হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ২০ মার্চ, ২০২১ at ৫:৫৭ পূর্বাহ্ণ

ডাচ নির্বাচন
আরো চার বছরের জন্যে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় বসতে চলেছেন
একটানা তিন দিন ধরে চলা ডাচ পার্লামেন্ট নির্বাচন শেষ হলো আজ (১৭ মার্চ) স্থানীয় সময় রাত ন’টায়। সাধারণতঃ এক দিনেই অনুষ্ঠিত হয় ডাচ পার্লামেন্ট নির্বাচন। কিন্তু এবার ‘করোনার’ কারণে ভোটারের ভিড় এড়ানোর জন্যে এই ব্যবস্থা। প্রথম দুদিন অর্থাৎ ১৫-১৬ মার্চ নির্ধারিত ছিল কেবল বয়স্ক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ যারা তাদের জন্যে। এবার ডাকযোগেও ভোট দেয়া হলো। তবে তা কেবল ৭০ বছরের ঊর্ধ্বে যে সমস্ত ভোটার তাদের জন্যে। প্রথমবারের মত ডাকযোগে ভোট ব্যবস্থা হওয়াতে অনেকে ঠিকমত ব্যালট পেপার ব্যবহার করতে পারেননি, ফলে বেশ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোট ইতিমধ্যে বাতিল হয়ে গেছে বলে জানা যায়। রাত আটটা নাগাদ ভোট দিয়ে এলাম আমরা। আমরা বলতে সন্তান অতীশ এবং তার মা। মেয়ে থাকে ভিন্ন শহরে। সে দেবে সেখানে। ভোটের ব্যাপারে সবাই সচেতন। অতীশের এই প্রথমবারের মত ভোট দেয়া। স্বাভাবিকভাবে সে ‘এক্সসাইটেড’। দিন কয়েক আগে জিজ্ঞেস করি, ‘কোন পার্টিকে ভোট দেবে’? ‘ঠিক করিনি’, তার উত্তর। অনলাইনে ‘ভোট-ডিরেক্‌শনে’ গিয়ে দেখবো আমাকে কী সাজেস্ট করে, তবে খুব সম্ভবতঃ প্রো-ইউরোপীয় নতুন দল, ‘ভোল্টকে’ দেব, জানায় অতীশ। এবার আমার মত হল্যান্ডে বসবাসরত অনেক বাঙালি ভোট দিয়েছেন গ্রীন পার্টিকে। আমরাও – আমি ও সুমনা- এই প্রথমবার দল বদল করে ভোট দিলাম গ্রীন পার্টিকে। দেবার পেছনে কারণ ছিল। সে প্রসঙ্গে একটু পর আসছি। তার আগে বলে নেই ভোট রাত ন’টায় শেষ হবার এক ঘণ্টারও কম সময়ে ঘোষিত ‘এক্সিট পোলস’ কী বলে।
নির্বাচনের যে এক্সিট ফলাফল তাতে এটি নিশ্চিত যে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুটে চতুর্থ বারের জন্যে অতি উন্নত ও ধনী এই দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন। তবে তাকে ডি-৬৬ ও অন্য কোন একটি দলের সাথে কোয়ালিশনে যেতে হবে। অন্যান্য বারের মত এবারও গঠন করা হবে কোয়ালিশন সরকার, কেননা কোন দল এবারও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে সক্ষম হয়নি। চার বছর আগে কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে সময় লেগেছিল প্রায় বছর খানেক। এবার হয়তো তেমন সমস্যা হবে না। অন্যদিকে, অনেকেই ধরে নিয়েছিল ‘করোনার’ কারণে এবারের নির্বাচনে ভোটের পরিমাণ খুব বেশি হবে না। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে ভোটের পরিমাণ ছিল ৮১,৬% ভাগ। চার বছর আগে অর্থাৎ ২০১৭ সালে ভোট পড়েছিল ৮১,৯% এবং সব চাইতে বেশি ভোট পড়েছিল ১৯৮৬ সালে, ৮৫,৮% ভাগ।
দেড় শত আসনের পার্লামেন্টে ৩৬ আসন দখল করে সব চেয়ে বড় বিজয়ী দল হলো বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুটের দল, পিপলস পার্টি ফর ফ্রিডম এন্ড ডেমোক্রেসি (ফেই ফেই দে)। গতবারের চাইতে তিনটি আসন বেশি পেয়েছে ফেই ফেই দে। দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে ডি-৬৬ বা ডেমোক্র্যাটস ৬৬। এই দলটি পেয়েছে ২৭টি আসন। গতবারের চাইতে ৮টি আসন বেশি। সেই বিচার্যে ডি-৬৬ সব চাইতে বেশি সফল দল হিসাবে আবির্ভূত এবারের নির্বাচনে। এই ফলাফল ছিল দলটির সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ফলাফল। সর্বশেষ ১৯৯৪ সালে দলটি পেয়েছিল ২৪টি আসন। তবে অনেকের দৃষ্টি ছিল বিদেশি ও মুসলিম-বিদ্বেষী উগ্র ডান ন্যাশনালিস্ট দল, পেই ফেই ফেই বা পার্টি ফর ফ্রিডম ও এর বিতর্কিত নেতা খিয়ের্ট বিল্ডার্সের দিকে। তার দল গেলবারের চাইতে ৩টি আসন হারিয়ে ১৭টি আসন দখল করে তৃতীয় শক্তিশালী রাজনৈতিক দল এবং সর্ব বৃহৎ বিরোধী দল হিসাবে দেখা দিল। এক্সিট ফল ঘোষণার পর পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে খিয়ের্ট বিল্ডার্স নির্বাচনে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান অধিকারী দল, প্রধানমন্ত্রী রুটের ফেই ফেই ডে এবং দ্বিতীয় দল দি-৬৬ প্রধানকে অভিনন্দন জানান এবং বলেন, ‘এই দুই দল সরকার গঠন করতে সক্ষম হবে এবং আমার দলের তাতে যাবার সম্ভাবনা নেই। তবে আমরা বিরোধী আসনে থেকে জনগণের কথা বলে যাব’। অন্যদিকে, ক্রিস্টিয়ান ডেমোক্রেটিক এলায়েন্স (সিডিএ) ৫টি আসন হারিয়ে চতুর্থ দলে আত্মপ্রকাশ করে। এবারের নির্বাচনে চমক দেখিয়েছে প্রো-ইউরোপীয় দল, ভোল্ট। অতীশ ভোট দিয়েছে এই দলটিকে। প্রথমবারের মত নির্বাচনে অংশ নিয়ে এই দলটি পেয়েছে ৩টি আসন। ডানপন্থী ইউরোপ-এস্কেপ্টিক হিসাবে পরিচিত চেরি বাউদওর ফোরাম ফর ডেমোক্রেসি পেয়েছে ৮টি আসন। যে গ্রীন পার্টিকে ভোট দিয়েছি প্রথম বারের মত ভালো করেনি এবারের নির্বাচনে। গেল বারের ১২টি আসন থেকে ৪টি হারিয়ে গ্রীন পার্টির আসন সংখ্যা এখন দাঁড়ালো ৮এ। মনটা একটু খারাপই হয়েছিল, যতটা না যে দলকে ভোট দিয়েছি তার হতাশজনক ফলাফলের জন্যে, তার চাইতে বেশি এই দল থেকে ভোটে লড়া বন্ধু নিলস তার আসন ধরে রাখতে পারলো না বলে।
এই দল থেকে দাঁড়িয়েছিলেন সিটিং এম পি বাংলাদেশের জামাই, ডাচ রাজনীতিবিদ নিলস ফান দেন বের্গ। বন্ধু নিলস হল্যান্ডে বাংলাদেশ সমাজে অতি পরিচিত ও জনপ্রিয় মুখ। তার সাথে আমার পরিচয় ২০১২ সালে। হল্যান্ড থেকে একটি ‘উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ’ দল যাবে বাংলাদেশে। বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের প্রাথমিক ধারণা দেবার জন্যে ভলান্টারী সার্ভিস ওভারসীজ (ভি এস ও) এর আমন্ত্রণে দূরের এক শহরে গিয়েছিলাম। এর পর তার সাথে বেশ অনেক বছর দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি। নিলস বাংলাদেশে গিয়ে এক পর্যায়ে নিজেই একটি উন্নয়ন সংস্থা খুলে বসেন এবং দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কাজ শুরু করেন। কিছু কিছু বাংলাও শেখা হয় তার ইতিমধ্যে। পরিচয় হয় ভিএসও-তে কর্মরত বরিশালের তরুণী শম্পা বালার সাথে। পরিচয় থেকে ভালোবাসা এবং বিয়ে। মাথায় টোপর পরে বিয়ে করলেন বাঙালি তরুণী শম্পা, বাংলাদেশেই। অনেক দিন পর দুজনের দেখা বাংলাদেশ দূতাবাসের এক অনুষ্ঠানে। যে দলটিকে বাংলাদেশ সম্পর্কে ব্রীফ করেছিলাম তাতে যে নিলসও ছিল সে কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। তার পেছনে কারণও আছে। কেননা ভিএসও-র সে দিনের কয়েক ঘণ্টার অনুষ্ঠানে আরো দশ-বার জনের ভিড়ে নীলসের সাথে তেমন করে আলাপ হয়নি। উনি নিজ থেকে না বললে জানাই হতোনা উনি সেই তিনি যার সাথে বছর কয়েক আগে দেখা হয়েছিল। অমায়িক ও বিনয়ী এই ডাচ তরুণ এম পি এবার আবার নির্বাচন করবেন জেনে নিজ থেকেই তাকে জানিয়েছিলাম যে তার জন্যে প্রচারণা চালাবো, কেবল বাংলাদেশি ভোটারদের মাঝে নয় পাশাপাশি ডাচ ও অন্য সমপ্রদায়ের মাঝেও। সে লক্ষ্যে তাকে বলেছিলাম তার ছবি সহ ‘ফ্লাইয়ার’ তৈরি করতে। ‘ফ্লাইয়ার’ নিয়ে নির্বাচনের দিন কয়েক আগে বাসায় এসেছিল তার স্ত্রী, শম্পা। হাতে চমৎকার ফুল। খাওয়া-দাওয়া আর আড্ডার মাঝে জানা হলো নিলস-শম্পার অজানা মজার কাহিনী। সে কোন এক সময় লেখা যাবে।
পরিশেষে: এক্সিট ফলাফল ঘোষণার পর পর প্রত্যেক দল নেতা বিজয়ীদের অভিনন্দন জানান। যারা হেরে গেছেন তারাও বিজয়ীদের অভিনন্দন জানান, পাশাপাশি অভিনন্দন জানান দেশের জনগণকে, তাদের ভোটারদের। কারো কোন অভিযোগ নেই প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে। অভিযোগ নেই ভোট কারচুপি বা কোন ধরনের অনিয়মের। যেমনটি দেখি আমাদের দেশে, প্রতিবেশি দেশ ভারতে, এমন কী বিশ্বমোড়ল আমেরিকায়ও। নির্বাচনের আগেও দেশের কোন দেয়ালে, রাস্তায় কোন ব্যানার, পোস্টার ঝোলানো হয়নি (কেবল শহরের নির্দিষ্ট কয়েকটি স্থানে সব দলের পোস্টার সাঁটানো ছাড়া), ছিল না কোন মিছিল, স্লোগান, মারপিট অস্ত্রের ঝনঝনানির কথা বাদই দিলাম। এমনটি কখনো কি দেখবো সোনার বাংলায় কিংবা আমাদের অঞ্চলে? বোধ করি স্বপ্নেও না।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধহালদা নয়- পানির বিকল্প উৎস প্রসঙ্গে
পরবর্তী নিবন্ধ৫ চেয়ারম্যান প্রার্থীসহ ৮ জনের প্রার্থিতা বাতিল