দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ২১ আগস্ট, ২০২২ at ৪:৫৬ পূর্বাহ্ণ

অচেনা চীনের চেনা মুখ
এরই মধ্যে অবশ্য হেলেন এগিয়ে গেছে হঠাৎ মত বদল করা অভ্রকে বাইরে বেরুবার জন্য প্রস্তুত করতে। অন্যদিকে দীপ্র এতক্ষণে জমে উঠা তার ত্রিমুখী রাগের পুরোটাই ছোট ভাইয়ের উপর ঝাড়ার জন্য আমার হাত থেকে ছোটার চেষ্টায় হাত পা ছোড়াছুড়ি করা শুরু করতেই , মৃদু ধমকে তা সামলাতে হল বাধ্য হয়েই ।
বেইজিংয়ের সান্ধ্যহিমের মুখোমুখি হতে ধড়াচূড়া পরে অভ্রর তৈরি হতে যতোটা দেরী হবে ভেবেছিলাম, হেলেনের তৎপরতার সাথে অভ্রর সহযোগিতার যোগফলে, তার চেয়ে ঢের কম সময় লাগল দেখে দ্রুত বাইরে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব দীপ্র এতক্ষণ তার ধমকচাপা রাগ নিয়ে তুমুল উসখুস করতে থাকলেও, শান্ত হওয়ায় স্বস্তি পেলাম নিজেও।
অতএব সদলবলে রুম থেকে বের হবার উদ্দ্যেশ্যে রওয়ানা করতেই পেছন থেকে লাজু মনে করিয়ে দিল, ফেরার সময় যেন আগামি সকালের নাস্তাও নিয়ে আসি। ব্যাপারটা জরুরি অতএব সে কথা মনে করিয়ে ভালই করেছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যদিও প্রচলিত কথায় আছে কানাকে কানা বলিতে নাই, খোঁড়াকে খোঁড়া বলিতে নাই, এই নিয়ম জগতের সকলের ক্ষেত্রে খাঁটলেও স্ত্রীদের যে এ ব্যাপারে আছে অপার স্বাধীনতা, তা প্রমাণ করে লাজু সাথে এও মনে করিয়ে দিল যে আগের রাতের মতো আজ যেন অহেতুক পানি আর না নিয়ে আসি হোক, তা যতোই দামে কম। আগে আনা পানির ভোমাবোতলগুলোর তিন চতুর্থাংশ এখন মজুদ আছে রুমে।
হ্যাঁ, স্ত্রী কর্তৃক চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয়া এ সত্য যেহেতু আমি নিজেও জানি, তাই নিজের বোকামির জন্য আগে থেকেই তো মরমে মরমে যারপরনাই ত্যক্ত বিরক্ত আছি নিজের উপরে। ফলে আসলেই লাগল জবর স্ত্রীর খোঁচাটা। তারপরও স্ত্রী তার কানা স্বামীকে শতবার কানা ডাকলেও তাহাতে মোটেও কান দিতে নাই, এই মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে এ ব্যাপারে কোন রা শব্দ না করে বেরিয়ে গেলাম সবাইকে নিয়ে, লিফটের দিকে।
আগেও বলেছি এই হোটেলের লিফট সার্ভিস অত্যন্ত ভাল। এবারেও হল তাই পেয়ে গেলা দ্রুতই লিফট। ফলে নেমেও যেতে পারলাম নীচে অতি দ্রুতই সদলবলে। আর লিফটের দরজা খুলে যেতেই দু ভাই নিজেদের মাঝখানের একটু আগের দ্বৈরথ জলাঞ্জলি দিয়ে মহাউৎসাহে একজন আরেকজনের সাথে প্রতিযোগিতা করে যেভাবে লিফট থেকে নেমে দৌড়ে চলে গেল হোটেল থেকে বেরুবার গেইটের দিকে, তাতে বোঝা গেল একটু আগে ছোট ভাইয়ের উপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠা দীপ্রর রাগ পানি হয়ে গেছে এতক্ষণে। এদিকে এ রাতে চীনদেশ নামক এই ভিনদেশের মাটিতে ভাইপোদের নিরাপত্তার ব্যাপারটি নিশ্চিত করার তাড়নায় হেলেনও দ্রুত ওদের পিছু নিতেই, গলা চড়িয়ে চায়নিজ লবিতে বঙ্গভাষার অনুরণন তুলে মনে করিয়ে দিলাম, গেইট থেকে বেরিয়ে হুটহাট করে যেন কোনদিকে চলে না যায়। বরং থাকে যাতে মজুদ সবাই গেইটের সামনেই।
আমার এসব কথা ওদের কারো কানে গেল কি না জানি না, আর তা নিয়ে মাথা ঘামিয়েও লাভ নাই। ধীরেসুস্থে লবিতে এসে পা রেখে গেটের দিকে তাকিয়েও তাদের কারোই টিকিটিরও দেখা পেলাম না , শুধু বাইরে বেরুবার হোটেলের সেই ঘূর্ণায়মান দরজাটিকে ধীর গতিতে ঘুরে থেমে যেতেই বুঝলাম, একটু আগেই সে বাইরে উগড়ে দিয়েছে আমাদের ভ্রমণ দলের তিন সদস্যকে।
জোর ধারনা আমার, বাইরে বেরিয়ে দু পুত্র গেছে নিশ্চয়ই হোটেল লাগোয়া ফেরারি গাড়ীর শো রুমের দিকেই, যা নিশ্চয়ই এখন বন্ধ। অতএব সেই শো রুমের কাচের দেয়ালের এপাশে থেকেই দু’জন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে ভেতরে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকা দুই ফেরারিকেই , সাথে চলছে দু’জনের সেই গাড়ী বিষয়ক জটিল টেকনিক্যাল আলোচনা। আর ওদের পাহারায় থাকা হেলেন তুলছে তাদের সেইসব ছবি ।
এগুতে এগুতে লবিতে ইতিউতি দুয়েকজনকে হাঁটাহাঁটি করতে দেখলেও, লবির মাঝামাঝি এস দাঁড়িয়ে বা দিকে ঘাড় ঘোরাতেই মায়াবি আলো আঁধারির চাদরে মোড়া ঐদিকটার রেস্টুরেন্ট আর তার লাগোয়া বারের দিকে নজর পড়তেই দেখি ওখানকার অবস্থা হচ্ছে ‘ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোট সে তরী।’ বুঝতে পারছি না এ কি সব হোটেলের গেস্ট দিয়েই ভর্তি হল, নাকি আমাদের দেশে যেমন ক্রেডিট কার্ড কোম্পানির একজন খেলে একজন বা দুই জন ফ্রি নামক বিপণন প্রণোদনায় অহরহই নানান জন বিশেষত তরুণ তরুণীরা গিয়ে জড়ো হয় নানান পাঁচ তারকা হোটেলের রেস্টুরেন্টে, এইখানেও চলছে তেমন কোন মজমা। তবে ঘটনা যাই হউক, এতে তো এই হোটেলের রেস্টুরেন্টের হয়েছে পোয়াবারো। নাকি ঐ বেইজিংয়ের ডাউন টাউন এলাকার হোটেল বলেই এখানে প্রতিদিনই বসে এরকম খাদ্যরসিকদের হাট? সে হউক যা ইচ্ছা তা। কি আসে যায় তাতে আমার বা আমাদের। আমরা তো যাচ্ছি না ঐখানে খেতে। টেবিল ভরা থাকলেই কী আর ফাঁকা থাকলেই কী। যদিও মনে তীব্র একটা গোপন ইচ্ছা এরমধ্যেই ঘাই মারতে শুরু করেছে। আর তা হলো ঐ বারে গিয়ে একটু ঢু মেরে আসা। ওমর খৈয়মের সাকীদের মতো নিরালায় কাউকে ওখানে পাওয়া না গেলেও, বারটেন্ডার আর সুরা তো আছে মওজুদ! কিন্তু সে আশায় তো আমার গুড়ে বালি, ফলে দুঃখ বাড়িয়ে আর কি লাভ!
অতএব গেইটের দিকে এগুতে শুরু করলাম। ঐদিকে যেতে যেতে ডান দিকের কন্সিয়ার্জ ডেস্কে নিজের অজান্তেই চোখ চলে যেতেই, খুঁজলাম মনে মনে ওখানে মিস রিনাকে। কিন্তু নাহ দেখা পেলাম না তার। যদিও কোনই দরকার নাই এমুহূর্তে, তাও কেন যে মনে মনে খুঁজলাম তাকেই, জানি না। হতে পারে এই অচেনা চীনের রাজধানীতে সেই তো হয়ে উঠেছে আমার সবচেয়ে চেনা মুখ ও আপনজন এর মধ্যেই, যার কারনেই অবচেতন মন হয়ত খুঁজছিল তাকে! গেইটের বাইরে এসেই ঝট করে ফেরারি গাড়ির শো রুমের সামনেটা নজর ফেলে খাঁ খাঁ শূন্যতা দেখে ধক করে উঠলো বুক! আরে গেল কোথায় ওরা? ভেবেছিলাম তো ওরা থাকবে এখানে। আর তা নিয়ে একটা চিত্রকল্পও এঁকেছিলাম মনে মনে। কিন্তু এখন তো দেখছি সেই চিত্রও নাই আর যা কল্পনা করে ছিলাম তাও নিছক কল্পনাই। খিচড়ে গেল মেজাজটা কিছুটা! এই হিম রাতে গেল তারা তবে কোনদিকে। তবে ভরসার কথা হেলেন আছে সাথে।
“বাবা, বাবা এই যে আমরা এইখানে” হিম আর ধোঁয়াশার চাদর ঢাকা অন্ধকার ভেদ করে বাঁ দিক থেকে দীপ্রর গলা কানে আসতেই, হোটেলের লাইটের আলো রাতের অন্ধকারকে যতোটা আলোকিত করতে পারত ঐ জায়গাটা, তা হয়নি। গোটা এলাকাটাকেই তো জাপটে ধরে আছে ঘন ধোঁয়াশা। ফলে ঐ দিকটায় তৈরি হয়েছে এক অদ্ভুত আলো আঁধারির আবহ। তার মধ্যেই আবছা আভাস দেখা গেল তিন সাইজরে তিনমূর্তির। দাঁড়িয়ে আছে ওরা হোটেলে বিল্ডিংটার বাঁ পাশের ফুটপাতে।
কী ব্যাপার ওখানে কী করছে ওরা? তবে কি দীপ্র যে রেস্টুরেন্টের কথা বলেছে সেটা কি ওইদিকেই নাকি? কিন্তু গত রাতে ওইদিকটা আমি তো চষে বেড়িয়েছিলাম রেস্টুরেন্টের খোঁজে, তেমন কিছু তো চোখে পড়েনি! আবার আজ তিয়েন আন মেন থেকে ফেরার পথে তো ঐ রাস্তা ধরেও আসিনি। আসার কথাও না, কারণ এটা তো ওয়ান ওয়ে রোড। অথচ দীপ্র বলেছিল আজ শেষ বিকেলে হোটেলে ফেরার পথে তার নজরে পড়েছিল সেই রেস্টুরেন্ট। অতএব ওটা ওদিকে হতেই পারে না, এসব ভাবতে ভাবতে এগুতে এগুতেই মনে পড়লো আরে ওইদিকেই তো আছে আরো দুই সৈয়দ বংশীয় গাড়ী, মাজারাতি আর এস্টন মার্টিনের শো রুম । যার মানে হলো ফেরারী শো রুমে ফেরারি দুটোই যে সশরীরে আছে মজুদ তা তো তারা হোটেলে ফিরে গাড়ী থেকে নেমেই দেখেছে। এখন ওরা নিশ্চয়ই বিষম চিন্তায় পড়েছে গতকাল দেখা এস্টন মার্টিন আর মাজারাতি গাড়ী গুলো এরই মধ্যে বিক্রি হয়ে গেল কি না ! গেছে তাই তারা ঐদিকে তা নিশ্চিত করার জন্য।
ভাইপোরা ঐদিকে চলে যাওয়া, তাদের নিরাপত্তার খাতিরে হেলেনও করেছে সেদিকেই অনুগমন। কপাল ভাল অতি উৎসাহে রাস্তা পেরিয়ে রাস্তার উল্টা দিকে থাকা সেই শো রুম গুলোর একদম সামনে গিয়ে দাঁড়ায়নি ওরা। অবশ্য এই হোটেলের বা পাশ দিয়ে গড়িয়ে যাওয়া এই পাশরাস্তাটা মোটামুটি নীরব। গাড়ী খুব কমই ঢোকে এই রাস্তায়। তারপরও অচেনা জায়গায় এরকম আলো আঁধারিতে রাস্তা পেরিয়ে ঐ পাশে গেলে কোন ঝামেলা হয় তা তো বলা যায় না। জালটাকার এই শহরে ছিনতাইকারী নাই তা হলফ করে বলা যায় না। আবার মিস রিনাই যখন উদগ্রীব ছিল আমরা কোন টাউট বাটপারের পাল্লায় পড়েছি কি না, দুপুরে পথ হারিয়ে খোদ তিয়েন আন মেন স্কয়ার সংলগ্ন নিষিদ্ধ নগরী এলাকায়, সে জায়গায় এখানেও ঐরকম টাউট বাটপার থাকা খুবই সম্ভব।
লেখক : ভ্রমণ সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধধর্ষণ : দিন দিন বেড়েই চলেছে এই নৃশংসতা
পরবর্তী নিবন্ধফকির জামাল : ’৭১-এর গেরিলা, ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদী