২১ আগস্ট : ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা

শঙ্কর প্রসাদ দে | রবিবার , ২১ আগস্ট, ২০২২ at ৪:৫৭ পূর্বাহ্ণ

দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলা ও সিলেটে ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর উপর বোমা হামলার প্রতিবাদে মুক্তাঙ্গনে প্রতিবাদ সভার আয়োজন করা হয়েছিল। টকশোতে আমির হোসেন আমু ভাইয়ের বক্তব্য মতে পুলিশ বলেছে এরকম খোলামেলা জায়গায় বিদ্যমান পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব নয়। তিনি বিষয়টি নেত্রী শেখ হাসিনাকে জানালে নেত্রী নির্দেশ দিলেন, বঙ্গবন্ধু এভেনিউতে সব সময় যেভাবে করি, ওভাবে একটা ট্রাকের ব্যবস্থা করে মিটিংয়ের আয়োজন করো। ধারণা করা হচ্ছে, দালানের উপর থেকে গ্রেনেড মারার সুযোগ দেয়ার জন্য মিটিং বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে সরিয়ে আনতে বাধ্য করা হয়েছিল।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলার বিচার সমাপ্ত হওয়ায় মোটামুটি তথ্য জাতির সামনে উঠে এসেছে। মৃত্যুদণ্ড সাজা প্রাপ্ত ১৯ জনের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নাম হলো (১) লুৎফুজ্জামান বাবর (স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী), (২) উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, (৩) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী (ডি জি এফ আইয়ের মহাপরিচালক) (৪) বি: আবদুর রউফ (এনএসআই মহাপরিচালক)।
আজীবন সাজাপ্রাপ্ত ১৯ জনের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা হলো (১) তারেক রহমান (প্রধানমন্ত্রীর পুত্র) (২) হারিছ চৌধুরী (প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা) (৩) কাজী শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন কায়কোবাদ (প্রতিমন্ত্রী) (৪) মে: জে: এটিএম আমিন (ডিজি আনসার ও ভিডিপি) তিন আই জিপি (৫) মো: আশরাফুল হুদা, (৬) শহুদুল হক (৭) খোদাবকস্‌ চৌধুরী।
দেশের একজন সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন জাগাই স্বাভাবিক যে এতগুলো রাষ্ট্রীয় সংস্থার অধিকারিকরা কেউ কেউ পরিকল্পনায় ছিলেন এবং কেউ কেউ ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর ধামাচাপা দিতে চেয়েছিলেন কি না? অবশ্যই জানতেন এবং আষাঢ়ে গল্প জজ মিয়া নাটক সাজাতে গিয়ে এরা ধরা পড়েছিল সাংবাদিকদের অনঢ় অবস্থান ও সত্য উদঘাটনের নিরলস প্রচেষ্টার কারণে। বিচারক শাহেদ নুরুদ্দীন আসামীর আইনজীবীদের কাছে দু’টো প্রশ্ন করেছিলেন। (১) পুলিশ প্রশাসন জজ মিয়া নাটক সাজাতে গেল কেন? এর উত্তর আসামীপক্ষ দিতে পারেনি। এর পর প্রশ্ন করেছিলেন (২) অবিস্ফোরিত গ্রেনেডগুলো ছিল আদালতের আলামত। পুলিশ ছিল শুধু মালখানার হেফাজতকারী। এই গ্রেনেডগুলো আদালতের বিনাঅনুমতিতে ধ্বংস করা হলো কেন এবং কে কে দায়ী? এই প্রশ্নের উত্তর আসামী পক্ষ দিতে পারেনি। স্বাভাবিকভাবে ৩ (তিন) পুলিশ প্রধান, ডিজিএফআই, এসএসআই ও ডিজিকে (আনসার ভিডিপি) সাজা দেওয়া ছাড়া আদালতের হাতে বিকল্প ছিল না।

প্রিয় পাঠক, এবার ভেবে দেখুন চারদলীয় সরকার এদেশের মাটি থেকে মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও জয় বাংলার প্রতীক শেখ হাসিনা ও গোটা আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে চিরতরে ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল। এই বিন্দুতে দাঁড়িয়ে আজকের এবং ভবিষ্যতের রাজনৈতিক গতিধারা বুঝতে হবে। বিএনপি-জামায়াত-জঙ্গিদের রাজনীতি হলো রক্ষণশীল ইসলামী বাংলাদেশ, জিন্দাবাদের রাজনীতি। দ্বিজাতিতত্ত্ব ভিত্তিক এই রাজনীতিকে মৃত্যুপথযাত্রী করা হয়েছিল ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড ও ৭ নভেম্বর ঘটনার মধ্য দিয়ে জিয়া মৃত্যুর মুখ থেকে দ্বিজাতিতত্ত্বকে বাংলায় জীবন দিলেন। জিয়া এই রাজনীতিকে পুনর্বাসনও করলেন। ওরাও পাকিস্তানী বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা শুরু করল। বেগম জিয়া ২০০১ সালে বিজয়ী হয়ে আওয়ামীলীগ বিশেষত; হিন্দুদের উপর অকথ্য নির্যাতন করে ভারতকে বুঝিয়ে দিলেন, এদেশকে পাকিস্তানী বাংলাদেশ বানানো হবেই।
এখন অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে। (১) এদেশে যে দল মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ধর্ম নিরপেক্ষতা ও জয় বাংলা গঠনতান্ত্রিকভাবে স্বীকার করবে না, তার বা তাদের কি এদেশে রাজনীতি করার সুযোগ আছে? চীন, বৃটেন, আমেরিকা, সৌদি আরবের সংবিধান না মানলে কোনো রাজনৈতিক অধিকার ঐসব দেশে দেয়া হয় না। ব্রিটেনের রানীকে অস্বীকার করলে ঐ দেশে রাজনীতি করার প্রশ্নই উঠবে না। আমার সোজা কথা, জাতির পিতা হিসাবে যে দল ধর্ম নিরপেক্ষতা ও বঙ্গবন্ধুকে গঠনতন্ত্রে স্থান দেবে না, এদেশে রাজনীতি করার অধিকার সে দলের থাকা উচিত নয়।
অনেকে বলছেন আওয়ামীলীগ এবং বিএনপি’র মধ্যে আলোচনা হওয়া উচিত। আমরা অনেকেই মনে করি, কয়েকটি বিষয় সমাধা না হওয়া পর্যন্ত এমন আলোচনা অর্থহীন এবং অসম্ভবও বটে। প্রশ্ন করি, বেগম জিয়া-তারেক-বাবর পার্থ সাহা নামক এক নিরীহ ছাত্রকে জড়িয়ে গ্রেনেড হামলায় ভারতীয় ডাইমেনশন দিতে চেয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত; প্রশ্ন করি, বিচারপতি জয়নাল আবেদীনকে দিয়ে বলানো হল পার্শ্ববর্তী প্রভাবশালী দেশের (ভারতের‘র’) গোয়েন্দা সংস্থা এতে জড়িত। একাত্তরে পাকিস্তানী বন্দুকের গুতো থেকে বাঁচার জন্য জিয়া প্রাণে বেঁচেছিলেন, ভারতে আশ্রয় নিয়ে। এই জিয়া-বেগম জিয়াই মসনদ ঠিক রাখার জন্য ইসলামকে ব্যবহার আর ভারত এক নাম্বার শত্রু বলে অনবরত বলে চলেছেন।
সরাসরি বলি, এদেশের মুক্তিযুদ্ধ, বিজয় অর্জন, দেশ পুনর্গঠন, পেঁয়াজ, ডাল, কাপড় সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যগুলোর জন্য, ছিটমহল সমস্যার সমাধান, জরুরি চিকিৎসা সামগ্রী (এ্যাম্বুলেন্স সহ), চিকিৎসা সহ জীবনের বহু প্রয়োজনের জন্য ভারত আমাদের নিকটতম ঠিকানা ও ভরসারস্থল। আমার দু’জন জামাত বন্ধু মাদ্রাজে না গেলে এতোদিনে হয়তো কবরে থাকতেন। ভারতেরও আমাদের প্রয়োজন। যেমন আমাদের বন্দর ও সড়ক ব্যবহার করে ভারতের সেডেন সিস্টার এখন অনেকটা স্বচ্ছন্দ। আপনারা শয়নে স্বপ্নে জাগরণে শুধু ভারত বিরোধিতায় মগ্ন থাকবেন আর সুযোগ পেলেই হিন্দুদের দেশ ছাড়তে বাধ্য করবেন, তাহলে কেমনে আশা করেন আবার ক্ষমতায় আসবেন। পাকিস্তানী বাংলাদেশ বানানোর জন্য একাত্তরে আমরা যেমন যুদ্ধ করিনি তেমনি ভারতও সাহায্য করেনি।
রাজনীতি বড় নিষ্ঠুর খেলা। ক্ষমতার দ্বন্দ্ব তারচেয়েও ভয়াবহ। এটা মীর মোশাররফ হোসেনের কথা। এজন্যই বলি ২১ আগস্ট এ দেশের রাজনীতিতে মৌলিক প্রশ্নের উদ্ভব ঘটেছে। কেউ আমাকে মেরে ফেলার জন্য গ্রেনেড মারবে আর আমি তার সাথে ফলপ্রসূ আলোচনায় বসবো- ব্যক্তি জীবনে কোথাও কি এমন কল্পনা করা যায়। আওয়ামীলীগ বিএনপি’র কেন্দ্রীয় কমিটি ধ্বংসের জন্য গ্রেনেড মারতো, তবে বিএনপি কি আলোচনায় বসতো? এ জন্যই বলছিলাম, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মধ্য দিয়ে এদেশের রাজনীতির সমস্ত দরজা জানালা বন্ধ হয়ে গেছে। আজকের বিএনপি নেতৃত্ব যে এটা বুঝেন না, তা নয়। বুঝেন এবং ভেতরে ভেতরে জ্বলে পুড়ে হচ্ছেন ছাড়খার।
লেখক: আইনজীবী, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধফকির জামাল : ’৭১-এর গেরিলা, ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদী
পরবর্তী নিবন্ধসু চির সঙ্গে আলোচনায় রাজি মিয়ানমারের সেনাপ্রধান