেক ক্রেতা জাহিদুল হোসেন জানান, সাড়ে চার মাস আগে ৩২০০ টাকা দিয়ে একটি জেএফসি (মূলত রেপ্লিকা) বৈদ্যুতিক পাখা কিনেছিলাম। ৪ মাসের গ্যারান্টি ও এক বছরের ওয়ারেন্টি ছিল। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই পাখাটিতে সমস্যা দেখা দেয়। এরপর একদিন হঠাৎ পাখাটি বন্ধ হয়ে যায়। মিস্ত্রিকে দেখালে পাখাটি নকল বলে জানান। এক বছরের ওয়ারেন্টি থাকলেও বিক্রেতারা পাখাটি বদলে বা ঠিক করে দিচ্ছেন না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিক্রেতা জানান, অনেক সময় পণ্য আসল বলে বিক্রি করতে হয়। কারণ এখানে যেসব পণ্য বিক্রি হয় তার বেশিরভাগই রেপ্লিকা বা বিভিন্ন দেশ থেকে অর্ডার করে বানানো। পাশাপাশি কিছু পণ্য যেমন সুইচ–সকেট, মাল্টিপ্লাগ, চার্জার ফ্যান, এলইডি লাইট ইত্যাদি কারিগর রেখে এখানেই তৈরি করা হয়। তাই ক্রেতাদের বুঝেশুনে দামাদামি করে কিনতে হয়। অনেক সময় এসব পণ্যে কোনো ধরনের সমস্যা হয় না। আবার অনেক পণ্য ব্যবহারের কিছুদিন পর নষ্ট হয়ে যায়।
নগরীর বিভিন্ন মার্কেটে চীন থেকে আমদানি করা বিভিন্ন ব্র্যান্ডের হুবহু নিম্নমানের বৈদ্যুতিক পাখাও বিক্রি হচ্ছে। কিছুদিন ভালো সার্ভিস দিলেও তা পরে নষ্ট হয়ে যায়। নগরীর সদরঘাট, রিয়াজউদ্দিন বাজার, পাহাড়তলী, হালিশহর, বায়েজিদসহ একাধিক স্থানে নিম্নমানের বৈদ্যুতিক তার তৈরির কারখানাও রয়েছে। নিম্নমানের এসব পণ্যে ঝুঁকি বাড়ছে ব্যবহারকারীদের। বিদ্যুৎস্পৃর্শ হয়ে মৃত্যুর পাশাপাশি ঘটছে একের পর এক অগ্নিকাণ্ড।
এসব নকল পণ্য বাজারজাত হচ্ছে সারা দেশেই। অথচ যেকোনো পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করতে হলে অনুমোদন নিতে হয় মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই)। এদিকে নকল ফ্যানসহ নকল ইলেকট্রনিক্স পণ্য উৎপাদনকারী ও বাজারজাতকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর আহ্বান জানিয়েছেন চট্টগ্রাম বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবসায়ী গ্রুপের নেতারা।