ড. মঈনুল ইসলামের কলাম

রাঘববোয়াল ঋণখেলাপিদেরকে শাস্তি না দিয়ে ব্যাংক একত্রিকরণ সুফল দেবে কি?

| বৃহস্পতিবার , ২৩ মে, ২০২৪ at ৮:৫৮ পূর্বাহ্ণ

সম্প্রতি পাঁচটি দুর্বল ব্যাংককে পাঁচটি বড় ব্যাংকের সাথে একত্রিকরণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রাইভেট খাতের এক্সিম ব্যাংক সবচেয়ে দুর্বল প্রাইভেট ব্যাংক পদ্মা ব্যাংককে অধিগ্রহণ করেছে সবার আগে, এরপর সিটি ব্যাংককে বেসিকের সাথে একীভূত করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। তারপর সোনালী ব্যাংক বিডিবিএলকে অধিগ্রহণ করার ঘোষণা এসেছিল, ১২ মে ২০২৪ তারিখে এই দুই ব্যাংক একীভূত হওয়ার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এরপর একীভূত হওয়ার ঘোষণা এসেছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের। এটা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। সবশেষে ঈদুল ফিতরের ছুটি শুরু হওয়ার আগের দিন একীভূত হওয়ার ঘোষণা এসেছিল প্রাইভেট ব্যাংক ইউসিবি ও ন্যাশনাল ব্যাংকের। কিন্তু, ন্যাশনাল ব্যাংকের নবগঠিত পর্ষদ এই একীভূতকরণের ঘোষণার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তারা নাকি ন্যাশনাল ব্যাংককে আবার নিজের পায়ে দাঁড় করাবে। এভাবে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে অপেক্ষাকৃত সবল ব্যাংকের সাথে একত্রিকরণের সিদ্ধান্ত ‘ভলান্টারি’ ছিল কিনা কিংবা কেন ও কী শর্তে গ্রহণ করা হয়েছিল তা এখনো জানা যায়নি। তবে, বাংলাদেশ ব্যাংক চাপ দিয়ে এই ব্যাংকগুলোকে মার্জরের দিকে ঠেলে দিয়েছে বলে যে অভিযোগ উঠেছে সেটা গুরুতর অভিযোগ। ‘মার্জার’ দুটো সংস্থার ‘ভলান্টারি’ বা স্বপ্রণোদিত সিদ্ধান্ত না হলে তা বুমেরাং হওয়ার আশংকাই বেশি থাকে। কিন্তু, সিদ্ধান্তগুলো বিশেষজ্ঞদের কিংবা ঐসব ব্যাংকের কর্মকর্তাকর্মচারীদের পছন্দসই হয়নি বোঝা যাচ্ছে। বেসিকের কর্মকর্তাকর্মচারীরা কোন বেসরকারী ব্যাংকের সাথে একীভূত হওয়ার পরিবর্তে অন্য কোন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের সাথে একীভূত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছেন। তাই বলা প্রয়োজন, পাঁচটি দুর্বল ব্যাংকের মধ্যে তিনটির ব্যাপারে একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া এগিয়ে যাওয়ার পর বোঝা যাবে একত্রিকরণের সিদ্ধান্ত সঠিক হয়েছে কিনা। আরো পাঁচটি দুর্বল ব্যাংককে ‘মার্জার’এ দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু এই সিদ্ধান্ত আপাতত স্থগিত করা হয়েছে। শর্তগুলো বিস্তারিত না জেনে বর্তমান পর্যায়ে মার্জারের সুফল এবং কুফল সম্পর্কে মন্তব্য করা সময়োচিত নাও হতে পারে। তবুও কয়েকটি মন্তব্য সমীচীন মনে করছি।

এক্সিম ব্যাংকের মালিক নজরুল ইসলাম মজুমদার ব্যাংকমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের সভাপতি। তাঁকে নাকি অন্য আরেকটি ব্যাংক অধিগ্রহণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে চাপ প্রদান করা হয়েছিল, কিন্তু তিনি নিজেই পদ্মা ব্যাংককে বেছে নিয়েছেন। এসিদ্ধান্তের পেছনে নিশ্চয়ই তাঁর কিছু হিসাবনিকাশ রয়েছে। অতএব, বিষয়ে বর্তমান পর্যায়ে কোন মন্তব্য করব না। সোনালী ব্যাংক এবং বিডিবিএল একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্তটি যৌক্তিক। এখন দীর্ঘমেয়াদী শিল্পঋণ দেওয়ার জন্য আলাদা ব্যাংক থাকার ভাল যুক্তি নেই, কারণ এদ্দিনে সব বাণিজ্যিক ব্যাংকই দীর্ঘমেয়াদী ঋণ দেওয়ায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। বিডিবিএল এর আগে দুটো শিল্পায়ন অর্থায়ন প্রতিষ্ঠান হিসেবে ধুঁকে ধুঁকে টিকে ছিল: একটি বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক, অপরটি বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা (বিএসআরএস)। চার দশক ধরে এই দুটো প্রতিষ্ঠান খেলাপিঋণে জর্জরিত ছিল। পরবর্তীতে ওগুলোকে সাধারণ বাণিজ্যিক ব্যাংকে রূপান্তরিত করা হলেও ব্যর্থ হয়েছে ব্যাংকগুলো। বিডিবিএল এর খেলাপি ঋণগুলো দীর্ঘদিনের। এগুলো আদায় হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এত বেশি খেলাপিঋণের বোঝা সোনালী ব্যাংক কীভাবে সামলায় সেটা দেখার অপেক্ষায় রইলাম। কৃষি ব্যাংকের সাথে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের মার্জারও যৌক্তিক। আমার মতে আলাদা করে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্তটিই ভুল ছিল, কৃষি ব্যাংকের শাখা বাড়ানোর মাধ্যমে দেশের উত্তরাঞ্চলের আঞ্চলিক কৃষিঋণের চাহিদা পূরণের দায়িত্বটি পালন যথাযথ হতো। বেসিক অত্যন্ত ভাল একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ছিল, যার খেলাপিঋণের অনুপাত দেড় দশক আগেও ৩৪ শতাংশের বেশি ছিল না। কিন্তু, শেখ আবদুল হাই বাচ্চুকে এই ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে বহাল রেখে কয়েক বছর বেধড়ক্‌ লুটপাট করতে দিয়ে এই ব্যাংকটিকে ধ্বংস করেছে বর্তমান সরকার। বহুদিন পর অবশেষে আবদুল হাই বাচ্চুকে অপসারণ করে তাঁর পরিবর্তে ওখানে জনাব আলাউদ্দিন মজিদকে চেয়ারম্যান করা হলেও ব্যাংকটিকে পতনের ধারা থেকে ফেরানো যায়নি। এখন এই ব্যাংকের খেলাপিঋণ ৬৮ শতাংশের বেশি। তাই, আলাদাভাবে এই ব্যাংকটি চালানো অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। অতএব, মার্জারের মাধ্যমে ব্যাংকটির অবসায়নের প্রক্রিয়া শুরু করা সময়োচিত সিদ্ধান্ত। তবে, সিটি ব্যাংক একটি প্রাইভেট ব্যাংক। একটি পতনোন্মুখ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের বোঝা তারা কীভাবে বহন করবে সেটা উদ্বেগের বিষয়। একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর ব্যাংকটির আমানত প্রত্যাহারের হিড়িক পড়েছে। আশংকার কারণ রয়েছে যে এর ফলে যে কোন সময় ব্যাংকের আমানতকারীদেরকে আমানত ফেরত দেওয়ার ব্যাপারে ব্যাংকটি ব্যর্থ হতে পারে। ন্যাশনাল ব্যাংক জন্মলগ্ন থেকেই লুটপাটের শিকার। অন্যতম ফার্স্টজেনারেশন প্রাইভেট ব্যাংক হিসাবে ১৯৮৩ সালে জন্ম গ্রহণের পর একসময়ের বড় প্রাইভেট ব্যাংক হিসেবে পরিচিত হলেও সিকদার পরিবারের দুই ভাই রণ হক সিকদার ও রিক হক সিকদারের হাতে পড়ার পর ব্যাংকটি লাটে ওঠার উপক্রম হয়েছে কয়েকবছর আগেই। (অবশ্য জনশ্রুতি রয়েছে যে প্রথম থেকেই বিভিন্ন নেতৃস্থানীয় ব্যবসায়ীর লুটপাটের শিকার হয়েছিল ব্যাংকটি)। এরকম একটি নিমজ্জমান প্রাইভেট ব্যাংককে উদ্ধার করতে গিয়ে ইউসিবি নিজেই সংকটাপন্ন হয়ে পড়ার আশংকা ছিল। ন্যাশনাল ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান নিজেই দেশের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যবসায়ীশিল্পপতি, যার প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা ন্যাশনাল ব্যাংক পেয়ে গেলে মুনাফাদায়ক হবে। তিনি ব্যাংকটিকে উদ্ধারের উদ্যোগ নেয়ায় ব্যাংকটি ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে। সেজন্য ন্যাশনাল ব্যাংকের বর্তমান সিদ্ধান্তটি শাপে বর হতে পারে।

যে কথাটি জোর দিয়ে বলা প্রয়োজন তাহলো, এই পাঁচটি দুর্বল ব্যাংককে বর্তমান অবস্থায় নিয়ে আসার জন্য যারা দায়ী তাদেরকে শাস্তির আওতায় না এনে ব্যাংকগুলোকে মার্জারের মাধ্যমে অন্য পাঁচটি ব্যাংকের অধিগ্রহণে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি একটি বড় ধরনের ‘মরাল হ্যাজার্ডের’ জন্ম দিচ্ছে। পদ্মা ব্যাংকের জন্ম হয়েছিল ফার্মার্স ব্যাংক হিসাবে, ওটার মূল উদ্যোক্তা ছিলেন আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী, এম পি এবং সরকারের সাবেক আমলা ডঃ মহিউদ্দিন খান আলমগীর। একটি নূতন ব্যাংকের লাইসেন্স নেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কুড়ি কোটি টাকা তাঁর সারা জীবনের বৈধ আয় থেকেও সংগ্রহ করা অসম্ভব। শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে তাঁকে হয়তো পুরস্কৃত করা হয়েছিল তাঁর ১৯৯৬ সালের ‘জনতার মঞ্চের’ ভূমিকার জন্য। কিন্তু, প্রথম থেকেই ফার্মার্স ব্যাংক লুটপাটের শিকার হয়ে লাটে ওঠার যোগাড় হওয়ায় পদ্মা ব্যাংক নাম দিয়ে ব্যাংকটিকে সরকার বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল। বোঝা যাচ্ছে, সরকারের ঐ প্রয়াস ফেল্‌ মেরেছে। কিন্তু, ডঃ মহিউদ্দিন খান আলমগীরের কি শাস্তি হয়েছে? এবার এমপি নমিনেশন না পেলেও তিনি তো বহাল তবিয়তেই রয়েছেন! বেসিকের আবদুল হাই বাচ্চুর বিরুদ্ধে শেষমেশ দুর্নীতি দমন কমিশন মামলা করেছে, তিনি নাকি এখন পলাতক। কিন্তু, কয়েকবছর আগেই তো বেসিককে ধ্বংস করে দিয়েছিল বাচ্চু। কই, তখন তো সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তাঁকে গ্রেফতার করা হয়নি। রণ হক সিকদার এবং রিক হক সিকদার বেশ কয়েক বছর আগেই বন্দুকের নল মাথায় ঠেকিয়ে এক্সিম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে ৫০০ কোটি টাকা ঋণ দিতে বাধ্য করার ঘটনায় হাতেনাতে ধরা পড়েছিল। ঐ ঘটনার জন্য তাদেরকে কি কোন শাস্তি পেতে হয়েছে?

আরো গুরুত্বপূর্ণ হলো, ব্যাংকিং খাতের সবচেয়ে পুরানো এবং সবচেয়ে মারাত্মক সমস্যা হচ্ছে খেলাপিঋণ সমস্যা। বর্তমানে দেশের প্রায় সাড়ে আঠারো লক্ষ কোটি টাকা প্রদত্ত ব্যাংকঋণের মধ্যে কমপক্ষে সাড়ে চার লক্ষ কোটি টাকা খেলাপিঋণে পরিণত হয়ে গেছে, কিন্তু নানা কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক তিন মাস পরপর প্রকাশিত ‘ক্লাসিফাইড লোনের’ হিসাবে মাত্র এক লক্ষ পঁয়তাল্লিশ হাজার কোটি টাকাকে ক্লাসিফাইড দেখানো হচ্ছে। বাকি খেলাপিঋণকে ‘টেকনিক্যাল কারণে’ হিসাবের বাইরে রাখতে হচ্ছে। এর মধ্যে আড়াই লক্ষ কোটি টাকার বেশি অর্থঋণ আদালত, হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ঝুলে থাকা মামলায় বছরের পর বছর আটকে থাকায় টেকনিক্যালি ওগুলোকে ‘ক্লাসিফাইড’ বলা যাচ্ছে না। এর সাথে যুক্ত হবে পঁয়ষট্টি হাজার কোটি টাকারও বেশি পাঁচ বছরের বেশি পুরানো ‘মন্দঋণ’, যেগুলোকে বিভিন্ন ব্যাংক ‘রাইট অফ্‌’ করে দেওয়ায় ওগুলোকেও আর বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক প্রকাশিত ‘ক্লাসিফাইড লোনে’ অন্তর্ভুক্ত করা যাচ্ছে না। এর পাশাপাশি আড়াল হয়ে যাচ্ছে বারবার নিয়মবহির্ভূতভাবে ‘রিশিডিউল’ করা ‘পরিশোধের নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে যাওয়া’ বিপুল পরিমাণ ঋণ, যেগুলোর প্রকৃত পরিমাণ বাংলাদেশ ব্যাংকেরও অজানা। আর একটা ক্যাটেগরির ঋণও অনিয়মিত: যেগুলোকে নতুন ঋণের সাথে এডজাস্ট করে ‘নিয়মিত’ দেখিয়ে চলেছে বিভিন্ন ব্যাংক। এই ব্যাপারটাও বাংলাদেশ ব্যাংক ঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। অতএব, খেলাপিঋণের উপরে উল্লিখিত সবগুলো ক্যাটেগরিকে যোগ করলে সন্দেহাতীতভাবে বলা যাবে যে খেলাপিঋণ সমস্যাটা ব্যাংকিং খাতের ‘নিরাময়অযোগ্য ক্যানসারে’ পরিণত হয়ে গেছে তিন দশক আগেই। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হলো, সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিরা সমস্যাটির উপরে উল্লিখিত মারাত্মক ডাইমেনশনগুলো সম্পর্কে অবহিত হওয়া সত্ত্বেও গত ত্রিশ বছর ধরে খেলাপিঋণ সমস্যাটিকে কার্পেটের তলায় লুকিয়ে ফেলার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে চলেছেন, সমস্যার সমাধানে তাঁরা মোটেও আন্তরিক নন।

বরং, ২০০৯ সাল থেকে বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার দফায় দফায় আরো ত্রিশটিরও বেশি নূতন ব্যাংকের লাইসেন্স প্রদানের খামখেয়ালি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেছে, যার ফলে একত্রিকরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগেই এদেশে মোট বাণিজ্যিক ব্যাংকের সংখ্যা একষট্টিতে পৌঁছে গিয়েছিল। প্রয়াত সাবেক অর্থমন্ত্রী জনাব মুহিত প্রতিবারই নূতন ব্যাংকের লাইসেন্স প্রদানের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে ক্ষমতানুযায়ী ওসব সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে গেছেন, কিন্তু প্রতিবারই তাঁর প্রতি অসম্মান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী নিজের একক সিদ্ধান্তে নূতন ব্যাংকের লাইসেন্স বিতরণের তৎপরতা চালিয়েই গেছেন। এসব নূতন ব্যাংকের মালিকদের মধ্যে তাঁর বেশ কয়েকজন আত্মীয়স্বজন রয়েছেন এবং আওয়ামী লীগের নেতা রয়েছেন কয়েকজন, যাঁদের নূতন ব্যাংকের লাইসেন্স গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় কুড়ি কোটি টাকা মূলধন থাকারই কথা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। (হয়তো ঐসব ব্যাংকের ‘ব্যবসায়ী পরিচালকরাই’ লাইসেন্সের অর্থ পরিশোধ করে দিয়েছেন)! এভাবে ব্যাংক খোলার যথেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবারই সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছি আমি, কিন্তু শীর্ষ নেতৃত্বের কর্ণকুহরে ঐ প্রতিবাদ পৌঁছায়নি। এতদিন পর এখন সরকারের ব্যাংকমার্জারের সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে দিয়েছে যে প্রধানমন্ত্রীর প্রয়োজনাতিরিক্ত ব্যাংক খোলার সিদ্ধান্তগুলো অবিমৃষ্যকারী স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত ছিল। পাঠকদেরকে জানাচ্ছি, দেশের ব্যাংকিং খাতের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা হচ্ছে এক কোটি পঞ্চান্ন লাখ প্রবাসী বাংলাদেশী। তাঁরা ফর্মাল চ্যানেলে কিংবা হুন্ডির মাধ্যমে যেভাবেই রেমিট্যান্স পাঠান না কেন তার একটা বড় অংশ নিরাপত্তার খাতিরে ব্যাংকে আমানত হিসাবে জমা হয়ে যাবেই। এর ফলে, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে আমানতের একটা ঢল চলমান রয়েছে। সেজন্য খেলাপিঋণ সমস্যা তিন দশক আগেই মহাসংকটে পরিণত হলেও ব্যাংকগুলোকে এখনো বড়সড় তারল্য সংকটে পড়তে হয়নি। সরকারও যেহেতু ব্যাপারটা জানে তাই খেলাপিঋণ আদায়ে বিএনপি বা আওয়ামী লীগের সরকার কখনই সত্যিকার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে নিষ্ঠাবান ছিল না। ১৯৯৮ সালে তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি প্রয়াত বিচারপতি সাহাবুদ্দীন বিআইবিএম আয়োজিত প্রথম নুরুল মতিন স্মারক বক্তৃতায় প্রত্যেক ব্যাংকের শীর্ষ দশ ঋণখেলাপির খেলাপিঋণ আদায়ের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। রাষ্ট্রপতির ঐ প্রস্তাবে কর্ণপাতও করেননি তখনকার ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, কিংবা পরবর্তীতে ক্ষমতায় আসা ২০০১৬ মেয়াদের বিএনপিজামায়াত জোট সরকার এবং ২০০৭৮ সালের সামরিক বাহিনীসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। বরং, বিএনপিজামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর খেলাপিঋণ লুকিয়ে ফেলাই ‘কালচারে’ পর্যবসিত হয়েছিল। উদাহরণ: আওয়ামী লীগ কর্তৃক ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত দেওলিয়া আদালতকে বিএনপি ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসেই একেবারে নিষ্ক্রিয় করে ফেলেছিল। দেওলিয়া আইনটি এখনো বহাল থাকলেও দেওলিয়া আদালতের ঘুম গত ২৩ বছরেও ভাঙেনি। বরং, ২০০১ সাল থেকে খেলাপিঋণ লুকিয়ে ফেলার সংস্কৃতি ২৩ বছরে ধাপে ধাপে এমনভাবে গেড়ে বসেছে যে সদ্যসাবেক অর্থমন্ত্রী মোস্তফা কামাল অভূতপূর্ব কয়েকটি ‘অযৌক্তিক ও অন্যায় সুবিধা’ দিয়ে রাঘববোয়াল ঋণখেলাপিদেরকে নিজেদের নাম ঋণখেলাপির তালিকা থেকেই উধাও করে দেওয়ার ব্যবস্থা করে গেছেন। দেশের সবচেয়ে বড় ঋণখেলাপি এখন খোদ প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা! অতএব, খেলাপিঋণের প্রতি সরকারের এহেন ন্যক্কারজনক দৃষ্টিভঙ্গি অব্যাহত রেখে ‘ব্যাংকের মার্জার’ ব্যাংকিং খাতকে সবল করে তুলবে আশা করা কি বাতুলতা নয়?

লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধপবিত্র হজ পালন সম্পর্কে ইসলামের দিক নির্দেশনা
পরবর্তী নিবন্ধমহাসড়কে সাপ্তাহিক হাট