ফকির জামাল : ’৭১-এর গেরিলা, ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদী

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী | রবিবার , ২১ আগস্ট, ২০২২ at ৪:৫৬ পূর্বাহ্ণ

ফকির জামাল একজন মুক্তিযোদ্ধা, শুধু মুক্তিযোদ্ধা নন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার। চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক মহলে তাঁর ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে। তাঁর পৈত্রিক নাম জামাল আহমদ, কিন্তু সে নামে এখন কেউ তাঁকে চিনবেন বলে মনে হয় না। ফকির জামাল বললেই জামাল আহমদকে চেনা যাবে।
তাঁর চালচলন ছিলো অতি সাধারণ। বেশভুষা মামুলি। প্যান্ট শার্ট অবশ্যই পড়তেন। তবে অনেক সময় লুঙ্গি পরেই বের হয়ে যেতেন এবং সেই পোশাকে দারুল ফজল মার্কেট, চশমা গলি, গ্র্যান্ড হোটেল (অধুনা লুপ্ত), সিটি কর্পোরেশন এবং আরো কত জায়গায় যে দর্শন দিতেন তার কোন ইয়ত্তা ছিলো না। নিরীহ গোবেচারা মানুষের মতো জমজমাট আসরের এক পাশে বসতেন। যেন ভাজা মাছটিও উল্টে খেতে জানেন না। এই নিরীহ, গোবেচারা স্বভাব এবং সাধারণ বেশভুষা থেকে জামাল সাহেবের জীবন দর্শনের আভাস মেলে। হৈ চৈ, ভোগবিলাস বা আড়ম্বরের মানুষ ছিলেন না তিনি। ৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য প্রতিরোধ যুদ্ধ সংগঠিত করতে গিয়ে তিনি পুলিশের নজরদারিতে পড়েন।
পুলিশ তাঁর পেছনে আঠার মতো লেগে থাকতো। ফলে পুলিশের চোখে ধুলো দেয়ার জন্য তিনি পীর আউলিয়ার মাজারে ফকির দরবেশের ন্যায় দাঁড়ি রেখে ময়লা কাপড়চোপড় পরিধান করে ফকিরি জীবন যাপন শুরু করেন। সেই থেকে তিনি ফকির জামাল।
ফকির জামাল ১৯৪২ সালে চট্টগ্রাম শহরের পূর্ব বাকলিয়াস্থ হাজী বশির আহমেদ সরদার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মৃত হাজী বশির আহমেদ সরদার, তিনি পেশায় একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে ব্যবসা পরিচালনা করতেন। এছাড়াও তিনি পূর্ব বাকলিয়া মহল্লার সরদার ছিলেন। জামালের মাতা হাজী হাফিজা খাতুন।
ফকির জামাল কৈশোরে নয়াবাজার পৌর কর্পোরেশন উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। এটি কোরবানীগঞ্জে অবস্থিত। এসএসসি পাস করার পর চট্টগ্রাম সিটি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে ভর্তি হন। সিটি কলেজ ছিলো ছাত্র রাজনীতির দুর্গ, ফকির জামালও অচিরেই রাজনীতিতে দাখিল হয়ে যান। সিটি কলেজে পড়া অবস্থায় তিনি শহর ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। এ সময় তিনি শহর আওয়ামী লীগ সভাপতি জহুর আহমদ চৌধুরীর সান্নিধ্যে আসেন। ক্রমান্বয়ে তিনি শহর ছাত্রলীগের একজন সাহসী ও পরিশ্রমী ছাত্রনেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তাঁর নেতৃত্বে বৃহত্তর বাকলিয়া ছাত্রলীগ সংগঠিত হয়েছিল। যেহেতু সামাজিকভাবে তাঁর পরিবারের প্রভাব ছিলো, তাই বৃহত্তর বাকলিয়া এলাকায় ছাত্রলীগ ও পরবর্তীতে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করতে তাঁর সুবিধা হয়েছিলো। পারিবারিক প্রভাব-প্রতিপত্তির কারণে কট্টর আওয়ামী লীগ বিরোধীরাও তাঁর রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে বাধা হয়ে দাঁড়াতে সাহস করেনি।
ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার ভিত্তিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম গড়ে ওঠে। ৬৬ থেকে একের পর এক আন্দোলনে কেঁপে কেঁপে উঠেছিলো বাংলাদেশ এবং অবশেষ ৬৯-এর প্রচণ্ড গণঅভ্যুত্থানে ফেটে পড়ে। এ সমস্ত আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে ফকির জামাল হয়ে ওঠেন একজন সংগ্রামী ছাত্রনেতা। ৭১-এর অসহযোগ আন্দোলনে ফকির জামালের আরো জঙ্গী রূপ প্রকটিত হয়। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করার পর কিছুদিন প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে ফকির জামাল ট্রেনিংয়ের জন্য ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের হরিণা ক্যাম্প, যেখানে তখন চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতারা ছিলেন, তিনিও সেখানে যান।
তিনি ভারতের উত্তর প্রদেশের টান্ডুয়া প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন। সেখানে তিনি প্রায় দেড় মাস ট্রেনিং নেন। ট্রেনিং শেষে তাঁর নেতৃত্বে বিএলএফ-এর একটি গ্রুপ গঠন করা হয়। এটি ছিলো চট্টগ্রাম শহরে বিএলএফ-এর কেসি ৬ গ্রুপ। গ্রুপ কমান্ডার ফকির জামালের ডেপুটি ছিলেন স্বপন আচার্য। এছাড়াও তাদের গ্রুপে সদস্য ছিলেন নুরুল আমিন (সদরঘাট), মোহাম্মদ সোলাইমান (বাকলিয়া), আনিস কাদেরী (পাথরঘাটা), মোহাম্মদ ইলিয়াস (চান্দগাঁও), মোহাম্মদ মুরাদ (আসকার দিঘীরপাড়), অধীর বাবু, নজরুল ইসলাম, ফজলুল, করিম (রাঙ্গুনিয়া) সহ অনেকে।
ফকির জামাল গ্রুপ নিয়ে ভারতের শ্রীনগর হয়ে আমলিঘাট আসেন। সেখান থেকে ছাগলনাইয়া বর্ডার দিয়ে দেশে প্রবেশ করেন। চট্টগ্রাম শহরে ফকির জামালের শেল্টার ছিল বাকলিয়ার ক্ষেতচর। মূলত সেখানেই তিনি তার গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে অবস্থান করতেন এবং সেখান থেকেই শহরে যুদ্ধ পরিচালনা করতেন।

স্বাধীনতার পর তিনি যুবলীগে যোগদান করেন। এছাড়াও সেই সময়ে আওয়ামী রাজনীতিকে সুসংগঠিত করতে তিনি নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। তিনি দীর্ঘদিন বৃহত্তর বাকলিয়ায় আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার দায়িত্ব পালন করেছেন।
ফকির জামালের কখনো পদ-পদবির দিকে নজর ছিল না। তিনি নেপথ্যে থেকে দলকে সংগঠিত ও জনগণের জন্য কাজ করে যেতে পছন্দ করতেন। স্বাধীনতা-উত্তর চট্টগ্রামের রাজনীতিতে তিনি বড় পদে আসীন হতে পারতেন কিন্তু তিনি সর্বদা ত্যাগী ও ভালো নেতাকর্মীদের সংগঠিত করার মাধ্যমে তাদের নেতৃত্ব বিকাশের পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করতেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর শাহাদাত-উত্তর আওয়ামী রাজনীতিতে সাহসী ভূমিকা পালনের জন্য ফকির জামাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। সেটা ছিলো এক বিশেষ সময়, যখন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ ছিলো নিষিদ্ধ। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের অনেকে কারাগারে, অনেকে আত্মগোপনে, অনেকের নামে হুলিয়া মামলা জারি করা হয়। এমনি কিছুদিন কেটে যায়। তারপর বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের সংকল্পে জেগে উঠলেন এস এম ইউসুফ, মৌলভী সৈয়দ, মহিউদ্দিন চৌধুরী, বাঁশখালীর সুলতান উল কবির চৌধুরী, সুভাষ আচার্য্য, গোলাম রব্বান, আনোয়ারুল আজিম, ইউনুস, কেশব সেন, পীষুষ রক্ষিত, শিশির দত্ত, পীষুষ চৌধুরী, শফিকুল ইসলাম, নায়েক শফি, এম এ মনসুর, অ্যাডভোকেট সালাউদ্দিন হারুন, অ্যাডভোকেট শ্যামল প্রসাদ সেন, জাহাঙ্গীর (চেয়ারম্যান), সৈয়দ আবু সিদ্দিক, সৈয়দ মোহাম্মদ জাকারিয়া, সৈয়দ আবদুল গণি, সৈয়দ মাহমুদুল হক, শফিকুল আহসান- ফকির জামালও তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে সশস্ত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ হন।
তিনি সেসময় তাদের সাথে ভারতে গিয়েছিলেন। আবার নব উদ্যেমে যুদ্ধের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার শপথ গ্রহণ করেছিলেন। চট্টগ্রাম শহরে ফকির জামাল তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে মিছিল করেন। এছাড়াও গেরিলা যুদ্ধের কৌশল অবলম্বন করে ঘাতক সরকারের বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় বোমা বিস্ফোরণ ও যুদ্ধের গোলা বারুদ, অস্ত্র-সরঞ্জাম সংগ্রহে তিনি ভূমিকা রেখেছেন। কিন্তু ভারতে মিসেস গান্ধী হত্যার পর রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদী যোদ্ধাদের স্বপ্ন ভঙ্গ হয়। সেদেশে মোরারজি দেশাই’র নেতৃত্বে জনতা সরকার ক্ষমতায় আসে। চক্রান্তকারী জিয়া সরকার ভারত সরকারের সাথে চুক্তি করে। যার ফলে ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী বাংলাদেশের প্রতিরোধ যোদ্ধাদের জোর করে দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। তাদের বিরুদ্ধে জিয়া সরকার ‘চট্টগ্রাম ষড়যন্ত্র মামলা’ দায়ের করে। ফকির জামালকেও সে মামলার আসামি করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে সে সময় হুলিয়া জারি করা হয়েছিল। তারপরেও ফকির জামাল থেমে থাকেননি। তিনি আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। সকল বাধা-বিপত্তি, ভয়-ভীতিকে উপেক্ষা করে তিনি সেদিন বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে সমুন্নত রেখেছেন। সংগ্রামের পথ থেকে বিচ্যুত হননি। চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের গতিশীলতা বজায় রাখতে মরিয়া লড়াই চালিয়ে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতের পর থেকে চট্টগ্রাম শহরে আওয়ামী রাজনীতিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্য জামাল আহমদ নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন।
১৯৮০ সালে ফকির জামালের পিতা বশির আহমদ সরদার মৃত্যুবরণ করেন। সে সময় তাঁর বিরুদ্ধে জিয়া সরকারের মিথ্যা মামলা, হুলিয়া জারি ছিল। তাই জানাজায় উপস্থিত হলেও তিনি জানাজার নামাজে অংশগ্রহণ ও দাফন কাজে অংশ নিতে পারেননি।
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি বেশ কয়েকবার কারাবরণ করেছেন। ১৯৮০ সালের পরে তিনি প্রায় পাঁচ বছর কারাগারে ছিলেন। ২০০১ সালে বিএনপি সরকারের মিথ্যা মামলায় প্রায় সাড়ে তিন মাস কারাবাস করেছেন।
ফকির জামাল দীর্ঘদিন বৃহত্তর বাকলিয়া আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়াও ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিনি চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য ছিলেন।
তিনি ১৯৯০ সালের পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চট্টগ্রাম মহানগর ইউনিট কমান্ডের সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
ফকির জামাল তাঁর পূর্বপুরুষের ন্যায় একজন পরোপকারী, সাহসী ও সত্যবাদী মানুষ ছিলেন। তাঁর পিতার পরে তিনিও পূর্ব বাকলিয়া সমাজের সরদার ছিলেন। তিনি সর্বদা সমাজে আর্থিকভাবে অসচ্ছল পরিবারের পাশে এসে দাঁড়াতেন। সমাজে কোন মেয়ের বিয়ে হলে তিনি আর্থিকভাবে সাহায্য সহযোগিতা করতেন। কোন কোন ক্ষেত্রে চাল-ডালের বস্তা দিয়েও সহযোগিতার হাত বাড়াতেন। সমাজের কোনো অসহায় মানুষ মৃত্যুবরণ করলে তিনি মৃত ব্যক্তির দাফন কাফনের ব্যবস্থা করতেন। মৃত্যু পরবর্তী মৃত ব্যক্তির ফাতেহায় পরিবারের পাশে এসে দাঁড়াতেন। এছাড়াও ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে তিনি ছিলেন অগ্রণী ভূমিকায়। এলাকায় মসজিদ মাদ্রাসা নির্মাণ সহ ধর্মীয় মিলাদ-মাহফিলে তিনি সহযোগিতা করতেন।
ফকির জামাল ১৯৭৩ সালে বিয়ে করেন হালিশহরস্থ মোগল সওদাগরের বাড়ি থেকে। তাঁর স্ত্রী সুলতানা বেগম, তাঁর দুই সন্তান-বড় মেয়ে, নাম শাহীন আক্তার, ছেলের নাম রিতাফ উদ্দিন বাবু।
লেখক : সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, সংস্কৃতি সংগঠক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধ২১ আগস্ট : ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা