সপরিবারে বঙ্গবন্ধু : শেখ হাসিনার স্মৃতিতে চট্টগ্রাম

মুহাম্মদ শামসুল হক | রবিবার , ৩১ অক্টোবর, ২০২১ at ৫:৩৯ পূর্বাহ্ণ

বঙ্গবন্ধু সারা জীবন রাজনৈতিক-সাংগঠনিক কাজে ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যে কাটিয়েছেন। এই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে পাকিস্তান আমলে ২৪ বছরের মধ্যে প্রায় ১২ বছরই কাটিয়েছেন কারাগারে। এ অবস্থায় পরিবার-পরিজন নিয়ে কোথাও ঘুরে আনন্দময় সময় কাটাবেন এমন সময় ও সুযোগ মিলত না বললেই চলে। আইউব খানের সামরিক শাসনামলে প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানো অনেকটা কঠিন ছিল।
১৯৫৮ সালের অক্টোবরে ক্ষমতা দখলের পর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইউব খান এবডো (রাজনৈতিক দলবিধি) নামক একটি বিধি জারি করে রাজনৈতিক নেতাদের গতিবিধির ওপর বিশেষ নজরদারি শুরু করেন। ওই সময় আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেক নেতাকে নানান অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। এর আগে তাঁর বিরুদ্ধে বেশ কিছু গোয়েন্দা রিপোর্ট তৈরি করা হয়। বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হন ১২ অক্টোবর (মতান্তরে ১১ অক্টোবর)। পরবর্তী সময়ে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হলে হাই-কোর্ট তাঁকে মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু আইউব খান বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে ৫৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর তাঁকে মুক্তি দেন। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত বঙ্গবন্ধু কোষ গ্রন্থে জানা যায়, মুক্তি লাভের পর ৬০-৬১ সালে পুলিশের নজরদারির মধ্যে বঙ্গবন্ধু জেলের বাইরে ছিলেন। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তিনি গোপনে ঢাকার বাইরে গোপালগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রাম গিয়ে নেতা-কর্মীদের সঙ্গে গোপন বৈঠক করেন।
স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের মতে, তখন বিভিন্ন জেলায় ব্যক্তিগত সফরের আড়ালে সংগঠন গোছানোর কাজে লেগে থাকতেন বঙ্গবন্ধু। এরমধ্যে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সাংগঠনিক এলাকা চট্টগ্রামেই বেশি সময় আসতেন তিনি। প্রসঙ্গত চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে এখানকার অনেক নেতা-কর্মীর সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল ক্ষেত্রবিশেষে তা পারিবারিক সম্পর্কে উন্নীত হয়েছিল। সে সম্পর্কের সুবাদে ১৯৬১ সালে বঙ্গবন্ধু একবার সপরিবারে চট্টগ্রাম এসেছিলেন। এসেছিলেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর ভাই শেখ কামাল, শেখ জামাল ও বোন শেখ রেহানা।
এসব তথ্যের সত্যতা মেলে বঙ্গবন্ধু কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সংশ্লিষ্ট একাধিক জনের স্মৃতিচারণায়। শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৯৬১ সাল হবে। চট্টগ্রামে বেড়াতে গিয়েছি। ওখানে আওয়ামী লীগের নেতা এম এ আজিজ সাহেব আব্বার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। চট্টগ্রামে সেবার আমাদের প্রথম যাত্রা। তাই খুব ঘুরে বেরিয়েছি। আজিজ কাকার ছেলে মঞ্জু (বর্তমানে জাসদ নেতা) ও মেয়ে বিলকিস, আমি ও কামাল, আমাদের খুব বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। আমরা খুব বেড়াতাম. পাহাড় বেয়ে উঠতাম। আমরা সমতল ভূমির মানুষ- জীবনে প্রথম পাহাড় দেখছি। পাহাড়ের উচ্চতা তাই আমাকে অবাক করে দিত। এ ছাড়া ঐতিহাসিক চট্টগ্রাম। মাস্টারদার বিপ্লবের কাহিনী ছড়িয়ে আছে। যদিও পাকিস্তান আমলে সেসব বই নিষিদ্ধ ছিলো। তবুও চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন বা প্রীতিলতা ওয়াদ্দাদার, কল্পনাসহ সব কাহিনী আগ্রহ নিয়ে পড়তাম। তাই কোর্ট বিল্ডিং, জালালাবাদ পাহাড়, চট্টগ্রাম ক্লাব সব ঘুরে ঘুরে দেখছি। কোর্ট বিল্ডিং থেকে রাতের সমুদ্রের অপূর্ব রূপও একদিন দেখলাম।’
শেখ হাসিনার বক্তব্যের সমর্থন মেলে এক সময়কার সাংস্কৃতিক কর্মী-গণসংগীত শিল্পী, ননী গোপাল দত্তের (আঞ্চলিক গানের প্রয়াত জনপ্রিয় শিল্পী শেফালী ঘোষের স্বামী) কথায়। তিনি বঙ্গবন্ধু ও এম এ আজিজদের সঙ্গে একটি যৌথ ব্যবসার ম্যানেজিং পার্টনার ছিলেন ষাটের দশকের শুরুতে। এম এ আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী, মানিক চৌধুরীদের সঙ্গে সম্পর্কের সূত্রে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচয় তাঁর। তিনি জানাচ্ছেন, ‘১৯৬১ সালে বঙ্গবন্ধু একবার সপরিবারে চট্টগ্রাম আসেন। কঙবাজার কাপ্তাই ইত্যাদি জায়গায় যান। আজিজ মিয়া, মানিক চৌধুরী এরা সাথে ছিলেন। নেতারা ছিলেন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে, আর আমি ছিলাম ওনার পরিবারকে বিভিন্ন জায়গা দেখানো নিয়ে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও সে সময় ছিলেন।’
বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে চট্টগ্রাম সফর নিয়ে এম এ আজিজের বড় মেয়ে বিলকিছ বানু তাঁর স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, ‘১৯৬০ সালে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে চট্টগ্রামের উপকূলীয় অঞ্চল ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর কিছুদিন পর সম্ভবত ১৯৬১ সালের প্রথম দিকে হাসু আপা (শেখ হাসিনা), কামাল ভাই, জামাল এবং রেহানাকে নিয়ে মুজিব কাকা চট্টগ্রাম আসেন। বাবা চট্টগ্রাম স্টেশন রোডের রেস্ট হাউজে (বর্তমান মোটেল সৈকত) তাদের থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। আমি এবং বড় ভাই (নুরুদ্দিন জাহেদ মঞ্জু) বাবার সাথে একদিন সেখানে যাই। বাবার বন্ধু ও আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রহমান চৌধুরীর গাড়ি এবং অন্য আর একটি গাড়ি নিয়ে হাসু আপাদেরসহ আমাদের সবাইকে বাবা বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যান। আমার এখনো মনে আছে ৬০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ফৌজদারহাটে যে জাহাজটি চরে আটকা পড়েছিল, আমরা সেটিও দেখতে যাই। তারপর বাটালি হিল, কোর্ট বিল্ডিংয়ের পাহাড় এবং অন্যান্য জায়গায় বেড়াতে যাই। এ সময় আমাদের হালিশহরের বাড়িতেও তারা বেড়াতে আসেন।’
মানিক চৌধুরীর বাসায় : আগরতলা মামলার আসামি খ্যাত ভূপতি ভূষণ চৌধুরী ওরফে মানিক চৌধুরীর বাড়ি ছিল চট্টগ্রাম শহরের আছদগঞ্জ এলাকার রামজয় মহাজন লেনে। গ্রামের বাড়ি পটিয়া উপজেলার হাবিলাসদ্বীপ। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত সম্পর্কের সূত্র ধরে তাঁর আছদগঞ্জের বাসায় একাধিকবার এসেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। একবার বেগম মুজিব এবং শেখ হাসিনাও (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধুকন্যা) এসেছিলেন বলে জানিয়েছেন মানিক চৌধুরীর স্ত্রী সবিতা চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে (আছদগঞ্জে) তখনও এই দালান ওঠেনি। নিচে একতলা ঘর এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল। সে সময় শেখ সাহেব মাঝে মাঝে আসতেন এখানে। উনিও (মানিক চৌধুরী) শুনতাম ঢাকায় যেতেন, শেখ সাহেবের বাসায় যেতেন। কি করেন, কোথায় যান জানতে চাইলে বলতেন, “ওইসব তোমাদের জেনে লাভ নেই। তুমি ছেলের পড়াশোনা দেখ”। একবার বেগম মুজিব এবং তাঁর মেয়ে শেখ হাসিনাও আমাদের বাসায় এসেছিলেন বেড়াতে। তখন বুঝেছি শেখ সাহেব এবং তাঁর পরিবারের সঙ্গে ওর কত ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল।’
তথ্যসূত্র: এক. এক দফার প্রবক্তা এম এ আজিজ স্মারকগ্রন্থ, সম্পাদনা-শরীফ শমশির, ২. বঙ্গবন্ধু কোষ সম্পাদনা-অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, ৩. লেখকের সঙ্গে সাক্ষাৎকার

লেখক: সম্পাদক- ইতিহাসের খসড়া, ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণাকর্মী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধজলবায়ু পরিবর্তন রোধে পূর্বা’র আর্থ ওয়ার্ক ক্যাম্পেইন