পবিত্র হজ পালন সম্পর্কে ইসলামের দিক নির্দেশনা

ফখরুল ইসলাম নোমানী | বৃহস্পতিবার , ২৩ মে, ২০২৪ at ৮:৫৭ পূর্বাহ্ণ

লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক। লাব্বাইক লা শারিকা লাকা লাব্বাইক। ইন্নাল হামদা ওয়াননিমাতা লাকা ওয়ালমুলক লা শারিকা লাক”। হজ ইসলামের মৌলিক পাঁচ ভিত্তির অন্যতম। শারীরিক ও আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান নারীপুরুষের ওপর হজ ফরজ। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে আল্লাহর তরফ থেকে সেসব মানুষের জন্য হজ ফরজ যারা তা আদায়ের সামর্থ্য রাখে (সুরা আলে ইমরান ; আয়াত : ৯৭)। হজের সফর দোয়া কবুলের অপূর্ব সুযোগ। হজ বা ওমরাহর জন্য ইহরামের নিয়ত করা থেকে দোয়া কবুল হওয়া শুরু হয়। হজের সফরে এমন কিছু সময় ও স্থান রয়েছে যে সময় ও স্থানে দোয়া কবুল হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল যে স্থানগুলোতে নবীরাসুলদের দোয়া কবুল হয়েছিল বলে বর্ণিত আছে। সেসব জায়গায় দোয়া করা বাঞ্ছনীয়। পবিত্র মক্কামদিনার বিভিন্ন জায়গায় দোয়া কবুল হয়ে থাকে। হজের ফরজ কাজ তিনটি. ইহরাম বাঁধা ২. আরাফাতে অবস্থান ৩. তাওয়াফে জিয়ারাহ করা। মনে রাখতে হবে এই তিনটির কোনো একটি ছুটে গেলে হজ হবে না। হজের ওয়াজিব কাজ পাঁচটি. সাফামারওয়ায় সাঈ করা ২. মুজদালিফায় রাত যাপন বা অবস্থান করা ৩. জামরায় কঙ্কর মারা ৪, কোরবানি করা ও ৫. বিদায়ী তাওয়াফ করা। এগুলোর কোনো একটি ছুটে গেলে তাকে দম দিতে হবে। মূল হজের পাঁচ দিন : . হজের প্রথম দিন ৮ জিলহজ : মক্কা থেকে ইহরাম বেঁধে মিনায় যাওয়া এবং ৮ জিলহজ সেখানে অবস্থান করা। ২. হজের দ্বিতীয় দিন ৯ জিলহজ : ফজরের নামাজ মিনায় পড়ে আরাফাতের ময়দানে রওনা হওয়া। সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাত ময়দানে অবস্থান। (হজের দ্বিতীয় ফরজ) প্রথম ফরজ তো আমরা নির্দিষ্ট মিকাত থেকে ইহরাম বেঁধে পালন করব। আরাফাতের দিনকেই মূল হজ বলা হয়। আরাফাত থেকে সূর্যাস্তের পর মাগরিব নামাজ না পড়ে মুজদালিফায় রওনা করতে হবে। সেখানে তারতিব ঠিক রেখে মাগরিব ও এশার নামাজ পড়ে সুবিধামতো স্থানে বিছানা পেতে ঘুমিয়ে পড়তে হবে। ইচ্ছে করলে এখান থেকে ৭০টি কঙ্কর সংগ্রহ করা যাবে। ফজরের নামাজ আদায় করবেন। সূর্যোদয় পর্যন্ত কিবলামুখী হয়ে দোয়া করতে হবে। হজের তৃতীয় দিন ১০ জিলহজ : এই দিনটি খুবই কঠিন ও পরিশ্রমের। এ দিনের কাজগুলো নিম্নরূপ : মুজদালিফা থেকে মিনায় ফিরে আসা শুধু বড় জামরায় সাতটি কঙ্কর মারা, কোরবানি করা, চুল কাটা, মক্কায় গিয়ে তাওয়াফ ও সাঈ করা (হজের তৃতীয় ও শেষ ফরজ), মক্কা থেকে আবার মিনায় চলে আসা। মুজদালিফা থেকে মিনায় পৌঁছানোর পর তালবিয়া পাঠ বন্ধ করে দিতে হবে। সূর্য হেলার আগে বড় জামরায় সাতটি কঙ্কর মারতে হবে। কোরবানি করবেন। এরপর হজের তৃতীয় ও শেষ ফরজ তাওয়াফে জিয়ারাত বা বিদায়ী তাওয়াফ করা এবং মাথা মুন করা। তারপর মিনায় ফিরে যাবেন। হজের চতুর্থ দিন ১১ জিলহজ : মিনায় অবস্থান। সূর্য হেলার পর তিনটি জামরায় সাতটি করে ২১টি পাথর মারা। প্রথমে ছোট জামরায় পরে মধ্যম জামরায় শেষে বড় জামরায়। সূর্য ডোবার আগে পাথর মারা শেষ করে মিনার তাঁবুতে চলে যাওয়া। হজের পঞ্চম দিন ১২ জিলহজ : মিনায় সর্বশেষ অবস্থান। সূর্য হেলার পর আগের নিয়মে সাতটি করে ২১টি পাথর নিক্ষেপ করা এবং সূর্যাস্তের আগেই মিনা ত্যাগ করে মক্কায় চলে আসা। সূর্যাস্তের আগে যদি মিনা ত্যাগ না করা যায় তবে ১৩ জিলহজ মিনায় অবস্থান করে ১২ জিলহজের মতো আবার ২১টি কঙ্কর মারতে হবে।

বিদায়ী তাওয়াফ : যেদিন দেশে ফিরে যাবেন বা মদিনায় চলে যাবেন মক্কায় আর ফিরে আসবেন না সেদিন সুবিধামতো সময়ে বিদায়ী তাওয়াফ করা। বিদায়ী তাওয়াফ সাধারণ পোশাকে হবে। এ তাওয়াফে রমল, ইজতিবা ও সাঈ নেই। হজের কিছু পরিভাষা :

ইহরাম : প্রয়োজনীয় শারীরিক পরিষ্কারপরিচ্ছন্নতার পর গোসল করে মিকাতের আগে তথা বিমানে উঠার আগে দুই টুকরা সেলাইবিহীন কাপড় পরিধান করে মিকাত থেকে উমরার নিয়ত করা। এটি হজের প্রথম ফরজ। আর তখন থেকেই তালবিয়া পাঠ করা।

মিকাত : মিকাত অর্থ নিদিষ্ট সময় বা সময়সূচি। হজের পরিভাষায় এমন এক নির্দিষ্ট স্থানকে মিকাত বলে, যেখান থেকে বা যে স্থান অতিক্রম করার আগে হজ বা উমরার জন্য ইহরাম বাঁধতে হয়। এ রকম স্থান পাঁচটি।

তালবিয়া : লাব্বায়িক আল্লাহুম্মা লাব্বায়িক লাব্বায়িকা লা শারিকা লাকা লাব্বায়িক ইন্নাল হামদা ওয়ান নিয়ামাতা লাকা ওয়াল মুলক লা শারিকা লাক। অর্থাৎউপস্থিত, উপস্থিত হে আল্লাহ! তোমার কোনো শরিক নেই, আমি হাজির। নিশ্চয়ই সমস্ত প্রশংসা ও নিয়ামত তোমারই এবং রাজত্বও। তোমার কোনো শরিক নেই।

তাওয়াফ : তাওয়াফ মানে জিয়ারত বা চক্কর দেয়া। অর্থাৎ বায়তুল্লাহর চারদিকে চক্কর দেয়া। ফরজ, ওয়াজিব ও নফল তাওয়াফ রয়েছে। আল কুরআনে বলা হয়েছেএবং ইবরাহিম ও ইসমাঈলকে দায়িত্ব দিলাম যে তোমরা আমার ঘর পবিত্র করো তাওয়াফকারী ও ইতিকাফকারীদের জন্য। (সূরা বাকারা : ১২৫)

রমল : রমল শুরু হয় সপ্তম হিজরিতে। রাসূলুল্লাহ সা. ষষ্ঠ হিজরিতে হুদায়বিয়া থেকে ফিরে যান উমরাহ আদায় না করেই। হু রামল মানে বুকটান করে দৌড়ানো। আমাদের দেশের সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজের মতো ছোট ছোট কদমে গা হেলিয়ে বুক টান করে দৌড়ানো। তাওয়াফে এই রমল করতে হয়। উদ্দেশ্য মুমিন কখনো দুর্বল হয় না মুমিন কখনো হতোদ্যম হয় না এটি দেখানো। রোগশোক সব কিছুকে চাপিয়ে তারা সামনের দিকে এগিয়ে যায়। এর সাথে ইজতিবা নামে আরেকটি পরিভাষা আছে। মানে চাঁদরখানা ডান বগলের নিচে দিয়ে বীরের বেশে তাওয়াফ করা।

সাফামারওয়া পাহাড় ও সাঈ : কাবার দক্ষিণপূর্ব কোণে একেবারেই কাছাকাছি ছোট্ট একটি পাহাড়ের নাম সাফা এবং কাবার অনতিদূরে উত্তরপূর্ব কোণে মারওয়া পাহাড়। এটিও খুবই ছোট্ট একটি পাহাড়। এ দু’টি পাহাড়ের মধ্যে মা হাজেরা তার দুগ্ধপায়ী সন্তান ইসমাইল আ:-এর জান বাঁচানোর জন্য ছোটাছুটি করেছিলেন। আল্লাহ তার মেহমানদের জন্য এই দু’টি পাহাড়ের মধ্যে দৌড়ানোকে বৈধ করে দিলেন। এই ছোটাছুটির নামই হলো সাঈ।

হাজরে আসওয়াদ বা কালো পাথর : পবিত্র কাবার দক্ষিণ কোণে জমিন থেকে ১.১০ মিটার উচ্চতায় স্থাপিত হাজরে আসওয়াদ। এটি জান্নাত থেকে নেমে আসা একটি পাথর। শুরুতে যার রং ছিল দুধের বা বরফের মতো সাদা। পরে আদম সন্তানদের পাপ তাকে কালো করে দেয়। হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করলে গুনাহ মাফ হয়। হাজরে আসওয়াদের কোণ থেকে আল্লাহু আকবার বলে তাওয়াফ শুরু করতে হয়। স্পর্শ করা সম্ভব না হলে ইশারা করলেও চলবে।

রিয়াজুল জান্নাত অর্থ বেহেস্তের টুকরাতে দোয়া করা : মা আয়েশার ঘর থেকে মসজিদে নববির মিম্বর এর মধ্যস্থিত স্থান। মসজিদে নববির যে অংশ টুকুতে সবুজ রং এর কার্পেট বিছানো আছে। রসূল (.) এর রওজা ও মিম্বর এর মাঝে একটি জায়গা রয়েছে। যার নাম রিয়াজুল জান্নাহ। অর্থাতবেহেশতের টুকরা। সেখানে নামাজ পড়া অনেক সৌভাগ্যের বিষয়। মসজিদে নববীতে ৮ দিনে মোট ৪০ ওয়াক্ত নামাজ পড়া বিশেষ মর্যাদার। কেননা মসজিদে নববীতে এক রাকাআত নামাজ পড়া ৫০ হাজার রাকাআত নামাজ পড়ার সমান।

সুতরাং আল্লাহর দরবারে হজকে গ্রহণীয় আখেরাতের জীবনকে সফল ও জান্নাতের সব নেয়ামত ও কেয়ামতের হিসাব সহজ করতে সামর্থ্যবানদের উচিত একনিষ্ঠ নিয়তে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কুরআনসুন্নাহর দিকনির্দেশনা অনুযায়ী হজ করা। আল্লাহ আমাদের আজীবনের লালিত স্বপ্ন হজ তাঁর হুকুম ও রাসুলের সুন্নত অনুযায়ী যথাযথভাবে পালনের সামর্থ্য এবং এর শিক্ষা ও তাৎপর্য উপলব্ধি করে জীবন পরিচালনা করার তাওফিক দান করুন। হে আল্লাহ আমাদের সকলকে আপনার মকবুল বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করুন। আমিন।

লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধসৃষ্টি সুখের উল্লাসে কবি : স্মরণে শ্রদ্ধায়
পরবর্তী নিবন্ধড. মঈনুল ইসলামের কলাম