২৮০ টাকার বেডশিট কেনা হলো ৭০০ টাকায়

চসিকের আইসোলেশন সেন্টারে বাড়তি দামে পণ্য ক্রয়সহ নানা অসঙ্গতি

আজাদী প্রতিবেদন | সোমবার , ৫ অক্টোবর, ২০২০ at ৫:৩৯ পূর্বাহ্ণ

বাজারে ডিজিটাল থার্মোমিটার বিক্রি হয় ৩৫০ টাকায়। অথচ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন আইসোলেশন সেন্টারের জন্য কেনা হয়েছে ৭০০ টাকায়। একইভাবে আইসোলেশন সেন্টারটির জন্য ২৮০ টাকার বেডশিট ৭০০ টাকায়, ৩৫০ টাকার রাবার শিট এক হাজার ২০০ টাকায়, ৯৫০ টাকার হ্যান্ড গ্লাভস এক হাজার ৮০০ টাকায় এবং ৪০ টাকার মগ কেনা হয়েছে ১৫০ টাকায়। বাড়তি দামে এসব পণ্য কেনা হয়েছে ‘মেসার্স এবি কর্পোরেশন’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান থেকে। দুই লটে প্রতিষ্ঠানটি ৭১ লাখ ৭১ হাজার ৪০০ টাকার মালামাল সরবরাহ করে। যদিও এবি কর্পোরেশন থেকে মালামাল সংগ্রহের পূর্বে ‘তাজ সার্জিকাল মার্ট’ নামে অন্য একটি প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্যের দর সংগ্রহ করেছিল চসিকের ‘কন্ট্রোলার অব স্টোরস’ এর দপ্তর। ‘তাজ সার্জিকাল মার্ট’ ডিজিটাল থার্মোমিটার, বেডশিট, হ্যান্ড গ্লাভস এবং মগসহ অন্যান্য পণ্যের দামের কোটেশন দিয়েছিল এবি কর্পোরেশনের চেয়ে অর্ধেক দামে।
আইসোলেশন সেন্টারের যন্ত্রপাতি ক্রয়, বিতরণ ও স্থাপনে অনিয়ম অনুসন্ধানে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বাড়তি দামে কেনাকাটার এ তথ্য ওঠে এসেছে। তদন্ত কমিটির আহবায়ক সুমন বড়ুয়া গতকাল রোববার চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজনের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন। এতে ১৭টি পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ করা হয়। প্রতিবেদন পর্যালোচনায় জানা গেছে, পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধি বা পিপিআর-২০০৮ এর সরাসরি ক্রয় পদ্ধতি অনুসরণ করেই আইসোলেশন সেন্টারের জন্য মালামাল কেনা হয়েছে। করোনা পরিস্থিতিতে জরুরি অবস্থা বিবেচনায় পদ্ধতিটি অনুসরণের কথা বলা হলেও বাস্তবে পছন্দ অনুযায়ী একক দরদাতা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বাছাই করা হয়েছে। এক্ষেত্রে একই প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও পিপিআর-২০০৮ এর সুবিধা নেয়ার জন্য একাধিক লটে কার্যাদেশ দেয়া হয়। অথচ বাজার দর যাচাই কমিটির মাধ্যমে দরপত্র মূল্যায়ন করা হলে ক্রয় প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা থাকত। এছাড়া একাধিক প্রতিষ্ঠান থেকে কোটেশন সংগ্রহ বা সর্বনিম্ন দরদাতা নিশ্চিতকরণের বিষয়টি অনুসরণ করলে ক্রয় প্রক্রিয়া আরো স্বচ্ছ হতো বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, করোনাভাইরাসে সংক্রমিতদের চিকিৎসায় আগ্রাবাদ এঙেস রোডস্থ ‘সিটি কনভেনশন হল’ নামে কমিউনিটি সেন্টারে ২৫০ শয্যার আইসোলেশন সেন্টারটি গড়ে তোলে সিটি কর্পোরেশন। গত ১৩ জুন তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এটি উদ্বোধন করেন। ১০ আগস্ট সর্বশেষ সেখানে ৪ জন রোগী ভর্তি হন। কোয়ারেন্টাইন সেন্টার করার জন্য আইসোলেশন সেন্টারটি ২৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরআগে ১৫৯ জন করোনা রোগী চিকিৎসা নেন সেখানে। এরমধ্যে ১২৯ জন ভর্তি হন এবং ৩০ জন বর্হিবিভাগে চিকিৎসা নেন। ২৫০ শয্যার হাসপাতাল হলেও গত ২৮ জুন একদিনে সর্বোচ্চ ৩০ জন রোগী ভর্তি হয়েছিল। সেন্টারটিতে ১৬ জন চিকিৎসকসহ ৯৭ জন কর্মরত ছিলেন, যাদের বিভিন্ন বিভাগ থেকে পদায়ন করা হয়।
আইসোলেশন সেন্টারের যন্ত্রপাতি ক্রয়, বিতরণ ও স্থাপনে অনিয়ম অনুসন্ধানে প্রশাসকের নির্দেশে গত ১৮ আগস্ট চসিকের প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা সুমন বড়ুয়াকে আহবায়ক, হিসাবরক্ষক মাসুদুল ইসলামকে সদস্য সচিব ও প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা সেলিম আকতার চৌধুরীকে সদস্য করে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি সিটি কর্পোরেশনের ১৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারির সাক্ষাৎকার নেয়।
তদন্ত কমিটির আহবায়ক সুমন বড়ুয়া দৈনিক আজাদীকে বলেন, প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। তদন্তে কিছু প্রক্রিয়াগত ত্রুটি চিহ্নিত করেছি, সেগুলোসহ আমাদের পর্যবেক্ষণ এবং সুপারিশ রয়েছে প্রতিবেদনে। বিষয়টি নিশ্চিত করে প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘যে সব অনিয়ম চিহ্নিত হয়েছে তার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে ’।
আইসোলেশন সেন্টারের খরচ : আইসোলেশন সেন্টারটিতে মোট খরচ হয়েছে ১ কোটি ২৭ লাখ ৬ হাজার ৪৪৭ টাকা। এর মধ্যে ৭১ লাখ ৭১ হাজার ৪০০ টাকায় বিভিন্ন সরঞ্জাম কেনা হয়েছে। এছাড়া ৮ লাখ ৪৮ হাজার টাকায় মাস্ক, ৩ লাখ ৭ হাজার ২৫০ টাকা স্মার্ট সু বঙ কেনা হয়েছে। রিনোভেশন (ভৌত উন্নয়ন কাজ) খাতে ২৬ লাখ ৬১ হাজার ৯৯৯ টাকা, ওষুধ ক্রয়সহ অন্যান্য খাতে ২ লাখ ৩৭ হাজার ৫৫০ টাকা, এসি ও আনুসাঙ্গিক বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম বাবদ ১ লাখ ৭৯ হাজার ৯৫৩ টাকা, নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেট সংযোজন, সাউন্ড সিস্টেম ও টেলিভিশন ক্রয় খাতে ৭ লাখ ২২ হাজার ৩০০ টাকা এবং খাবার, আবাসন ও স্টেশনারি মালামাল খাতে ৯ লাখ ৭৭ হাজার ৯৯৫ টাকা খরচ হয়েছে।
খাতগুলোর বাইরেও নথি অনুমোদন ছাড়াই এবং কার্যাদেশ ব্যতীত কিছু মালামাল সরবরাহ করা হয়েছে। এ ক্রয় প্রক্রিয়া গ্রহণযোগ্য নয় উল্লেখ করে পর্যবেক্ষণে বলা হয়, এভাবে সরবরাহ নেয়া সমীচীন হয়নি।
ক্রয় প্রসঙ্গে কমিটির পর্যবেক্ষণ : প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘এবি কর্পোরেশনকে সম্পূর্ণ মালামাল সরবরাহের কার্যাদেশ না দিয়ে সর্বনিম্ন দর সম্পন্ন মালামাল সরবরাহের জন্য উভয় প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দিলে অর্থের সাশ্রয় হত। হালনাগাদ বাজার দর যাচাই কমিটির মাধ্যমে মালামালগুলোর বাজার দর ও মান যাচাই করা গেলে আর্থিক দিকটি আরো সুক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করা যেত।’ এছাড়া এবি কর্পোরেশন থেকে মালামাল দুই লটে কেনার বিষয়টি কেবল সরাসরি ক্রয় পদ্ধতি অনুসরণ করার জন্য করা হয়েছে মনে করেছে কমিটি।
স্যানিটাইজিং সামগ্রীর দর চেয়ে ২ জুন ‘তাজ সার্জিকাল মার্ট’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটি ৩ জুন চসিককে কোটেশন দেয় এবং এর উপর প্রাক্কলন তৈরি হয়। অথচ ২ জুন এবি কর্পোরেশনকে ‘নোয়া’ দেয়া হয়েছিল মালামাল সরবরাহে। এক্ষেত্রে ক্রয় প্রক্রিয়াটি আরো সুচারুভাবে করা সমীচীন ছিল বলে মনে করেছে তদন্ত কমিটি।
প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, চসিক কর্তৃক তাজ সার্জিকেল মার্টকে মালামাল সরবরাহ ও দর প্রদানের জন্য প্রেরিত পত্রে মালামালের স্পেসিফিকেশন সুষ্পষ্টভাবে উল্লেখ ছিল না। যা পিপিআর এর সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। অথচ পণ্য ক্রয়ের স্পেসিফিকেশন সুস্পষ্ট হওয়া বাঞ্চনীয়। এতে ক্রয় প্রক্রিয়ায় দ্রব্যের গুণগত মান ও বাজার দর নিশ্চিত পূর্বক স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়।
কার্যাদেশ ছাড়াই ক্রয় : এন. মোহাম্মদ প্ল্যাস্টিক থেকে ৩ লাখ ৭ হাজার ২৫০ টাকার পণ্য ক্রয় করা হয়। এর মধ্যে দুইটি লটে প্রতিটি ২ হাজার ৪৫৮ টাকায় ২৫০ পিচ স্মার্ট সু বঙ ক্রয় কার্যাদেশ বলে তদন্ত কমিটির কাছে দাবিও করে চসিকের কন্ট্রোলার অব স্টোরস। অথচ মাত্র ১২৫ পিচের কার্যাদেশের কপি দেখাতে পেরেছে তদন্ত কমিটিকে। এক্ষেত্রে কমিটি মনে করে, একই ধরণের দ্রব্য দুই লটে বিভক্ত করে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতি অনুসরণ করে একক দরদাতার মাধ্যমে ক্রয় করা হয়েছে।
অনভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠান থেকে ক্রয় : আলিফ অ্যাড ব্যাংক থেকে ২ লাখ ৬৪ হাজার টাকা এবং গ্লামার কিডস থেকে ১ লাখ ৮৪ হাজার টাকার পণ্য কেনা হয়েছে। এরমধ্যে আলিফ অ্যাড ব্যাংক থেকে প্রতিটি ৮৮ টাকা দরে তিন হাজার পিচ ‘কেএন-৯৫ মাস্ক’ এবং গ্লামার কিডস থেকে প্রতিটি ৯২০ টাকা দরে ২০০ পিচ এন-৯৫ মাস্ক কেনা হয়। যদিও প্রতিষ্ঠানগুলোর পূর্বে এ ধরনের পণ্য সরবরাহ, বিক্রি, আমদানি বা উৎপাদনের পূর্ব অভিজ্ঞতার তথ্য পায়নি তদন্ত কমিটি। এছাড়া এন-৯৫ মাস্ক ক্রয়ের কার্যাদেশে বিভিন্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সরবরাহের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়।
অন্যান্য : গত ১ জুন সাবেক মেয়র আ.জ.ম. নাছির উদ্দীনের সভাপতিত্বে প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তাসহ অন্যান্য কর্মকর্তাদের সভায় আইসোলেশন সেন্টার স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। যদিও এ বিষয়ে লিখিত কোন রেজুলেশন পায়নি তদন্ত কমিটি।
তদন্ত প্রতিবেদনে নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেট সংযোগ, সাউন্ড সিস্টেম স্থাপন ও টেলিভিশন ক্রয়ের বিষয়ে একই প্রতিষ্ঠানকে একই তারিখে আলাদা ফাইলে কার্যাদেশ দেয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়।
এছাড়া কার্যাদেশ অনুযায়ী অঙিজেন সিলিন্ডার ক্রয় করা হয়েছে ৫৩ টি। কিন্তু কমিটি পেয়েছে ৫০টি। ১০টি ওয়াকিটোকি কেনা হলেও তা আইসোলেশন সেন্টারের মালামালের ইনভেন্টরি বিবরণীতে ছিল না।
কমিটি চসিকের দামপাড়া স্টোরের স্টক রেজিস্টার এবং আইসোলেশন সেন্টারের স্টক রেজিস্টার পর্যবেক্ষণ করে, ক্রয়কৃত বা সরবরাহকৃত মালামালের হিসাব সংরক্ষণের বিষয়টি অগোছালো দেখতে পায়। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় স্টক রেজিস্টার, ইস্যু রেজিস্টার এবং আইসোলেশন সেন্টারের স্টক রেজিস্টারের মধ্যে অসংগতি লক্ষ্য করে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজরিমানার পরেও থেমে নেই সাগরপাড়ে বর্জ্য নিকাশ!
পরবর্তী নিবন্ধমণ্ডপ সংখ্যা সীমিত, প্রতিমা বিসর্জনে শোভাযাত্রা করা যাবে না