(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
দাড়াশ সাপের মতো নিঃশব্দে এসে ঘা ঘেঁষে দাঁড়ালো বিশাল লম্বা ট্রেন। ট্রেনের এমাথা থেকে ওমাথা যেনো এক চোখের পথ! কত বগি লাগানো রয়েছে ট্রেনটিতে? গুগল চার্জ বা কাউকে জিজ্ঞেস করলে হয়তো জানতে পারতাম। কিন্তু কত বগি আছে তার চেয়ে ট্রেনটি এত নিঃশব্দে কী করে চলে সেটিই যেনো আমার কাছে বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিল। ট্রেন এমন নিঃশব্দ হয়! এত শব্দহীন! আমাদের ট্রেনের গগনবিদারী শব্দ যেখানে রেললাইনের আধা মাইল দূরের বাড়িঘরের মানুষের ঘুমও ভাঙ্গিয়ে দেয়, সেখানে চীনের ট্রেন এমন মিহি শব্দে কী করে চলে! কী সাংঘাতিক!
চোখের সামনে তিনশ’ কিলোমিটার গতিবেগের ট্রেন দেখে পুলকিত আমি। ট্রেনটি দেখতেও বেশ ভালো লাগছিল। এত চমৎকার এবং তকতকে লাগছিল যে, ট্রেনটি যেনো কারো বাসর ঘরের ঘরণী। এমন ট্রেনে চড়তে পারায় অন্যরকমের ভালো লাগায় আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছিলাম আমি। নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে হচ্ছিল। আবার এই ট্রেনে না চড়ে দেশে ফিরে যাওয়ার যে উদ্যোগ নিয়েছিলাম তা না করায় নিজেকে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে হলো। আহা, আমাদের পুরো দলটি থাকলে কী না ভালো লাগতো!
প্ল্যাটফরমে ট্রেন দাঁড়ানোর পরপরই দরোজাগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে গেছে। যাত্রীরা ট্রেনে চড়তে শুরু করেছেন। আমিও সামনের দিকে পা বাড়ালাম। কায়সার ভাই এবং জোবায়ের আমার টিকেটের সবকিছু বুঝিয়ে দিয়েছেন। টিকেটের মাঝে বগির নম্বর এবং সিট নম্বর রয়েছে। এই বগি কি করে খুঁজে পাবো তাও তারা বুঝিয়ে দিয়েছেন। অতএব সিট খুঁজে নিয়ে বসতে কোন সমস্যা হবে বলে মনে হচ্ছে না। আমি সামনের দিকে এগুতে থাকলাম।
ট্রেনে কোন হুড়োহুড়ি নেই, নেই কোন ধাক্কাধাক্কিও। যাত্রীরা নিজেদের মতো করে ট্রেনের বগিতে চড়ছেন, নিজের আসনে বসছেন। তবে একটি জিনিস বেশ ভালোমতোই লক্ষ্য করলাম যে, এখানেও ইউরোপ আমেরিকার মতো ট্রেনের বগি এবং প্লাটফরমের ফ্লোর একই লেভেলে। চাকা লাগানো ট্রলিব্যাগ ঠেলে ট্রেনের দরোজায় ঢুকিয়ে দেয়া যায়, স্বাভাবিকভাবে হেঁটে চড়া যায় বগিতে। আমাদের বাংলাদেশ রেলওয়ের ট্রেনের বগিতে চড়ার মতো সিঁড়ি ভাঙ্গার দরকার হয় না। নামার সময় লাফ দেয়া কিংবা পড়ে হাত পা ভাঙ্গারও আশংকা থাকে না। অথচ এই চীন থেকে কেনা বগি নিয়ে আমাদেরকে কী কসরৎ–ই না করতে হয়! কত ভোগান্তি সয়েই না আমাদের বুড়ো বাবা মা কিংবা প্রতিবন্ধী ভাইবোনদের ট্রেনে চড়তে হয়!! মনে হয় বগিগুলো আসমানে। লাফিয়ে লাফিয়ে উঠতে হয়! লাফিয়ে লাফিয়ে নামতে হয়! মজার ব্যাপার হচ্ছে, বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য কেনা ট্রেনের এসব বগি চীনের কারখানায় বানানোর সময় আমাদের প্রকৌশলীরা সব দেখেশুনে ছাড়পত্র দেন! আবার জাহাজে তোলার আগেও প্রি–শিপমেন্ট ইন্সপেকশন করতে আসেন। আমাদের প্লাটফরমের ফ্লোরের সাথে বগির ফ্লোরের উচ্চতা তাদের মাথায় থাকে না। ডেমু ট্রেন নিয়ে কী বিচ্ছিরি কান্ডই না ঘটেছিল! প্ল্যাটফরম থেকে বেশ উঁচু বগিগুলোতে চড়তে যাত্রীদের কেয়ামত দর্শন হয়ে যাচ্ছিল। কোথাও কোথাও প্লাটফরম উঁচু করেও শেষরক্ষা হয়নি। ঠিকই লাফালাফি করতে হয়!
যাক, ট্রেনের ভিতরে ঢুকে আমার মন ভালো হয়ে গেল। সেকেন্ড ক্লাস বগি, কিন্তু কী যে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন! চারদিকে একেবারে তকতকে ঝকঝকে। ব্রডগেজ লাইন, বগি কিছুটা চওড়া। একপাশে তিনটি করে দুই পাশে ছয়টি চেয়ার। মাঝখানে হাঁটাচলার পথ। আবার বিপরীত দিক থেকেও একইভাবে চেয়ার বসানো। মাঝের হাঁটাচলার পথের দু’পাশে মুখোমুখি ছয়জনের বসার ব্যবস্থা। আবার কতগুলো চেয়ার একটির পর একটি করে দেয়া। একপাশে তিনটি অপর পাশে তিনটি। একজন যাত্রীর পেছনে অপর যাত্রীর চেয়ার। বিমানে যাত্রীদের সিট দেখানোর জন্য যেমন কেবিন ক্রুরা দরোজায় দাঁড়িয়ে পথ দেখিয়ে দেন, এই ট্রেনটিতেও তেমনি এক তরুণী যাত্রীদের টিকেট দেখে সিট দেখিয়ে দিচ্ছিলেন। আমি মনে মনে বেশ শংকিত হয়ে উঠেছিলাম যে, উল্টো দিকে ফিরে বসতে হলে আমার খবর আছে। আমি ট্রেনে গতির বিপরীতে উল্টো মুখ করে বসতে পারি না। সাংঘাতিক খারাপ লাগে। কথাটি কায়সার ভাইকে বলেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, এটি কোন সমস্যা নয়। ট্রেনের ভিতরে যে কারো সাথে টিকেট পাল্টে নিতে পারবেন। এখানে হেল্প করার লোকের অভাব নেই।
নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। আমার সিট ঠিকঠাক মতোই আছে। সামনের দিকে মুখ করে আমাকে বসতে হবে। সিটও জানালার পাশে। জানালাটিও চমৎকার। জানালা মানে শুধু একটি কাচ। কোন জোড়া নেই, টানাটানির বালাই নেই। বিশাল স্বচ্ছ কাঁচের ভিতর দিয়ে বাইরে আকাশ পানে তাকিয়ে থাকুন, কিংবা মাঠের গরু দেখুন তাতে কোন সমস্যা নেই। চওড়া জানালার পুরোটাতে শুধুমাত্র একটি কাচ থাকায় আই সাইটের পুরোটাই খোলা!
চেয়ারটি বেশ আরামদায়ক। হালকা হেলান দেয়ার ব্যবস্থা, তবে শুয়ে পড়ার ব্যবস্থা নেই। অবশ্য যতটুকু হেলান দিলে আরাম লাগে ঠিক ততটুকু দেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। আমি সিটে বসতে বসতে আশে পাশের যাত্রীদের এক ঝলকে দেখে নিলাম। দীর্ঘ পথ তাদের সাথে যেতে হবে! যাত্রীদের সবাই এখনো আসেননি। সিটগুলো খালি। তবে যাত্রীরা উঠছেন, বসছেন। অল্পক্ষণের মধ্যে আমার ধারেকাছের সব সিটেই যাত্রী, একটি সিটও খালি থাকলো না। আমার বুঝতে বাকি থাকলো না যে, এটি বেশ ব্যস্ত একটি রুট। প্রতিদিন প্রচুর লোক গুয়াংজু–বেইজিং যাতায়ত করেন!
নির্দিষ্ট সময়ে,একদম ঘড়ির কাটা ধরে ছোট্ট একটি ঝাকুনি টের পেলাম। বুঝতে পারলাম যে ট্রেন ছুটতে শুরু করেছে। জানালায় দেখলাম সবকিছু পেছনে ছুটছে। আমি ভিতরে ভিতরে তিনশ’ কিলোমিটারের গতিবেগের অপেক্ষা করতে শুরু করলাম।
আমার জীবনজুড়ে ট্রেন ভ্রমণের জয় জয়কার। ছাত্রজীবন কিংবা কর্মজীবনের শুরুতে ট্রেন যাত্রা ছিল নিয়মিত। পরবর্তীতে দেশে ট্রেন ভ্রমন কমে গেলেও যখনি বিদেশে গেছি তখনি কোন না কোন ধাঁচের ট্রেনে চড়েছি। নানা ধরণের ট্রেন। মাটির তলায়। মাটির উপরে। কোথাও ভবনের নিচ দিয়ে, কোথাও আবার নদীর তলদেশ দিয়ে ছুটেছে ট্রেন। কখনো ডিজেল চালিত। কখনো ইলেক্ট্রিক চালিত। কখনো চালক নিয়ন্ত্রিত। আবার কখনো চালকবিহীন ট্রেনেও চড়েছি। চড়েছি স্বল্প গতির ট্রেনে, দ্রুত গতির ট্রেনেও কম চড়া হয়নি! আহা কত ধরনের ট্রেনে যে চড়লাম!!
আজো বেশ মনে পড়ে জীবনের প্রথম বুলেট ট্রেনে চড়ার কাহিনী। বেশ কয়েক বছর আগে জাপানের টোকিও গিয়েছিলাম। জাপানের বুলেট ট্রেন নাকি দুই আড়াইশ’ কিলোমিটার বেগে চলে। কথাটি কেমন অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল। অবশ্য মাউন্ট ফুজির পাশ দিয়ে একটি ট্রেনের চোখের পলকে ছুটে অদৃশ্য হতে দেখে দুই আড়াইশ’ কিলোমিটার বেগের ট্রেন চলার কথা অবিশ্বাস করতে পারিনি। তবে সেটি দেখার জন্য পরাণের একেবারে গহীনে হাহাকার উঠেছিল। জাপানের ওসাকা থেকে টোকিও পর্যন্ত আমাদের ট্রেনে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে সেই সিদ্ধান্ত পাল্টে আমরা বাসে যাত্রা করেছিলাম। এতে করে বুলেট ট্রেনে চড়ার সুযোগটি হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু জাপানে এসে বুলেট ট্রেনে চড়বো না! এই ট্রেন না চড়ে ফিরে যাবো! মন মানছিল না। সিদ্ধান্ত নিলাম বুলেট ট্রেনে চড়তে হবে। কিন্তু এই ট্রেনে চড়ে আমি যাবো কোথায়! জাপানে তো আমার তেমন কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।
কি আর করা! জাপানের প্রবাসী এক বন্ধুর সহায়তায় টোকিও থেকে পরের স্টেশনের টিকেট নিলাম, ওই স্টেশন থেকে আবার ফিরতি টোকিও। যতটুকু মনে পড়ে টোকিও থেকে প্রায় একশ’ কিলোমিটারের মতো পথ পাড়ি দিতে হয়েছিল। স্টেশনে নেমে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির করার পরই ফিরতি ট্রেন ছিল। সেটিতে চড়ে আবার একশ’ কিলোমিটার মাড়িয়ে পৌঁছেছিলাম টোকিওতে। এই একশ’ কিলোমিটার পথ আসা যাওয়ায় বুলেট ট্রেনের টিকেট বাবদ আমাকে গুনতে হয়েছিল একশ’ ডলার! যা ওই সময়কার হিসেবে খুব একটি কম টাকা ছিল না। তাছাড়া শুধুমাত্র ট্রেনের গতিবেগ দেখার জন্য বিদেশের মাটিতে একশ’ ডলার খরচ করতে আমার কলজেতে ধাক্কা লেগেছিল। তবে একথা ঠিক যে, ওই সময় এমন দ্রুতগতির ট্রেনটিতে চড়ে আমার অন্তর ভরে গিয়েছিল। ট্রেন যে কেমন করে এমন গতিতে ছুটে তা আমার ভাবনার একটি বড় অংশ দখল করে রেখেছিল।
পরবর্তীতে বুলেট গতির বহু ট্রেনে চড়েছি। চড়েছি নানা পথে, নানা গতির ট্রেনে। সড়কের উপরে ফ্লাইওভারের মতো রেললাইন ধরে হেলেদুলে চলা মনোরেল যেমন ক্ষণে ক্ষণে কলজেয় টান মেরেছে, তেমনি ইংলিশ চ্যানেলের নিচ দিয়ে লন্ডন থেকে প্যারিস যাওয়ার রোমাঞ্চ আজো পুলকিত করে। ইউরোপের জার্মানি থেকে ট্রেনে চড়ে অস্ট্রিয়া কিংবা অস্ট্রিয়া থেকে ভেনিস বা ভেনিস থেকে রোম যাওয়ার যে অভিজ্ঞতা তা এখনো বেশ চাঙ্গা করে আমাকে। ইউরোপের দীর্ঘ ওই সফরে ট্রেনগুলো আমার বাড়িঘর হয়ে উঠেছিল। (চলবে)।
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।